বক্সঅফিসে ইতিমধ্যেই ঝড় তুলেছে রণবীর সিংহ অভিনীত ‘ধুরন্ধর’। আদিত্য ধর পরিচালিত ছবিতে উঠে এসেছে পাকিস্তানের লিয়ারি শহরের কথা। সে শহরে কী ভাবে গ্যাংস্টারদের মধ্যে কোন্দল চলত এবং কী ভাবে এক ভারতীয় গুপ্তচর শহরের সব হিসাব উল্টেপাল্টে দেবে তা-ই দেখানো হয়েছে ছবিতে।
‘ধুরন্ধর’ এই বছরের বহুল প্রতীক্ষিত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সেই ছবি। অন্তত তেমনটাই দাবি করা হয়েছে ছবির নির্মাতাদের তরফে। সিনেমায় বাস্তবের কিছু ঘটনা রয়েছে। ছবির চরিত্রগুলির সঙ্গেও বাস্তবের কিছু মানুষের মিল পাওয়া গিয়েছে।
লিয়ারি শহরের গ্যাংস্টারদের দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা দখলের লড়াইকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ‘ধুরন্ধর’-এর গল্প। ছবিতে মারকাটারি কিছু দৃশ্য দেখা গিয়েছে, যা দেখে চমকে গিয়েছেন দর্শক।
তবে বাস্তবের লিয়ারি ছিল আরও ভয়ঙ্কর, আরও হিংস্র। রক্তগঙ্গা বইতেই থাকত করাচির কাছের সেই শহরে।
লিয়ারি শহর দীর্ঘ দিন ধরে পরিচিত তার ‘দ্বৈত’ চরিত্রে জন্য। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শহরটি পরিচিত ‘করাচির মা’ নামে। শ্রমিক, ট্রাকচালকদের আধিক্য থাকা এই শহরে জনপ্রিয় বক্সিং এবং ফুটবলের মতো খেলা। ফুটবলের জনপ্রিয়তার জন্য পাকিস্তানের ‘মিনি ব্রাজ়িল’ তকমাও পেয়েছিল সেই শহর।
পাকিস্তানের পুরোনো শহরগুলির মধ্যে অন্যতম লিয়ারি। ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে লিয়ারি হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’। সশস্ত্র গ্যাং, অপরাধীদের রমরমা, মাদক এবং তোলাবাজির গড় হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল সেই শহর।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ঔপনিবেশিক আমলে ডক শ্রমিকদের একটি ছোট বসতি লিয়ারি কী ভাবে ১৯৮০ এবং তার পরে গ্যাংস্টারদের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছিল?
৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লিয়ারি শহরে প্রথমে মূলত মাকরানি-বালোচদের বসতি ছিল। সেখান থেকে পরে কচ্চি, তার পর উর্দুভাষী মুহাজ়ির এবং আরও পরে পঠানদের বসতিতে পরিণত হয় লিয়ারি।
ফার্সি লেখক লরেন্ট গায়ারের লেখা অনুযায়ী, লিয়ারির নাম ‘লিয়ার’ থেকে এসেছে। কবরের মাটিতে যে ফুল ফোটে তাকে লিয়ার বলে। অনেকের আবার দাবি, লিয়ারি নদীর নাম থেকে ওই শহরের নামকরণ হয়েছে।
লিয়ারি পরে ‘লিয়ারি টাউন’ নামে পরিচিত হয়। কংক্রিটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয় শহরটিকে। লিয়ারিকে ‘করাচির মা’ বলার কারণ সেটি পাকিস্তানের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি। করাচির চেয়েও পুরোনো সেই শহর।
১৭০০ সালের গোড়ার দিকে জেলেদের ছোট্ট গ্রাম হিসাবে যাত্রা শুরু করে লিয়ারি। উপকূলীয় মৎস্যজীবী, আরব সাগর, নৌকা, জাল, বাণিজ্য— এ সব নিয়েই থাকত লিয়ারি। ১৮৩০-এর দশকে তপলুর বালোচ শাসকদের পরাজিত করতে সেখানে এসে পৌঁছোয় ব্রিটিশেরা।
