মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ় ‘ভয়: দ্য গৌরব তিওয়ারি মিস্ট্রি’। অ্যামাজ়ন এবং এমএক্স প্লেয়ারে যৌথ ভাবে মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ়টি। ভূত বিশেষজ্ঞ গৌরব তিওয়ারির জীবন এবং মৃত্যুরহস্য নিয়ে সিরিজ়টি ইতিমধ্যেই হইচই ফেলেছে। ভয় ধরিয়েছে দর্শকের মনে।
কিন্তু কে এই গৌরব? গৌরব ছিলেন ভারতের প্রথম ‘প্যারানরমাল’ তদন্তকারী। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ে আগ্রহ ছিল গৌরবের। কিন্তু সম্পন্ন পরিবারের ছেলে গৌরবকে বিদেশে পাঠানো হয় পাইলট হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানেই ঘুরে যায় গৌরবের জীবনের মোড়। দিল্লির ছেলে গৌরব হয়ে ওঠেন ‘ভূতশিকারি’। গৌরবের জীবন এবং মৃত্যু— উভয়ই ছিল রহস্যাবৃত। ২০১৬ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে বাড়ির স্নানঘরে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় গৌরবের।
বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিকের ছেলে গৌরবের জন্ম ১৯৮৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তাঁকে আমেরিকার টেক্সাসে পাঠানো হয়েছিল বিমানচালনার প্রশিক্ষণ নিতে। কোর্স চলাকালীন ফ্লরিডায় একটি বাড়িতে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে থাকতেন গৌরব। গৌরবের দাবি, সেখানেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।
গৌরবের দাবি ছিল, তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা ওই বাড়িতে অশরীরীর উপস্থিতি টের পেয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার পর থেকেই গৌরবের মনে ভূত সংক্রান্ত বিষয়ের উপর দুর্নিবার আকর্ষণ জন্মায়। ঠিক করেন, ওই বিষয়ে গবেষণা করবেন।
ভূত সংক্রান্ত গবেষণার কারণে আমেরিকার ‘প্যারানেক্সাস অ্যাসোসিয়েশন’ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন গৌবব। ফ্লরিডার ‘ইনস্টিটিউট অফ মেটাফিজ়িক্যাল সায়েন্স’ও তাঁকে স্পিরিচুয়াল কাউন্সিলর এবং হিপনটিস্টের শংসাপত্র দেয়। ২০০৯ সালে দেশে ফিরে গৌরব তৈরি করেন ‘ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটি’।
বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্র-সহ ভৌতিক বলে পরিচিত ছ’হাজারের বেশি বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিলেন গৌরব। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতেন ব্লগ করে বা টেলিভিশনের পর্দায়। তাঁর দাবি, দেশের অন্যতম ভৌতিক জায়গা বলে পরিচিত ভানগড় দুর্গের ধ্বংসাবশেষে আদপেও অশরীরীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
গৌরবের অভিনব ভাবমূর্তি এবং অভিনয়ের নেশা তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল বিনোদনের দুনিয়াতেও। ‘হন্টেড উইকএন্ড উইথ সানি লিওন’, ‘ভূত আয়া’, ‘ফিয়ার ফাইল্স’-এর মতো টেলিভিশন শোগুলির অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
লেখালেখি ও কাজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলেও গৌরব বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর অ্যালেন টাইলারের বন্ধু ছিলেন তিনি। দু’জনে একসঙ্গে কাজও করেছেন ‘হন্টিং: অস্ট্রেলিয়া’ সিরিজ়ে। পাশাপাশি, ভিন্গ্রহী এবং রহস্যজনক প্রাণী নিয়েও অনুসন্ধিৎসু ছিলেন গৌরব।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই দিল্লির দ্বারকায় নিজের বাড়িতে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় গৌরবের। ‘ভূতশিকারি’র পরিবারের সদস্যদের দাবি ছিল, ওই দিন স্নান করতে ঢুকেছিলেন তিনি। কিছু ক্ষণ পর স্নানঘরে ভিতর থেকে জোরে কিছু পড়ার শব্দ হয়।
