কাজ শুরু করেছিলেন মাত্র ৪ বছর বয়সে। একসময় বলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া শিশু তারকা ছিলেন তিনি। অভিনয় করেছিলেন রাজ কপূর, আশা পারেখ থেকে বলিউডের বহু বৈগ্রহিক অভিনেতার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর জীবন ছিল কণ্টকময়। জন্মদাত্রী মায়ের হাতেও অত্যাচারিত হতে হয়েছিল তাঁকে। ৫১ বছর বয়সে যখন তিনি মারা যান, তখন বলিউডের কেউ তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দেননি।
কথা হচ্ছে হিন্দি চলচিত্র জগতের এক সময়ের জনপ্রিয় শিশুশিল্পী সালমা বেগের, যিনি পর্দায় পরিচিত পেয়েছিলেন ‘বেবি নাজ়’ নামে।
১৯৪৪ সালে মুম্বইয়ে জন্ম সালমার। খুব ছোটবেলায় হিন্দি চলচ্চিত্রজগতে শিশুশিল্পী হিসাবে পা রাখেন তিনি। পর্দার নাম হয় নাজ়। দ্রুত হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় শিশুশিল্পীদের একজন হয়ে ওঠেন তিনি। এমনকি, এক সময় শিশুশিল্পী হিসাবে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকও তিনিই পেতেন।
তবে খ্যাতি যেমন এসেছিল সালমার জীবনে, তেমনই সমস্যাও এসেছিল প্রচুর। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, সালমার কেরিয়ার এবং শৈশব নষ্ট হয়েছিল তাঁর মায়ের অত্যাচারে। সালমার বাবা মির্জ়া দাউদ বেগ ছিলেন লেখক। তাঁর আয়ের কোনও ঠিক ছিল না। আর সে কারণে চরম অর্থকষ্টের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁদের।
সালমার সংগ্রাম শুরু মাত্র চার বছর বয়সে। জোর করে সালমাকে নাচের মঞ্চে ঠেলে দিয়েছিলেন তাঁর মা। অনুষ্ঠান করে তৎকালীন দিনে প্রায় একশো টাকা করে আয় করতেন সালমা, যা পরিবারের জীবনযাপনের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছিল।
প্রথম প্রথম নাচ উপভোগ করতেন সালমা। তখনও জানতেন না যে ধীরে ধীরে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষে পরিণত হচ্ছেন তিনি। এর পর নাচ ছেড়ে শিশুশিল্পী হিসাবে সিনেমা জগতে পা দেন সালমা। কারণ, সেই পেশাতেই লাভ দেখেছিলেন তাঁর মা।
সালমা এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন, তাঁকে ছোটবেলা থেকেই শোষণ করেছিলেন তাঁর মা। অর্থের জন্য ব্যবহার করেছিলেন ইচ্ছামতো। মায়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
সালমার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সুইৎজ়ারল্যান্ডের একটি স্কুলে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন জনপ্রিয় বলি নায়ক-পরিচালক রাজ কপূর। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন সালমার মা।
পরিবর্তে, তাঁকে দিয়ে একের পর এক কাজ করানোর সিদ্ধান্ত নেন। সালমাকে জিজ্ঞাসা না করেই নাকি তাঁর মা কাজ ধরে নিতেন। ফলে শৈশবে খেলাধুলোর বিশেষ সুযোগ পাননি তিনি। তাঁর দিন কাটত ‘লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন’ শুনেই।
সালমা জানিয়েছিলেন, চার বেলা উদয়াস্ত পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরেও শান্তি পেতেন না। মা-বাবার ঝগড়া দেখতে হত তাঁকে। বহু রাত নাকি তাঁকে অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে হয়েছিল। এমনকি, এক গ্লাস দুধও তাঁর হাতের কাছে কেউ ধরেনি। অথচ তাঁর টাকাতেই চলছিল সংসার।
শিশুশিল্পী হিসাবে সালমার কেরিয়ার যখন আকাশ ছুঁতে শুরু করেছিল, তখন তাঁর মা এক ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ঘর থেকে বার করে দেন বাবা মির্জ়াকে। এর পরের দু’বছর বাবার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না সালমার।
অন্য দিকে, সেই সময়ই ‘আরকে স্টুডিয়ো’ প্রযোজিত ‘বুট পলিশ’-এর মতো ছবিতে সালমার অভিনয় প্রশংসিত হতে শুরু করে। কান চলচ্চিত্র উৎসবেও বিশেষ সম্মান পান তিনি।
‘বুট পলিশ’ ছবিতে পথশিশুর চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচক এবং দর্শক— উভয়ের নজর কেড়েছিলেন সালমা। দিলীপ কুমার এবং নার্গিস-সহ সেই সময়ের শীর্ষস্থানীয় তারকাদের সঙ্গে ‘দেবদাস’ ছবিতে অভিনয় করেও প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি। এর পর শিশুশিল্পী হিসাবে বহু সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সালমা।
হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছোটবেলায় দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টাও নাকি করেছিলেন সালমা। কিন্তু দু’বারই বাড়ির পরিচারক তাঁকে বাঁচিয়ে দেন। বিষয়টি জানাজানির পর উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিবর্তে সালমাকে নাকি ব্যাপক মারধর করেছিলেন তাঁর মা।
সালমা এ-ও অভিযোগ করেছিলেন, মায়ের প্রেমিকও তাঁর উপার্জন ওড়াচ্ছিলেন। ওই ব্যক্তি তিন মেয়ের বিয়েও নাকি দিয়েছিলেন তাঁর কষ্টার্জিত টাকাতেই। যদিও সব কিছু জেনেও চুপ ছিলেন সালমা।
অনেক শিশুশিল্পীর মতোই সালমাও বড় হ়য়ে নায়িকার মতো আত্মপ্রকাশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তেমনটা হয়নি। শুরু হয় তাঁর সংগ্রাম। হিন্দি ছবিতে শ্রীদেবী-সহ দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রীদের জন্য ‘ভয়েস ডাব’ করে আয় করা শুরু করেছিলেন সালমা। শোনা যায়, সালমা অন্য অভিনেত্রীদের জন্য গলা দিতে শুরু করার পর শ্রীদেবী তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।
যদিও সালমা অবিচল ছিলেন। সেই সময় বোম্বে দূরদর্শনেরও কাজ করেছিলেন সালমা। সালমার স্বামী সুব্বিরাজও ছিলেন অভিনেতা। কপূর পরিবারের দূরসম্পর্কের আত্মীয় সুব্বিরাজ নিজেও ডাবিংয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
অনেক দিন পর্যন্ত হিন্দি ছবিতে নায়িকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন সালমা। কিন্তু শৈশবের খ্যাতি কোনও দিন আর ফিরে পাননি তিনি। ৩০ বছর হিন্দি সিনেমা জগতে কাটানোর পরেও তাঁকে কাজ দিতে রাজি হননি কেউ। সাক্ষাৎকারে তেমনটাই জানিয়েছিলেন সালমা।
সালমার শেষ জীবন ছিল আরও কষ্টের। নিয়মিত তামাক খেতেন তিনি। ফলে কম বয়সেই শরীরে বিভিন্ন রোগ ধরে তাঁর। পরবর্তী কালে অবস্থা আরও খারাপ হয়। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। কোমায় চলে যান তিনি। ১৯৯৫ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা যান সালমা।
দীর্ঘ দিন বলিপাড়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সালমা। কাজ করেছিলেন নামীদামি অনেক পরিচালক-অভিনেতাদের সঙ্গে। কিন্তু বলিউডের কেউ তাঁর শেষকৃত্যে হাজির হননি বলেই শোনা যায়।