ভারতের যে মন্দিরগুলিতে বিপুল পরিমাণে জনসমাগম হয়, তার মধ্যে অন্যতম বাঁকে বিহারী মন্দির। উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনের সেই মন্দিরে প্রতি দিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার পুণ্যার্থীর আগমন হয়। জন্মাষ্টমী বা হোলির সপ্তাহগুলিতে সেই সংখ্যা পৌঁছোয় দৈনিক পাঁচ লক্ষে।
প্রতি দিন হাজার হাজার ভক্ত সমাগমের কারণে বৃন্দাবনের সরু গলিগুলি একপ্রকার থমকে যায়। তার উপর দোকানপাট, বাজার, ফল-মিষ্টি-মালার দোকান তো রয়েইছে। তবে বাঁকে বিহারী মন্দিরের আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার অর্থনীতি এবং মানুষের আয়ের ভিত্তি এই মন্দির। বহু স্থানীয়ের রুজি-রোজগারের ভরসাও।
২০২২ সালে জন্মাষ্টমীর দিন বাঁকে বিহারী মন্দিরে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। প্রচণ্ড ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে দু’জন পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়। বেশ কয়েক জন ভক্ত পদদলিত হয়ে আহত হন। সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনের স্মৃতি এখনও অনেকের মনেই তাজা। প্রতি বার ভিড় বৃদ্ধি পেলে আশঙ্কাও বাড়ে।
সেই প্রেক্ষাপটে পুণ্যার্থীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা দিতে বাঁকে বিহারী করিডর তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সরকার। সরকারের দাবি, এই করিডর তৈরি হলে মন্দিরের প্রবেশপথ প্রশস্ত হবে। শৃঙ্খলা আসবে দর্শন প্রক্রিয়ায়।
এ ছা়ড়াও ওই প্রকল্পের আওতায় মন্দির চত্বরের কাছে শৌচাগার, পানীয় জল এবং চিকিৎসাকেন্দ্রের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকার।
করিডরের নীলনকশায় প্রশস্ত প্রবেশ এবং প্রস্থানপথ, দর্শনের জন্য পৃথক রাস্তা, বয়স্ক তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশ্রামের জায়গা তৈরির কথাও বলা হয়েছে।
আর সরকারের সেই করিডর তৈরির প্রস্তাব এবং নতুন করে অছি তৈরি নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে সরকারের সেই পরিকল্পনা।
২০১৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাঁকে বিহারী মন্দিরের পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একাধিক জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। ২০২৩ সালে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারকে সেই করিডর বানানোর অনুমতি দেয় সে রাজ্যের হাই কোর্ট।
কিন্তু উচ্চ আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ওই করিডর বানানোর জন্য খরচ করতে হবে সরকারকেই। প্রকল্পের জন্য মন্দির তহবিল ব্যবহার করতে পারবে না সরকার।
এর পরেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় যোগী সরকার। উচ্চ আদালতের রায় সামান্য বদলে শীর্ষ আদালত জানায়, করিডরের জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচ একর জমি কেনার জন্য বাঁকে বিহারী মন্দিরের ২৫০ কোটির স্থায়ী আমানত ব্যবহার করতে পারে সরকার।
সুপ্রিম কোর্টের সেই আদেশের পরই অধ্যাদেশ জারি করে উত্তরপ্রদেশ সরকার। অছি বানিয়ে সরকার কাজকর্মও শুরু করে। কিন্তু সরকারের সেই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা অছি পরিষদ গোস্বামী কমিটি।
গোস্বামী কমিটি দাবি জানায়, মন্দিরের বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপের দরকার নেই। সরকার তাদের সাহায্য করলে তারাই মন্দিরে আগত দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে।
বিষয়টি নিয়ে সরকার পাল্টা যুক্তি দেয়, মন্দিরের দায়িত্ব এমন কারও হাতে থাকা উচিত যাঁকে দর্শনার্থীরা ভরসা করতে পারবেন। সরকার দায়িত্ব নিলে মন্দির পরিচালনায় স্বচ্ছতা আনা হবে বলেও দাবি করা হয় যোগী প্রশাসনের তরফে।
বংশপরম্পরায় বাঁকে বিহারীর দায়িত্বে থাকা সেবায়েত গোস্বামীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন, সরকারি হস্তক্ষেপে বাঁকে বিহারী মন্দিরের দৈনন্দিন আচার-অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্যের উপর প্রভাব পড়বে।
তবে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিশ্রুতি, সরকার দায়িত্ব নিলে সেবা এবং পূজাব্যবস্থা যেমন আছে তেমনই থাকবে। সেবায়েতদের কাজেও বাধা পড়বে না। দোকানদার এবং বাসিন্দারা যদি বাস্তুচ্যুত হন তা হলে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ন্যায্য ভাবে স্থানান্তরিত করা হবে তাঁদের।
অন্য দিকে, স্থানীয়েরাও সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন। স্থানীয় জনগণের দাবি, করিডর বানানোর নামে পুরো মন্দিরের দায়িত্ব নিতে চাইছে সরকার। করিডর হওয়ার পর মন্দিরের আয়ও সরকারের কাছে যাবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অনেকে।
স্থানীয়েরা এ-ও দাবি করেন, মন্দিরকে কেন্দ্র করে স্থানীয়েরা যে করেকম্মে খাচ্ছিলেন, তাতেও বাধা পড়তে পারে। মন্দির পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা কমে যাওয়া নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্থানীয়দের একাংশ।
বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক মাথাচাড়া দিতে গত ৪ অগস্ট সুপ্রিম কোর্ট জানায়, বৃন্দাবনে বাঁকে বিহারী মন্দিরের ব্যবস্থাপনা গ্রহণের বিষয়ে ‘তাড়াহুড়ো’ করছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সমালোচনাও করে শীর্ষ আদালত।
এর পর গত ১৩ আগস্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বাঁকে বিহারী মন্দির ট্রাস্ট বিল, ২০২৫ পেশ করা হয়। বিল অনুযায়ী, বৃন্দাবনের ১৫০ বছরের পুরনো কৃষ্ণ মন্দিরের জন্য ১১ জন মনোনীত এবং সাত জন পদাধিকারবলে সদস্য-সহ সরকার-নিযুক্ত অছিদের একটি পরিষদ গঠন করা হবে।
যদিও বর্তমানে মন্দিরের পরিচালনাকারী সেবায়েত গোস্বামী পুরোহিতদের অভিযোগ, বিলটি মন্দিরের অর্থ এবং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ দখলের একটি প্রচেষ্টা মাত্র। এই নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত।
জানা গিয়েছে, প্রস্তাবিত করিডর তৈরির জন্য রাজ্য সরকার মন্দিরের চারপাশে পাঁচ একর জমি অধিগ্রহণ করতে চলেছে। বর্তমানে ওই এলাকায় প্রায় ৩০০টি মন্দির এবং বাড়ি রয়েছে। বহু বছর ধরে ওই বাড়িগুলিতে মানুষের বসবাস। তবে সরকার করিডর তৈরি করলে সেই বাড়িগুলির কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।