ব্রিটিশেরা এসে লিয়ারি এবং কাছাকাছি এলাকার ভোল একেবারে পাল্টে দেয়। করাচির গুরুত্ব বাড়ে। ১৮৫০-এর দশকে করাচি বন্দরের আধুনিকীকরণ করা হয়। বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমকেন্দ্রে পরিণত হয় লিয়ারি। মৎস্যজীবীদের সেই শহরে ভিড় বাড়তে থাকে ডক শ্রমিক এবং কুলিদের। শহরের জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়, ব্যস্ততাও বাড়ে (পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে লিয়ারিতে প্রতি হেক্টরে মাত্র ২৫০ জন বাস করতেন। ২০১০ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে ১,১৮০ এবং ২০২৩ সালের মধ্যে ১,৫৮৩ হয়েছে)।
ধীরে ধীরে সেই বন্দরে মাকরান উপকূল থেকে আসা বালোচদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বন্দরটি মূলত সচল রাখতেন বালোচরাই। তাঁরা থাকতে শুরু করেন কাছের লিয়ারি শহরে। বন্দরের জন্য লিয়ারিতে বালোচদের পাশাপাশি ধীরে ধীরে পঞ্জাবি, কচ্চি, সিন্ধি, সিদ্দি এবং পশতুনদের ভিড় বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ঘরবাড়ি এবং সঙ্কীর্ণ গলিপথের সংখ্যাও।
এলোমেলো ভাবে বসতি তৈরির কারণে লিয়ারির পাড়াগুলির ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল একসময়। পয়ঃনিষ্কাশন এবং জলের সুবিধা ছিল না সেখানে। শ্রমিকদের থাকার কারণেও জায়গাটি নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না ব্রিটিশদের। তাদের মূল আকর্ষণ ছিল করাচি শহর এবং বন্দর। ফলে লিয়ারিবাসীদের জীবন ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে ইরানের শাসক রেজা শাহ পাহলভি ইরানি বালোচিস্তান আক্রমণ করার পর আরও অনেক বালোচ পুরুষ, মহিলা এবং শিশু করাচি চলে যান। তাঁদেরও ভিড় গিয়ে জমা হয় সেই লিয়ারিতে।
এর পর ১৯৪৭ সালে দেশভাগ আঘাত হানে। স্বাধীনতা লাভ করে ভারত। পৃথক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে পাকিস্তান। লিয়ারি যায় পাকিস্তানে। করাচি হয় পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী।
সে সময় ভারত থেকে আসা উর্দুভাষী মুহাজ়িরদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে করাচিতে। তাঁদের একাংশ লিয়ারিতেও চলে যান। সকলকেই ঠাঁই দেয় ‘করাচির মা’। তবে ভিড়ের চাপে লিয়ারির অবস্থা আরও কঠিন হয়ে উঠেছিল। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি আরও সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়তে থাকে পরিকাঠামো।
দেশভাগের পরের দশকগুলিতে ধীরে ধীরে লিয়ারির ভাগ্য পরিবর্তিত হতে শুরু করে। তবে সৌভাগ্য নয়, এসেছিল দুর্ভাগ্য। কার্যত বস্তিতে পরিণত হয়েছিল লিয়ারি। দারিদ্র এবং মৌলিক পরিষেবার অভাবের ফলে ক্ষোভ বাড়তে শুরু করে স্থানীয়দের মধ্যে। এরই মধ্যে উত্তর থেকে আরও পশতুন এসে জোটেন সেখানে।
লিয়ারির সেই দুর্বিষহ অবস্থাতেই ১৯৬০-এর দশকে জন্ম হয় কালা নাগ এবং দালাল নামে শহরের দুই গ্যাংয়ের। তবে গ্যাংগুলি স্থানীয়দের ক্ষতি খুব কমই করত। এদের কারবার ছিল মূলত মাদকের।
১৯৭০-এর দশকে পাকিস্তান পিপল্স পার্টি (পিপিপি)-র নেতা তথা প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টোর নজর পড়ে লিয়ারিতে। প্রচারের জন্য মাঝেমধ্যেই সেখানে আসতেন তিনি। এমনকি, কন্যা বেনজির ভুট্টোর বিয়ের একটি অনুষ্ঠানও লিয়ারির মাঠে আয়োজন করেছিলেন জুলফিকর। স্থানীয়েরাও জুলফিকরকে লিয়ারির ‘ভাগ্যবিধাতা’ হিসাবে দেখতে শুরু করেন। লিয়ারির মানুষেরা সম্মান করতেন তাঁকে। তখন থেকেই লিয়ারি পিপিপির শক্ত ঘাঁটি।
