গত ১৩ জুন রাতে ইরানের রাজধানী তেহরান এবং একাধিক পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছিল ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিমান। ওই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল, ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’। ইজ়রায়েলের অভিযোগ ছিল, পরমাণু বোমা নির্মাণের উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালাচ্ছে ইরান। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল ইরান। আর তা নিয়েই সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল।
সাম্প্রতিক ইজ়রায়েলি হামলায় ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেদুন আব্বাসি নিহত হয়েছেন বলে খবর। তাঁকে হত্যা করা হতে পারে শুনে ফেরেদুন এক বার বলেছিলেন, ‘‘যে কোনও মূল্যে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করব আমি।’’ ২০১০ সালে তাঁর উপর এক বার হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি বেঁচে যান। এ বার আর পারেননি।
তবে আব্বাসির মৃত্যু ইরান-সহ অনেকের স্মৃতিতেই উস্কে দিয়েছে আরও এক মৃত্যুর ঘটনা। সেটি ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসেন ফকরিজ়াদেহের মৃত্যু।
ইরানের পরমাণু গবেষণা ও উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষপদে ছিলেন পরমাণু বিজ্ঞানী ফকরিজ়াদেহ। ইরানের যাবতীয় পরমাণু কর্মসূচি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তিনি ইরানের ইসলামিক রেভেলিউশনারি গার্ড কোরেরও অফিসার ছিলেন।
পশ্চিমি গোয়েন্দাদের বিশ্বাস ছিল পরমাণু অস্ত্র তৈরির লক্ষ্যে পরিচালিত ইরানের প্রকল্প, ‘প্রজেক্ট আমাদ’-এর নেপথ্যে মূল মাথা ছিল ফকরিজ়াদেহের। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্ব জুড়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল, গোপনে পরমাণু বোমা তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ইরান এবং এর নেপথ্যে রয়েছেন ফকরিজ়াদেহ। তাঁকে ইরানের ‘রবার্ট ওপেনহাইমার’ও বলা হত।
কিন্তু বহু বছর ধরে পৃথিবীর তাবড় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাছে ফকরিজ়াদেহ ছিলেন শুধুমাত্র একটি নাম। তাঁর নাম ছাড়া আর কোনও তথ্য ছিল না গোয়েন্দাদের কাছে। এমনকি, কোনও ছবিও ছিল না। জনসমক্ষে কোনও ভাষণ বা সাক্ষাৎকারও দিতে দেখা যেত না তাঁকে।
ফকরিজ়াদেহের উপস্থিতি এতটাই ছায়াময় ছিল যে, ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময়ও তাঁর নাম উঠে আসেনি। ফকরিজ়াদেহকে ‘ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জনক’ হিসাবে উল্লেখ করেন পশ্চিমি গোয়েন্দা সংস্থা এবং ইজ়রায়েলি কর্তারা।
ওয়াকিবহাল মহল জানাচ্ছে, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ভেঙে ইরানের পরমাণু গবেষণা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাণ্ডারি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মহসেন ফকরিজ়াদেহ কয়েক বছর ধরেই চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন ইজরায়েলের।
২০১৮ সালে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘‘ওঁর নামটা মনে রাখছি। আপনারাও মনে রাখবেন।’’ সেই সময় থেকেই পরমাণু অস্ত্রপ্রসার বন্ধ করার জন্য ইজ়রায়েল তো বটেই, আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাপ আসতে শুরু করে তেহরানের উপর।
ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সে দেশের অনেক নেতাই ঠারেঠোরে বোঝাতে শুরু করেন, পরমাণু অস্ত্রে ইরানের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার চেষ্টাকে সুনজরে দেখা হচ্ছে না। কিন্তু তার পরেও নিরস্ত হননি ফকরিজ়াদেহ। দেশের প্রধান পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রটির মানোন্নয়নে আরও তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি।
পরমাণু অস্ত্রে দ্রুত শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্য ইরানের ইউরেনিয়াম ভান্ডার বাড়িয়ে তুলতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ফকরিজ়াদেহ। মাথা নোয়াতে রাজি ছিল না তেহরান। তবে আন্তর্জাতিক মহলও বুঝতে পেরেছিল যে ফকরিজ়াদেহের সময় ঘনিয়ে আসছে।
২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর স্ত্রী এবং দেহরক্ষীদের সঙ্গে তেহরানের পূর্বে আবসার্দ শহরে তাঁর ভিলার দিকে যাচ্ছিলেন ফকরিজ়াদেহ। কোভিড অতিমারির কারণে রাস্তাঘাট ফাঁকাই ছিল। প্রায়ই তিনি ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতেন। একটি কনভয়ও যেত তাঁর গাড়ির সঙ্গে। সে দিনও তেমনটাই হয়েছিল।
