Leo Sande Gasnier

থুতু ছেটাতেন জেলকর্তাদের দিকে! এক সিদ্ধান্তে বদলায় জীবন, পাঁচ বছরে মাদক পাচারকারী থেকে সাধক হন তিহাড়ের জেলবন্দি

লিয়ো স্যান্ডে গ্যাসনিয়রের জন্ম নরওয়ের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। অর্থাভাবের কারণে ছোটবেলা থেকেই রোজগারের জেদ মাথায় চেপেছিল তাঁর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে উপার্জনের আশায় ডেনমার্ক পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে কী ভাবে তিহাড় জেলে পৌঁছোন?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৫ ১৮:০৯
Share:
০১ ২২

একজন মানুষের চরিত্র এবং আচরণ হঠাৎ কী ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে সেই মানুষটি যদি এশিয়ার অন্যতম বড় কারাগার তিহাড়ে বন্দি থাকেন! তিহাড় জেলের সে রকমই এক প্রাক্তন বন্দির কথা অনেকেরই অজানা, যিনি সেখানে ঢুকেছিলেন বন্দি হিসাবে, কিন্তু বেরিয়েছিলেন সাধক হয়ে।

০২ ২২

কথা হচ্ছে লিয়ো স্যান্ডে গ্যাসনিয়রকে নিয়ে। ১৯৯৭ সালে মাদক পাচারের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে তিহাড়ে বন্দি হয়েছিলেন নরওয়ের ওই তরুণ। তিহাড়ে তাঁর শুরুটা ছিল খারাপ। অন্য বন্দিদের মানুষ বলেই মনে করতেন না তিনি। বিনা কারণে অভব্য আচরণ করতেন। সহবন্দি থেকে শুরু করে জেলকর্মীদের গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিতেন যখন-তখন।

Advertisement
০৩ ২২

কিন্তু কুখ্যাত সেই জেলে থাকতে থাকতেই পরিস্থিতি বদলায়। তিহাড়ে বন্দি থাকাকালীনই জীবনদর্শন বদলে ফেলেন গ্যাসনিয়র। ‘হিংস্র’ থেকে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে ওঠেন বিদেশি তরুণ। অন্য বন্দি এবং জেল কর্তৃপক্ষের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হন। ডুব দেন আধ্যাত্মিকতার সূক্ষ্ম স্তরে।

০৪ ২২

গ্যাসনিয়রের জন্ম নরওয়ের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। অর্থাভাবের কারণে ছোটবেলা থেকেই রোজগারের জেদ মাথায় চেপেছিল তাঁর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে উপার্জনের আশায় ডেনমার্ক পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।

০৫ ২২

কিন্তু ডেনমার্ক গিয়েও বিশেষ সুবিধা হয়নি গ্যাসনিয়রের। সেখানে কিছু মাদক পাচারকারীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। কম সময়ে প্রচুর আয় করতে তিনিও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ঠিক করেন, নেপাল থেকে মাদক নিয়ে ভারতে পাচার করবেন।

০৬ ২২

কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। ১৯৯৭ সালে তাঁর বিমান দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো গ্রেফতার করে গ্যাসনিয়রকে। প্রায় তিন কেজি মাদক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর কাছ থেকে।

০৭ ২২

গ্রেফতারির সময় গ্যাসনিয়রের বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। জিজ্ঞাসাবাদে মাদক পাচারের কথা স্বীকার করে নেন বিদেশি তরুণ। মামলা দায়ের হয় তাঁর নামে। মামলা চলাকালীন আদালত গ্যাসনিয়রকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছিল।

০৮ ২২

তিহাড়ের তিন নম্বর জেলে ঠাঁই হয় গ্যাসনিয়রের। গ্যাসনিয়রকে যখন প্রথম বিচারাধীন বন্দি হিসাবে তিহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই তিনি বাকি বন্দিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। নাগালে পেলেই তাঁদের গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিতেন।

০৯ ২২

শুধু বিচারাধীন বন্দি বা অপরাধী নয়, সুযোগ পেলে জেলকর্মী এবং কর্তাদের গায়েও থুতু ছেটাতেন গ্যাসনিয়র। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বাজে ব্যবহার করতেন অযথা। শীঘ্রই বিদেশি তরুণকে নিয়ে বাকি বন্দিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর ধারেকাছেও ঘেঁষতে চাইতেন না কেউ।

১০ ২২

এর পর জেল কর্তৃপক্ষের তরফে গ্যাসনিয়রকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে ফল হয় উল্টো। আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন গ্যাসনিয়র।

১১ ২২

তিহাড় কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছিল, বিদেশের জেলে বন্দি হওয়ার কারণে এবং ভারতের ভাষা বুঝতে না পারায় হয়তো হীনম্মন্যতায় ভুগছেন গ্যাসনিয়র। আর তাই রাগের বশে বাকি বন্দিদের গায়ে থুতু ছেটাচ্ছেন তিনি।

