পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ভারতীয় নেটপ্রভাবী ইউটিউবার জ্যোতি মলহোত্রা। হরিয়ানার বাসিন্দা জ্যোতির ইউটিউবে একটি চ্যানেল রয়েছে। তিনি মূলত ভ্রমণের ভিডিয়ো পোস্ট করতেন সেখানে।
জ্যোতির সঙ্গে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। জ্যোতি-কাণ্ড ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে হইচই ফেলেছে। প্রতিনিয়ত উঠে আসছে নতুন নতুন তথ্য। তার মধ্যেই জানা গিয়েছে যে, গত বছর চিন সফরে গিয়েও বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন নেটপ্রভাবী! উঠে এসেছিলেন সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে। কিন্তু কেন?
২০২৪ সালে চিন সফরে গিয়েছিলেন ৩৩ বছর বয়সি নেটপ্রভাবী। চিন ভ্রমণের বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো শেয়ার করে নেটাগরিকদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি।
অভিযোগ, সাংহাই থেকে বেজিংগামী একটি দ্রুত গতির ট্রেনে যাত্রা করার সময় জানলার ধারের আসেন বসার জন্য এক যাত্রীর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন জ্যোতি।
চিনের স্থানীয় এক মহিলা চালককে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগও উঠেছিল জ্যোতির বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ওই চালক রাজি না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকেন নেটপ্রভাবী। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে মহিলা চালককে পুলিশের সাহায্য নিতে হয়।
বৈধ টিকিট ছাড়া চিনে একটি যাত্রিবাহী বাসে ওঠার এবং পরে ভাড়়া দিতে অস্বীকার করার অভিযোগও উঠেছিল জ্যোতির বিরুদ্ধে। পাশাপাশি, চালককে একটি অননুমোদিত স্থানে বাস থামানোর জন্য জোর করার অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছিল।
অভিযোগ উঠেছিল, চিনে থাকাকালীন সে দেশের নাগরিকদের শারীরিক গঠন নিয়ে উপহাস করেছিলেন তিনি। ঠাট্টা করেছিলেন তাঁদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং ভাষা নিয়েও।
সেই সব ঘটনার ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসতেই জ্যোতির আচরণ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সমাজমাধ্যমে। তাঁকে ‘অভদ্র’ এবং ‘অভব্য’ বলে সোচ্চার হন নেটাগরিকদের একাংশ। চিনে তাঁর আচরণের জন্য তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি সে দেশে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বলেও খবর।
যদিও পরে ক্ষমা চেয়ে নেন জ্যোতি। তিনি জানিয়েছিলেন, ভাষাগত পার্থক্যের জন্যই তাঁর সঙ্গে চিনা নাগরিকদের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।
সেই জ্যোতিই পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে শুক্রবার গ্রেফতার হয়েছেন। পহেলগাঁও-কাণ্ডের পর থেকে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের সঙ্গে ভারতীয়দের যোগাযোগের বেশ কিছু অভিযোগ উঠে এসেছে। গত কয়েক দিনে পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থান থেকে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদেরই এক জন জ্যোতি।
তদন্তকারীদের সন্দেহ, ভারতের বিভিন্ন স্থানের সংবেদনশীল তথ্য পাকিস্তানিদের কাছে পাচার করতেন জ্যোতি। তথ্য পাচার করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং গতিবিধি সম্পর্কেও। হোয়াটস্অ্যাপ, টেলিগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করে তিনি পাকিস্তানি চরেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বলে অভিযোগ।
অভিযোগ, পাকিস্তানি চরেদের পরিচয় গোপন রাখতে মোবাইলে অন্য নামে নম্বরগুলি সেভ করতেন জ্যোতি। তার মধ্যে ‘জাট রনধাওয়া’ নামে একটি নম্বর সেভ করা ছিল। তদন্তকারীদের সন্দেহ, ওই নম্বরটি আসলে পাকিস্তানি চর শাকিরের। এক পাকিস্তানি চরের সঙ্গে জ্যোতির ‘ঘনিষ্ঠতা’ তৈরি হয়েছিল বলেও তদন্তকারী দল সূত্রে খবর।
জ্যোতি যখন বালি এবং ইন্দোনেশিয়া ঘুরতে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে এক পাকিস্তানি চর ছিলেন বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের। নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের আধিকারিক এহসান-উর-রহিম ওরফে দানিশের সঙ্গে ধৃত ইউটিউবার জ্যোতির ‘ঘনিষ্ঠতা’ও এখন পুলিশের নজরে।