এর পর গৌরবকে ডেকেও সাড়া না পেয়ে স্নানঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন তাঁর পরিবারের সদস্যেরা। তাঁরা দেখেন, স্নানঘরের মেঝেয় পড়ে রয়েছে গৌরবের নিথর দেহ। পুলিশে খবর দেওয়া হয়।
পুলিশ আসার পর গৌরবের দেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্মরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। গৌরবের নিথর দেহের গলায় মোটা কালো দাগ ছিল বলে জানিয়েছিলেন তদন্তকারীরা।
গৌরবের অস্বাভাবিক জীবনধারা তাঁর মৃত্যুকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর বাবা পুলিশকে জানান, মৃত্যুর আগে কয়েক দিন গৌরব জানিয়েছিলেন কোনও এক অশুভ শক্তি তাঁর পিছু নিয়েছে।
পরিবারের সদস্যদের দাবি ছিল, অশুভ শক্তির কথা স্ত্রী আর্যাকেও জানিয়েছিলেন গৌরব। কিন্তু আর্যা ভেবেছিলেন তাঁর স্বামীর হয়তো কাজের চাপে এমন ধারণা হচ্ছে।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অবশ্য গৌরবের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই চিহ্নিত করেছিল। যদিও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দাবি ছিল, জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি গৌরবের সঙ্গে। আর্থিক অনটন বা মানসিক অবসাদেরও সম্মুখীন হননি তিনি।
অন্য দিকে পুলিশ জানিয়েছিল, রহস্যমৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল গৌরবের। ভূত সংক্রান্ত কাজ নিয়ে গৌরবের মতান্তর চলছিল তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। এমনকি, গৌরবের মা-বাবাও নাকি ছেলের আজব শখ নিয়ে খুশি ছিলেন না।
পুলিশের দাবি ছিল, মৃত্যুর আগের দিন রাত ১টার সময় বাড়ি ফিরেছিলেন গৌরব। তার পর স্ত্রী এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল তাঁর। সে সব দিক তাঁরা গোপন করতে চেয়েছিলেন বলেই ধারণা পুলিশের। গৌরবের মৃত্যু আত্মহত্যা বলেই স্পষ্ট করেন তদন্তকারীরা।
তবে রহস্যমৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগেও গৌরব স্বাভাবিক ছিলেন বলে মত অনেকের। কারণ রেকর্ড অনুযায়ী, সে দিন সকালে নিজের মেল চেক করছিলেন তিনি। দিন দু’য়েক আগে একটি পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর ছবি বেরিয়েছিল। সেই ছবি পোস্টও করেছিলেন সমাজমাধ্যমে।
তা হলে কী এমন হল, যার ফলে গৌরব আত্মহত্যা করলেন? এই রহস্য রয়ে গিয়েছে রহস্য হয়েই। তবে অনেকের দাবি, গৌরবের মৃত্যু হয়েছিল অপশক্তির হাতে। ভূত নিয়ে খোঁজ চালানোর সময় তাঁর কাজে অসন্তুষ্ট হয়েছিল কোনও প্রেতাত্মা এবং সেই অপশক্তিই খুন করে গৌরবকে। যদিও বিজ্ঞান সে কথা মানে না।
সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘ভয়: দ্য গৌরব তিওয়ারি মিস্ট্রি’ সিরিজ়ে ‘ভূতশিকারি’র অস্বাভাবিক মৃত্যুর দিকেই আলোকপাত করা হয়েছে। সিরিজ়টি তৈরি হয়েছে অভিরূপ ধরের লেখা ‘গোস্ট হান্টার গৌরব তিওয়ারি: দ্য লাইফ অ্যান্ড লেগেসি অফ ইন্ডিয়াজ় ফোরমোস্ট প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর’ বইটি থেকে।