টানাটানির সংসারে দু’বেলা খাবারের জন্য এক জনকে ঝাড়ুদারের কাজ করতে হয়েছিল। বর্তমানে তিনি ক্রিকেটজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভারতের তারকা ক্রিকেটারও বটে। অন্য জন খেলাধুলোর জগতে বিস্তর নাম করার পর এখন ঝাড়ুদারের কাজ করেন। ঘটনাচক্রে তাঁদের নাম একই, রিঙ্কু সিংহ। তবে বয়সের ফারাক অনেকটাই।
একসময় অভাবের সংসারে টাকা রোজগারের জন্য ক্রিকেটার রিঙ্কুকে ঝাড়ুদারের কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁর দাদা। টাকা উপার্জনের জন্য কাজের দরকার ছিল ঠিকই। কিন্তু ঝাড়ুদার হতে চাননি রিঙ্কু। পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের জোরে তিনি এখন দেশের অন্যতম নামী ক্রিকেটার। ঝাড়ুদার থেকে ক্রিকেটার রিঙ্কু সিংহ যেন রূপকথার নায়ক!
অন্য রিঙ্কু সিংহও রূপকথার নায়ক। উত্তরপ্রদেশের ছোট শহর থেকে উঠে আমেরিকার বেসবল জগতে নাম করেন তিনি। পরে যোগ দেন পেশাদার কুস্তিগিরদের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেনমেন্ট বা ডব্লিউডব্লিউইতে।
ভারতীয়দের মনে ডব্লিউডব্লিউই একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সেই অনুষ্ঠানে ‘দ্য গ্রেট খালি’র মতো কুস্তিগিরদের সাফল্যের কারণে কুস্তির প্রতি ভালবাসা এবং আবেগ আরও বেড়ে গিয়েছে দেশবাসীর। দ্য গ্রেট খালির মতো রিঙ্কুও কিন্তু মাতিয়েছিলেন ডব্লিউডব্লিউইয়ের রিং।
এখন সে সব ছেড়ে মাঝেমধ্যেই ঝাড়ুদারের কাজ করেন রিঙ্কু। তবে স্বেচ্ছায়। আধ্যাত্মিক গুরু প্রেমানন্দজি মহারাজের আশ্রমের বাইরে মাঝেমধ্যেই ঝাঁট দিতে দেখা যায় তাঁকে।
কারণ, বিদেশি কুস্তিগিরদের মনে ভয় ধরানো সেই রিঙ্কু এখন সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসকেই এখন জীবনের ব্রত করে নিয়েছেন তিনি। নিজেকে সঁপে দিয়েছেন প্রেমানন্দজি মহারাজের কাছে।
১৯৮৮ সালের ৮ অগস্ট উত্তরপ্রদেশের ভাদোহি জেলার গোপীগঞ্জে রাজপুত ক্ষত্রিয় পরিবারে রিঙ্কুর জন্ম। রিঙ্কুর বাবা ছিলেন এক জন ট্রাকচালক। বাবা-মা এবং নয় ভাইবোনের সঙ্গে এক কামরার বাড়িতে থাকতেন রিঙ্কু। বড় হওয়ার সময় দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।
তবে ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয় আগ্রহ ছিল রিঙ্কুর। জ্যাভলিন এবং ক্রিকেট খেলতেন খুবই ভাল। জ্যাভলিনে জাতীয় স্তরে পদকও জিতেছিলেন তিনি।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে লখনউয়ের গুরু গোবিন্দ সিংহ স্পোর্টস কলেজে ভর্তি হন রিঙ্কু। আর তার পরেই ভাগ্য বদলে যায় তাঁর। ২০০৮ সালে টেলিভিশন শো ‘দ্য মিলিয়ন ডলার আর্ম’-এ অংশ নেন রিঙ্কু। জেতেন সেই প্রতিযোগিতা। আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পান।
৮৭ মাইল প্রতি ঘণ্টায় বেসবল ছুড়ে ওই প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন রিঙ্কু। হারিয়েছিলেন ৩৭ হাজারেরও বেশি প্রতিযোগীকে। প্রতিযোগিতার পুরস্কারমূল্য ছিল ১,০০,০০০ ডলার।
‘দ্য মিলিয়ন ডলার আর্ম’ জিতে আমেরিকার বেসবল লিগে প্রবেশ করেন রিঙ্কু। ২০০৯ সালে পিটসবার্গ পাইরেটস দলের সদস্য হিসাবে পেশাদার বেসবল কেরিয়ার শুরু করেন।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই লিগে খেলা প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন রিঙ্কু। ২০১৬ পর্যন্ত আমেরিকার পেশাদার বেসবল খেলেন তিনি।
ডব্লিউডব্লিউইতে রিঙ্কুর যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে। ওই অনুষ্ঠানে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘বীর মহান’ নামে। ‘দ্য ইন্ডাস শের’ নামের একটি দলে ভারতীয় কুস্তিগির সৌরভ গুর্জরের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন তিনি। পরে কুস্তিগির জিন্দর মহলও সেই দলে যোগ দেন।
ডব্লিউডব্লিউইতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন রিঙ্কু। বেশ কয়েক জন নামকরা তারকাকে হারিয়েছিলেন তিনি।
এর পর স্বাধীন কুস্তিগির হিসাবে ডব্লিউডব্লিউইয়ের ‘র’-তে যোগ দিয়েছিলেন রিঙ্কু। সেখানেও বিশিষ্ট কুস্তিগিরদের পরাজিত করে ভারতীয় ভক্তদের মন জয় করেছিলেন। সম্পূর্ণ ভারতীয় পোশাকে কপালে তিলক কেটে এবং বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা পরে রিংয়ে নামতেন তিনি।
তবে ডব্লিউডব্লিউইতে সাফল্য পাওয়ার পরেও সেই কেরিয়ার ছেড়ে দেন রিঙ্কু। ঝোঁকেন আধ্যাত্মিকতার দিকে। প্রেমানন্দজি মহারাজের কাছে নিজেকে সঁপে দেন। রিঙ্কু জানিয়েছিলেন, প্রেমানন্দজির কথা শোনার পরেই তাঁর মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। সন্ন্যাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রিঙ্কু এক বার এক সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘‘প্রেমানন্দজি মহারাজের আশ্রয়ে আসার পর আমি জীবনে নতুন করে শান্তি এবং তৃপ্তি পেয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে জীবনের আসল উদ্দেশ্য আত্মোপলব্ধি এবং ঈশ্বরের সেবার মধ্যে নিহিত।’’
রিঙ্কুর আধ্যাত্মিক জীবন এখন এক নতুন দিকে এগোচ্ছে। কেবল দেশেই নয়, বরং বিশ্ব জুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা প্রচার করছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কেবলমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা বোঝার মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি প্রকৃত শান্তি এবং সাফল্য অর্জন করতে পারেন।’’
সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশের অনেক আগে থেকেই নিরামিষ খাবার খান রিঙ্কু। ২০১২ সালে ভাদোহিতে কয়েক জনকে একটি মুরগিকে মারার জন্য তাড়া করতে দেখেন রিঙ্কু। এর পরেই নিরামিষাশী হন তিনি।