ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে কিনে নিতে চলেছে জনপ্রিয় অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স! গত কয়েক দিনে এমন খবরে হইচই পড়েছিল আমেরিকার বিনোদন দুনিয়ায়। শোনা যাচ্ছিল ৮৩০০ কোটি ডলারের চুক্তিতে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের মালিকানা হস্তান্তর হতে চলেছে নেটফ্লিক্সের কাছে। কিন্তু সেই চুক্তি এখনও অনিশ্চিত।
কারণ, ওয়ার্নার ব্রাদার্স এবং নেটফ্লিক্সের চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে প্যারামাউন্ট স্কাইডান্সের মতো প্রভাবশালী বিনোদন সংস্থা। আমেরিকার বিনোদন জগতে ঝড় তোলা চুক্তির খবরে লেগেছে রাজনৈতির রংও। আসরে নেমেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প!
এই নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত গত সপ্তাহ থেকে। শোনা যাচ্ছিল, নেটফ্লিক্সের অধীনে চলে আসবে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের এইচবিও ম্যাক্স, এইচবিও এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলি। সেখানেই এ বার থেকে দেখা যাবে, ‘হ্যারি পটার’, ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর মতো জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি।
এই হস্তান্তরের ফলে হলিউড ও সেখানকার মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি নতুন রূপ পাবে বলে মনে করা হচ্ছিল। তবে বিশ্লেষকদের একাংশ এ-ও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এতে হলিউডের ভোল বদলে যেতে পারে। হলের মুখ দেখতে না-ও পেতে পারে অনেকে সিনেমা। সেগুলি সরাসরি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেতে পারে।
হলিউডের অনেক অভিনেতা, পরিচালক এবং লেখক সিনেমাহলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। অনেক গ্রাহক আবার সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, নেটফ্লিক্সের হাতে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের মালিকানা এলে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সাবস্ক্রিপশন মডেলে পরিবর্তন আসতে পারে বলে। হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে সাবস্ক্রিপশনের অঙ্ক।
যদিও চুক্তির খবরের প্রাথমিক পর্যায়ে নেটফ্লিক্সের সিইও টেড সারানডোস বলেন, ‘‘ওয়ার্নার ব্রাদার্সের শো এবং সিনেমার ভান্ডার ও নেটফ্লিক্সের ‘ফ্রেন্ডস’-এর মতো সিরিজ় একত্রিত করে আমরা দর্শকের কাছে তাদের পছন্দের বিনোদন আরও বেশি করে পৌঁছে দিতে পারব।” আগামী দিনে নেটফ্লিক্সকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এই চুক্তি একটি ‘বিরল সুযোগ’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সেই চুক্তি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিবৃতি প্রকাশ করেছে নেটফ্লিক্স। গ্রাহকদেরও ইমেল করে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের স্টুডিয়ো কেনার কথা জানানো হয়েছে। তবে আসল কথা হল, চুক্তিটি এখনও সম্পন্ন হয়নি এবং তা সম্পন্ন হতে এখনও বেশ কিছুটা সময় লাগবে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞেরা। অনেকের আবার অনুমান, চুক্তি শেষমেশ হবে না। হতে দেবেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প।
কিন্তু কেন? নেটফ্লিক্স এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্সের চুক্তির মধ্যে এখনও একাধিক বাধা রয়েছে। প্রথমত, আমেরিকা এবং ইউরোপ— উভয় দেশের নিয়ন্ত্রক এবং রাজনীতিবিদ, যাঁরা চুক্তিটি অনুমোদন করবেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, ওই দুই চুক্তির মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তৃতীয়ত, ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে নিজেদের দখলে আনতে এখনও চেষ্টা চালাচ্ছে প্যারামাউন্ট স্কাইডান্সের মতো তাবড় বিনোদন সংস্থা।
রবিবার সস্ত্রীক ‘কেনেডি সেন্টার অনার্স’ পুরস্কার বিতরণে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানেই তাঁকে ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে অধিগ্রহণের জন্য নেটফ্লিক্সের প্রচেষ্টার বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। উত্তরে ট্রাম্প বলেন, ‘‘স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স ইতিমধ্যেই বিনোদনের বাজারের বড় অংশীদার।’’ চুক্তিটি সমস্যায় পরিণত হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
