অহমদাবাদের এয়ার ইন্ডিয়া বিমান দুর্ঘটনাকাণ্ডে প্রকাশ্যে আসছে একের পর এক চা়ঞ্চল্যকর তথ্য। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, অভিশপ্ত উড়োজাহাজের ডানার ফ্ল্যাপ ঠিকমতো কাজ না করার জন্যেই ঘটে গিয়েছে এত বড় বিপত্তি। এ ছাড়া বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারেও সমস্যা ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর তদন্তে নেমেছে অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন’ বা ডিজিসিএ। টাটা গোষ্ঠীর উড়ান সংস্থাকেও আতশকাচের তলায় রেখেছেন তারা।
চলতি বছরের ১২ জুন দুর্ঘটনার কিছু ক্ষণের মধ্যেই অভিশপ্ত বিমানটির একগুচ্ছ ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলি দেখে বিশ্লেষকদের দাবি, মাটি ছাড়ার পর উড়োজাহাজটির ডানার ফ্ল্যাপ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সেই কারণেই গোত্তা খেয়ে দিক্ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে মার্কিন সংস্থা বোয়িঙের তৈরি ‘৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার’ মডেলের ওই বিমান। ফলে উড়োজাহাজটিকে নিয়ন্ত্রণ করা পাইলটের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দ্রুত নীচে নেমে এসে বিমানবন্দর লাগোয়া চিকিৎসক-পড়ুয়াদের একটি হস্টেলের উপরে ভেঙে পড়ে সেটি।
সংবাদ সংস্থা গার্ডিয়ান থেকে শুরু করে রয়টার্স। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, বোয়িঙের ‘৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার’ বিমানগুলির ডানার ফ্ল্যাপের সমস্যা নতুন কিছু নয়। গত মে মাসে এই কারণেই অন্তত চার বার জরুরি অবতরণ করতে হয়েছে এই মডেলের একাধিক উড়োজাহাজকে। এর মধ্যে এক বার যাত্রীদের জীবনহানির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কোনও মতে বিপদ এড়াতে সক্ষম হন পাইলট। যদিও ‘ড্রিমলাইনার’-এর যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি মানতে নারাজ মার্কিন বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, বিমানের ডানার বাইরের অংশে বসানো থাকে ফ্ল্যাপ। ফিউজ়লেজ এবং আইলারনের মাঝখানে এর অবস্থান। আকারে বড় উড়োজাহাজগুলির ফ্ল্যাপে তিনটি অংশ থাকে। প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলিকে ওড়ার বা অবতরণের সময় প্রসারিত করেন পাইলট। এর সাহায্যেই বাতাসে উড়োজাহাজটির ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হন তিনি। এ-হেন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ কাজ না করলে যে কোনও মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে বিমান, মত বিশেষজ্ঞদের।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের সাবেক পাইলট অ্যালিস্টার রোজ়েনশেইন। স্কাই নিউজ়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার সময় এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটির যে ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে, সেটা দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটা মনে হচ্ছে যে বিমানটির টেক অফ ফ্ল্যাপ সেটিং ঠিক ছিল না। সেই কারণেই মাটি ছাড়ার পর অ্যারোডাইনামিক সমস্যায় পড়ে ওই উড়োজাহাজ। এর জেরে উপরে যাওয়ার বদলে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি নীচে নামতে শুরু করে।’’
এ ব্যাপারে বাকিংহ্যামশায়ার নিউ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্কো চ্যান বলেছেন, ‘‘ফ্ল্যাপ স্থাপনের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভাবে পাইলটের উপরে নির্ভরশীল। এটা বসানো থাকলে উড়োজাহাজের ডানার ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পায়। শুধু তা-ই নয়, গতি কম রেখে বিমানকে বাতাসে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ফ্ল্যাপের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ভুল ভাবে সেটি বসানো থাকলে ফ্ল্যাপ বিপরীতমুখী কাজ করতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’’