তার পর এল ১৯৭৯ সাল। ক্ষমতায় তখন পাক সেনাকর্তা জ়িয়া উল হক। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঘরছাড়া পঠানরা লিয়ারিতে জড়ো হন। সঙ্গে নিয়ে আসেন বন্দুক। পাকিস্তানের প্রাণকেন্দ্র করাচিতে বৃদ্ধি পায় মাদক ব্যবসা। প্রভাব পড়ে লিয়ারিতেও।
মাদক পাচার এবং বিক্রির লাভ দেখে অনেকেরই মাথা ঘুরে গিয়েছিল। সেখান থেকেই লিয়ারি এবং সংলগ্ন এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে ছোটবড় বেশ কয়েকটি গ্যাং। মাদক ব্যবসার পাশাপাশি শুরু হয় তোলাবাজি, অপহরণ, খুনের মতো অপরাধের রমরমা। ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে গ্যাংগুলির মধ্যে প্রায়ই সংঘাত বাধত।
১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে লিয়ারির গ্যাংগুলি স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)-সমর্থিত কুখ্যাত গ্যাংস্টার আরশাদ পাপ্পুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উজাইর বালোচ এবং রেহমান ডাকাতের মতো কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের সমর্থন করে পিপিপি। কিছু এলাকায় দখল দুর্বল হয়ে পড়লেও রেহমান ডাকাতের দল ‘পিপল্স অমন কমিটি’র সমর্থনে লিয়ারিতে পিপিপির ঘাঁটি দুর্বল হয়নি কোনও দিন।
ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে হিংসা এবং গ্যাংযুদ্ধের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছিল লিয়ারি। গ্যাংগুলির মধ্যে সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয়ে উঠত লিয়ারি। প্রাণ যেত সাধারণ মানুষেরও।
একসময় লিয়ারি থেকে অপরাধ এবং হিংসা সারা করাচিতে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত লিয়ারির গ্যাংযুদ্ধে ৩,২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে গ্যাংগুলিকে শান্ত করতে হাত শক্ত করে প্রশাসন। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করেও অনেক গ্যাংস্টারের মৃত্যুও হয়।
২০১২ সালে চাপের মুখে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও রেহমান ডাকাতের ‘পিপল্স অমন কমিটি’র প্রতি সমর্থন ত্যাগ করতে বাধ্য হয় পিপিপি। সরকার পাকিস্তান রেঞ্জার্স এবং করাচি পুলিশ মোতায়েন করে ১,০০০ জনেরও বেশি গ্যাংস্টারকে গ্রেফতার করে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই অভিযান অব্যাহত ছিল।
বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। গ্যাং তৈরির পরিবর্তে নতুন প্রজন্ম মেতেছে ফুটবল, বক্সিং, জিম, থিয়েটার, সঙ্গীতচর্চা নিয়ে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলিতে গ্যাংস্টারদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হলেও পাকিস্তানকে অনেক প্রথিতযশা খেলোয়াড় এবং শিক্ষাবিদও উপহার দিয়েছে লিয়ারি। তাঁদের মধ্যে বক্সার হুসেন শাহ, ফুটবলার উমর বালোচ, গোলাম আব্বাস এবং উস্তাদ কাসিম ও শিক্ষাবিদ ওয়াজা গোলাম মুহাম্মদ নুরউদ্দিন অন্যতম।