অভিযোগ, দানিশের মাধ্যমেই পাক গুপ্তচর সংস্থার একাধিক আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল জ্যোতির। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, জ্যোতি প্রথম বার পাকিস্তান যান ২০২৩ সালে। ওই সময়ে নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের আধিকারিক দানিশের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।
জ্যোতির ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘ট্রাভেল উইথ জো’। সেখানে মূলত ভ্রমণের ভিডিয়োই পোস্ট করতেন জ্যোতি। গত বছর কাশ্মীরে গিয়েছিলেন জ্যোতি। সেখানে ডাল হ্রদে শিকারায় তাঁর ঘোরার ভিডিয়োও রয়েছে। ট্রেনে করে শ্রীনগর থেকে বনিহাল যাওয়ার একটি ভিডিয়োও পোস্ট করেছিলেন ইউটিউবার। গত এপ্রিল মাসে পহেলগাঁও কাণ্ডের পর জ্যোতি একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন।
ইউটিউবার হিসাবে দ্রুত খ্যাতি এবং অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলেন জ্যোতি। নিজের ক্ষেত্রের প্রতিযোগীদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। জ্যোতির ইউটিউব চ্যানেল ‘ট্র্যাভেল উইথ জো’-এর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার। এই সংখ্যাটাই দ্রুত বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য নিত্যনতুন বিষয়বস্তুর প্রয়োজন ছিল তাঁর।
সেই সব বিষয়বস্তু জোগাড় করতে বার বার পাকিস্তানে গিয়েছিলেন জ্যোতি। পুলিশ জানিয়েছে, সেই সূত্রে পাকিস্তানি চরদের কাছে ক্রমেই ‘সম্পদ’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ।
দেশ-বিদেশে গিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে থাকতেন জ্যোতি। বিমানের বিজ়নেস ক্লাসে যাতায়াত করতেন। কিন্তু এত টাকা কী ভাবে তাঁর কাছে আসত? বিশেষ কেউ কি সেই খরচ জোগাতেন? সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তদন্তকারীরা। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই কি সেই টাকা দিত জ্যোতিকে? তা-ও জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।
এ-ও অভিযোগ, পাকিস্তানে গিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লশকর-এ-ত্যায়বার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন জ্যোতি! সেই তথ্য একটি রিপোর্ট থেকে পাওয়া গিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। লশকর-এ-ত্যায়বার প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মুরিদকে। সেখানেই জ্যোতি গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে রিপোর্টে উঠে এসেছে। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর একটি বিশেষ অভিযানে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। তবে সেই অভিযান শুরুর আগেই তাঁকে গ্রেফতার করে হিসার পুলিশ।
সূত্রের খবর, পহেলগাঁও হামলার কয়েক দিন আগেই পাকিস্তান সফর করেছিলেন জ্যোতি। ১৪ দিন মুরিদকেতে ছিলেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি সেই সফরের কথা স্বীকার করেছেন বলে জানা গিয়েছে। যদিও তাঁকে কোন অভিযানের দায়িত্বে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়।
জানা গিয়েছে, পাকিস্তানে থাকাকালীন বিভিন্ন জায়গায় অবাধে যাতায়াত করার অনুমতি পেয়েছিলেন জ্যোতি। এমনকি অনেক সংবেদনশীল এলাকাও তিনি পরিদর্শন করতেন। জ্যোতি সে দেশে থাকাকালীন পাক পুলিশ তাঁর জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল বলেও খবর।
জ্যোতির ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিয়ো ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, তিনি মাস দুয়েক আগে, অর্থাৎ পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার আগে পাকিস্তান গিয়েছিলেন।
অটারী-ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে ও পারে যাওয়া, লাহৌরের আনারকলি বাজার, পাক পঞ্জাবের কটাস রাজ মন্দির ঘুরে দেখার ভিডিয়োও রয়েছে জ্যোতির। পাকিস্তানের খাবার এবং ভারত-পাকিস্তানের সংস্কৃতির তুলনা করেও ভিডিয়ো বানিয়েছিলেন ইউটিউবার। সেই সময়ই জ্যোতি মুরিদকেতে গিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় মুরিদকের জঙ্গিঘাঁটি উড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সেনা।
জ্যোতির পুরো বিষয়টি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করছেন তদন্তকারীরা। ২০ জনেরও বেশি নেটপ্রভবী গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন বলেও তদন্তকারীরা মনে করছেন।