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের মে মাসে ওড়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই আমস্টারডামে জরুরি অবতরণ করে বোয়িঙের ‘ড্রিমলাইনার’। সংশ্লিষ্ট বিমানটি যাত্রীদের নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে যাচ্ছিল। জরুরি অবতরণের পর উড়োজাহাজটির ডানায় সমস্যা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন পাইলট। সূত্রের খবর, তদন্তে জানা যায় বিমানটির ফ্ল্যাপ ঠিকমতো কাজ করছে না। মেরামতির পর ফের সেটিকে আকাশে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় নেদারল্যান্ডসের সরকার।
অধ্যাপক চ্যান জানিয়েছেন, প্রতি বার ওড়ার সময় বিমানের ডানার ফ্ল্যাপ সেটিং আলাদা হতে পারে। সেই কারণে ককপিটে বসার আগে সেটিকে ভাল ভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। নইলে এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে না। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য উড়ান সংস্থা একাধিক পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এয়ার ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণের কর্মীরা এ ব্যাপারে কতটা তৎপর ছিলেন, বর্তমানে তা খতিয়ে দেখছে ডিজিসিএ।
এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণের মধ্যে আরও একটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, অভিশপ্ত বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি ছিল। ফলে উড়োজাহাজ ওড়ার পর সেটি ঠিকমতো বন্ধ হয়নি। এই ল্যান্ডিং গিয়ারই বিমানের ভার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিমান ওঠানামার সময় রানওয়ের সংস্পর্শে আসে ল্যান্ডিং গিয়ার। এখান থেকে বেরিয়ে আসে বিমানের চাকা।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের সাবেক পাইলট অ্যালিস্টারের দাবি, ‘‘দুর্ঘটনার সময়ের ভিডিয়োয় ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যাটা চোখে দেখা গিয়েছে। উড়োজাহাজটি মাটি ছাড়ার পরও ল্যান্ডিং গিয়ার নীচের দিকে ছিল। ওটা তখন উপরের দিকে উঠে যাওয়ার কথা।’’ এয়ার ইন্ডিয়ার যে বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে, তা ছিল ১২ বছরের পুরনো। এতে আগে থেকে ল্যান্ডিং গিয়ারের কোনও সমস্যা ছিল কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
সূত্রের খবর, এয়ার ইন্ডিয়ার কাছে মোট ৩০টি বোয়িঙের তৈরি ‘ড্রিমলাইনার’ রয়েছে। এগুলির মডেল নম্বর, ৭৮৭-৮ এবং ৭৮৭-৯। অহমদাবাদ দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট বিমানগুলিকে আপাতত না ওড়ানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে কেন্দ্র। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও ঘোষণা করা হয়নি। ডিজিসিএ-র তরফে টাটা গোষ্ঠীর উড়ান সংস্থাকে এই মডেলের বিমানগুলির অতিরিক্ত রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৫ জুন মধ্যরাত থেকে যা শুরু করবে এয়ার ইন্ডিয়া।
পাশাপাশি, টাটা গোষ্ঠীর উড়ান সংস্থাকে দু’সপ্তাহের মধ্যে ‘ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ পরিদর্শন’ (পড়ুন ফ্লাইট কন্ট্রোল ইন্সপেকশন) চালু করতে বলেছে কেন্দ্র। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ইঞ্জিনের শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা যাচাইকরণ প্রক্রিয়া। দু’টি সংস্থার তৈরি ইঞ্জিন ‘ড্রিমলাইনার’-এ ব্যবহার করেছে বোয়িং। এর মধ্যে একটি হল রোলস রয়েস এবং অপরটির নাম জেনারেল ইলেকট্রিক। অহমদাবাদের অভিশপ্ত উড়োজাহাজটিতে ছিল রোলস রয়েসের ট্রেন্ট-১০০০ ইঞ্জিন।