কিন্তু ফকরিজ়াদেহ জানতেন না, সে দিন রাস্তার ধারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল একটি পিকআপ ট্রাক। এবং ট্রাকের মধ্যে লুকোনো ছিল একটি ৭.৬২ মিমি এফএন ম্যাগ মেশিনগান।
ফাঁকা পিকআপ ট্রাকটি যেখানে রাখা ছিল, তার সামনেই ছিল একটি স্পিডব্রেকার। সেটি দেখে ফকরিজ়াদেহর গাড়ির চালক গতি কমান। তখনই তাঁদের গাড়ির সামনে চলে আসে একটি পথকুকুর। স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ির গতি আরও কমে।
আর তখনই ফকরিজ়াদেহের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলির ফোয়ারা বেরিয়ে আসে পিকআপ ট্রাকে থাকা মেশিনগান থেকে। একের পর এক গুলি ফখরিজাদেহের গাড়ির সামনের অংশে উইন্ডশিল্ডের নীচে আঘাত করে। গাড়িটি ঘুরতে ঘুরতে থেমে যায়।
এর পর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। আবার দ্বিতীয় দফায় গুলি চালানো শুরু হয়। গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। একটি গুলি গিয়ে লাগে ফকরিজ়াদেহের কাঁধে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। গাড়ির দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েন তিনি।
তবে লাভ হয়নি। কিছু ক্ষণ পরেই আরও তিনটি গুলি ফকরিজ়াদেহের মেরুদণ্ডে লাগে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে এত গুলির একটিও পরমাণু বিজ্ঞানীর স্ত্রীর গায়ে লাগেনি। তিনি অক্ষত ছিলেন। যেন পুরোটাই ছিল অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক। কোনও ভুলের অবকাশ রাখা হয়নি।
ওই দিন মোট ১৫টি গুলি ছোড়া হয়েছিল ফকরিজ়াদেহকে লক্ষ্য করে। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ফকরিজ়াদেহের শরীর নিথর হয়ে যায়। তবে এর পরেই আসে চমকানোর পালা।
গুলি থামার পর পিক আপ ভ্যানের দিকে এগিয়ে যান ফকরিজ়াদেহের দেহরক্ষীরা। দেখেন, ট্রাকের মধ্যে রয়েছে শুধু একটি মেশিনগান। কোনও মানুষ নেই। হতবাক হয়ে যান তাঁরা। কী করে বিষয়টি সম্ভব, তা ভাবতে ভাবতেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে এলাকা। টুকরো টুকরো হয়ে যায় ট্রাকটি।
তবে মেশিনগানটি তার আগেই মাটিতে পড়ে যায়। মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অস্ত্রটির বেশির ভাগ অংশই অক্ষত ছিল। ফকরিজ়াদেহের মৃত্যুর খবর পৌঁছোতেই হইচই পড়ে যায় ইরান জুড়ে। শুরু হয় তদন্ত। দেখা যায় পিকআপ ট্রাকটি ছিল উপগ্রহচালিত। মেশিনগানটি ছিল কৃত্রিম মেধার সঙ্গে যুক্ত। বিস্ফোরকও ঠাসা ছিল ট্রাকে। কিন্তু কোনও মানুষ ছিল না। অর্থাৎ, পুরো অভিযানই ছিল স্বয়ংক্রিয়।
ইরানি গোয়েন্দাদের মতে, মেশিনগানটি উপগ্রহের মাধ্যমে অনেক দূর থেকে চালনা করছিলেন অন্য কেউ। আর এ দিকে ‘রোবট স্নাইপার’ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল।
ইরান এই ঘটনার জন্য সরাসরি ইজ়রায়েলকে দায়ী করেছিল। তাদের নিশানায় ছিল আমেরিকাও। দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই বিজ্ঞানী হত্যায় ‘চরম প্রতিশোধ’-এর ডাক দিয়েছিলেন।
দেশের অন্যতম শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী ফকরিজ়াদেহের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নয়া তিক্ততা শুরু হয় ইরান ও ইজ়রায়েলের মধ্যে। ইজ়রায়েল আনুষ্ঠানিক ভাবে ফকরিজ়াদেহের হত্যার দায় কখনও স্বীকার না করলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, এর নেপথ্যে ছিল ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হাত। অনেকের মতে, ২০০৭ সাল থেকেই ফকরিজ়াদেহের উপর নজর রেখেছিল ইজ়রায়েল।
প্রাক্তন মোসাদ প্রধান ইয়োসি কোহেনও পরে পুরো বিষয়ে ইজ়রায়েলের হাত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে স্পষ্ট ভাবে কিছু বলেননি তিনি। মনে করা হয়, মোসাদের চরেরা কয়েক মাস ধরে ফকরিজ়াদেহের উপর নজর রেখেছিলেন। স্বয়ংক্রিয় মেশিনগানের সরঞ্জামগুলি আলাদা আলাদা করে ইরানে পাচার করা হয়েছিল এবং গোপনে পরীক্ষা করা হয়েছিল। এর পর ১৬০০ কিলোমিটার দূর থেকে মোসাদের কোনও চর নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন মেশিনগানটি।
এটি ইতিহাসের অন্যতম আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর হত্যাকাণ্ড ছিল। ইরানের রেভেলিউশনারি গার্ড কোরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলি ফাদাভির মতে, অস্ত্রটি এমন নির্ভুল ভাবে ফকরিজ়াদেহকে লক্ষ্য করে আঘাত হেনেছিল যে, গুলি কেবল তাঁর গায়েই লেগেছিল। ফকরিজ়াদেহের স্ত্রী বা রক্ষীদের কোনও ক্ষতি হয়নি।