তিনি নিজে এই চুক্তিতে সরাসরি যুক্ত থাকবেন বলেও রবিবার মন্তব্য করেন ট্রাম্প। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কথায়, ‘‘আমি নিজে এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত থাকব।’’
কয়েক দিন আগে ওভাল অফিসে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছিলেন নেটফ্লিক্সের সিইও টেড। সে প্রসঙ্গেও রবিবার কথা বলেন মার্কিন প্রসিডেন্ট। ট্রাম্প বলেন, ‘‘টেডি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা কাজ করেছেন।’’
কিন্তু কেন নেটফ্লিক্সের চুক্তিতে নাক গলাচ্ছেন ট্রাম্প? বিনোদন দুনিয়ার ব্যবসায়িক কোনও চুক্তি তাঁর পাকা ধানে কোন মই দিয়েছে? আপাতত এই প্রশ্নই ঘোরাফেরা করছে অনেকের মনে।
যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, বিনোদন দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়া এই চুক্তিতে নিজেকে রেখে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করতে চাইছেন ট্রাম্প। কেবলমাত্র নিজেকে খবরে রাখতেই তাঁর এই প্রয়াস।
নেটফ্লিক্স এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্সের চুক্তি নিয়ে খুশি নয় প্যারামাউন্টও। চুক্তিটি ন্যায্য ভাবে হচ্ছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিনোদন সংস্থাটি।
প্যারামাউন্ট মালিকানা সম্প্রতি কিনেছেন ল্যারি এলিসন। বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী ব্যক্তির তালিকায় ইলন মাস্কের পরেই রয়েছেন ওরাকল সংস্থার মালিক ল্যারি। এলিসনের ছেলে ডেভিড, স্কাইড্যান্স স্টুডিয়োর মালিক।
ট্রাম্পের সঙ্গেও এলিসনের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ট্রাম্পকে এলিসন সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন বলেও খবর। তাই অনেকের দাবি, আমেরিকার প্রেসিডেন্টও চান ওয়ার্নার ব্রাদার্সের স্টুডিয়োর মালিকানা এলিসন-পুত্র ডেভিডের কাছেই যাক। আর সে কারণেই ওই চুক্তি নিয়ে অত সক্রিয় হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প।
অন্য এক দলের দাবি, নেটফ্লিক্স সিইও টেড বছরের পর বছর ধরে বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিন্টন এবং জো বাইডেন-সহ ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিবিদদের লক্ষ লক্ষ ডলার অনুদান দিয়েছেন।
সে বিষয়টি নাকি মোটেও ভাল চোখে দেখেননি ট্রাম্প। আর সে কথা মাথায় রেখেই তিনি নেটফ্লিক্স এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্সের চুক্তি হতে দেবেন না বলে মনে করা হচ্ছে।
নেটফ্লিক্স এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম স্ট্রিমিং কোম্পানি, যার গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। অন্য দিকে ওয়ার্নার ব্রাদার্স হলিউডের অন্যতম বড় প্রযোজনা সংস্থা। ওয়ার্নার ব্রোস স্টুডিয়ো, সিএনএন, ডিসকভারি, টিবিএস এবং টিএনটি, এইচবিও এবং এইচবিও ম্যাক্সের মালিকানা রয়েছে সংস্থাটির হাতে।
তবে ২০২২ সালের এপ্রিলে ডিসকভারি এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্স এক হওয়ার পর ওয়ার্নার-ডিসকভারি কর্পোরেশন বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে বাজার থেকে।
চলতি বছরের শুরুতে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের তরফে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, তাদের ব্যবসায় লাভ ক্রমশ কমছে। ওয়ার্নার ব্রাদার্স স্টুডিয়ো, এইচবিও এবং স্ট্রিমিং পরিষেবা এইচবিও ম্যাক্স বিক্রি করে দিতে চায় তারা।
এর পরেই ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ওই সংস্থাগুলি কিনতে ঝাঁপায় প্যারামাউন্ট, কমকাস্ট এবং নেটফ্লিক্স-সহ একাধিক সংস্থা। তবে শেষমেশ বাকিদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় নেটফ্লিক্স। ৮৩০০ কোটি ডলারের চুক্তিও মোটামুটি পাকা হয়েছে। শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রকদের অনুমোদন বাকি। কিন্তু তার মধ্যেই এ বার সেই চুক্তিতে ঢুকে যেতে দেখা গেল মার্কিন প্রেসিডেন্টকে।