অন্য দিকে, দুর্ঘটনার এক দিনের মাথায় চিকিৎসক পড়ুয়াদের হস্টেলের ছাদ থেকে উদ্ধার হয়েছে ভেঙে পড়া বিমানের ব্ল্যাক বক্স। এর মধ্যে উড়োজাহাজের প্রয়োজনীয় তথ্য বন্দি থাকে। সেই নথি বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ জানা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিটি যাত্রিবাহী বিমানে দু’টি করে ব্ল্যাক বক্স থাকে। এ ক্ষেত্রে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয় একটি ‘কালো বাক্স’।
অহমদাবাদ দুর্ঘটনার তদন্তে নেমে সংশ্লিষ্ট ব্ল্যাক বক্সটির হদিস পান এয়ারক্রাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি) এবং গুজরাত সরকারের ৪০ জন আধিকারিকের একটি দল। ঘটনাস্থলে চিরুনিতল্লাশির সময় সেটি হাতে আসে তাঁদের। অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, নাম ব্ল্যাক বক্স হলেও এই যন্ত্রের রং গাঢ় কমলা। বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও এটি নষ্ট হয় না। জলে পড়লে, আগুনে পুড়ে গেলেও বছরের পর বছর অক্ষত থাকে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ‘কালো বাক্স’র মধ্যে থাকে বিমানের গতি, উচ্চতা, ইঞ্জিন কী ভাবে কাজ করছে, সেই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। ককপিটে কী কথাবার্তা চলছে, এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে পাইলটের কী কথা হয়েছে, তা-ও রেকর্ড করে ব্ল্যাক বক্সে। এ-হেন তথ্য অক্ষত রাখতে বাক্সটিকে স্টিল এবং টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি করে প্রতিটি বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা।
ব্ল্যাক বক্স যন্ত্রটির দু’টি অংশ রয়েছে। একটির নাম ডিজিটাল ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (ডিএফডিআর)। অপরটিকে বলা হয়, ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (সিভিআর)। বিমানের প্রযুক্তিগত তথ্য মজুত থাকে ডিএফডিআরে। অন্য দিকে, ককপিটের যাবতীয় কথোপকথন ধরা থাকে সিভিআরে। এটি মূলত বিপদের সময় পাইলট কার সঙ্গে কী কথা বলেছেন তার রেকর্ডিং। ফলে এর থেকে দুর্ঘটনার মুহূর্তে ঠিক কী ঘটেছিল তা বুঝতে পারবেন তদন্তকারীরা।
অহমদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ল, ডিজিসিএ-র পাশাপাশি তা পৃথক ভাবে তদন্ত করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক। ১৩ জুন গভীর রাতে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে সে কথা জানিয়ে দেন তারা। এই কমিটি তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
অহমদাবাদকাণ্ডের পর ডিজিসিএ অবশ্য জানিয়েছে, দুর্ঘটনার ঠিক আগের মুহূর্তে সাহায্য চেয়ে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বা এটিসির কাছে ‘মেডে কল’ পাঠান পাইলট ক্যাপ্টেন সুমিত সাভারওয়াল। বিমানটির সহকারী পাইলটের আসনে ছিলেন ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দর। অন্য দিকে বোয়িঙের এক প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ারের দাবি, ‘ড্রিমলাইনার’ মডেলগুলি ত্রুটিপূর্ণ। সেগুলি ওড়ানো মানে টাইম বোমা নিয়ে আকাশে যাওয়া।
গত ১২ জুন অহমদাবাদের মাটি ছাড়ার ২-৩ মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দর লাগোয়া চিকিৎসক পড়ুয়াদের হস্টেলে ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার ‘এআই১৭১’ উড়োজাহাজ। অভিশপ্ত বিমানে ছিলেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী-সহ মোট ২৪২ জন। তাঁদের মধ্যে এক জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছে। বাকিরা সকলেই প্রাণ হারিয়েছেন। দুর্ঘটনায় ওই হস্টেলের অনেকে নিহত হওয়ায় মৃতের সংখ্যা ২৭০ ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর। --