১২ ২২

গ্যাসনিয়র মানসিক ভাবে সুস্থ কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন তিহাড় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরীক্ষায় দেখা যায়, গ্যাসনিয়র মানসিক ভাবে সুস্থ। বাকি বন্দিদের তিনি নিচু নজরে দেখতেন। আর সে কারণেই ইচ্ছা করে তাঁদের গায়ে থুতু ছেটাতেন তিনি।

১৩ ২২

এর পর গ্যাসনিয়রের আচরণে পরিবর্তন আনতে তাঁকে কারাগারের যোগকেন্দ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় জেল প্রশাসন। প্রথম কয়েক দিন কিছুতেই সেখানে যেতে চাইতেন না তরুণ। জোর করে যোগব্যায়াম করতে পাঠানো হত তাঁকে। এর পর ধীরে ধীরে যোগে মগ্ন হতে শুরু করেন গ্যাসনিয়র। মন পরিবর্তন হতে শুরু করে তাঁর।

১৪ ২২

জেল কর্তৃপক্ষ দেখেন, কয়েক দিন যোগাভ্যাস করার পরেই অসাধারণ পরিবর্তন দেখা গিয়েছে গ্যাসনিয়রের মধ্যে। খুব শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বেশির ভাগ সময়েই চুপ করে থাকতেন।

১৫ ২২

উদ্বিগ্ন হয়ে আবার গ্যাসনিয়রের মানসিক পরীক্ষা করায় জেল প্রশাসন। দেখা যায়, যোগের কারণে তাঁর আচরণ এবং চরিত্রের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। তাঁর মনে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে আধ্যাত্মিকতা।

১৬ ২২

ধীরে ধীরে সহবন্দি এবং জেলের কর্মী ও কর্তাদের উপর থুতু ফেলার মতো অন্যায্য কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন গ্যাসনিয়র। হিন্দিও শিখতে শুরু করেছিলেন। বাকি বন্দিদের প্রতি তাঁর আচরণও বদলে গিয়েছিল। ব্যবহারের জন্য প্রশংসাও কুড়োতে শুরু করেছিলেন তিনি।

১৭ ২২

গ্যাসনিয়র ভারতে গ্রেফতার হওয়ার পর দীর্ঘ দিন সে বিষয়ে কিছু জানতেন না তাঁর পরিবার। নরওয়ের একটি চ্যানেল খবর পেয়ে তিহাড় পৌঁছোয়। গ্যাসনিয়রের জীবন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে তারা। সেই তথ্যচিত্র যখন নরওয়েতে সম্প্রচারিত হয়, তখন গ্যাসনিয়রকে নিয়ে মাতামাতি পড়ে যায় সে দেশে।

১৮ ২২

গ্যাসনিয়রের কথা নরওয়ের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তিহাড় থেকে তাঁর মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নামেন সাধারণ জনগণ। বিক্ষোভ দেখিয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন তাঁরা। তাঁদের দাবি ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্যাসনিয়রকে ভারতীয় কারাগার থেকে মুক্ত করে নরওয়েতে ফিরিয়ে আনা হোক।

১৯ ২২

গ্যাসনিয়রের মায়ের আর্থিক অবস্থা এমন ছিল না যে, তিনি নরওয়ে থেকে ভারতে এসে তিহাড়ে বন্দি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। কিন্তু গ্যাসনিয়রের জীবনের উপর তৈরি তথ্যচিত্র দেখার পর নরওয়ের মানুষ তাঁর মায়ের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে তুলে দেওয়া হয় গ্যাসনিয়রের মায়ের হাতে।

২০ ২২

২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় জীবন পেয়েছিলেন গ্যাসনিয়র। গ্যাসনিয়রের মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন নরওয়ের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লেন্স স্টলটেনবার্গ। জেল থেকে গ্যাসনিয়রের মুক্তির ব্যাপারে ভারত সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলেছিলেন তিনি। এর পরেই নরওয়ে এবং ভারতের সরকার মিলে তাঁকে তিহাড় থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর মুক্তির আদেশে সই করেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি।

২১ ২২

তিহাড়ে থাকাকালীন হিন্দি নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে ফেলেছিলেন গ্যাসনিয়র। তিনি যখন নরওয়ে ফেরেন তখন তিনি পুরোদস্তুর সাধক। আচার-আচরণ, কথাবার্তা— সব কিছু বদলে গিয়েছিল তাঁর। গড়গড় করে হিন্দি বলতে পারতেন তিনি। চর্চা করতেন যোগ এবং আধ্যাত্মিকতা নিয়ে। নরওয়ের কারাগারগুলিতেও ‘রোল মডেল’ হিসাবে তুলে ধরা হয় গ্যাসনিয়রকে।

২২ ২২

বর্তমানে গ্যাসনিয়র নরওয়েতেই থাকেন। স্ত্রী-পরিবার নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করেন। সমাজ-সংস্কারের কাজকর্মও করেন। অপরাধের দিকে আর পা বাড়াননি। এখনও তিনি স্বীকার করেন, তিহাড়ই বদলে দিয়েছে তাঁকে।

ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement