রাশিয়া-ইউক্রেন হোক বা ইজ়রায়েল-হামাস। আধুনিক যুদ্ধে এখনও গুরুত্ব হারায়নি ট্যাঙ্ক। উল্টে গ্রাউন্ড অপারেশনের ক্ষেত্রে এই হাতিয়ারের উপরেই চোখ বুজে ভরসা করে থাকেন পদস্থ সেনা অফিসারেরা। দুঁদে কমান্ডারদের দাবি, শত্রুব্যূহে ঢুকে পড়ে জমিদখলের ক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের কোনও বিকল্প নেই।
ট্যাঙ্কের সংখ্যার নিরিখে ভারতের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। সপ্তম স্থানে রয়েছে পাকিস্তানের নাম। প্রায় সাড়ে চার হাজার ট্যাঙ্ক রয়েছে ভারতীয় সেনার কাছে। ইসলামাবাদের সেনা বর্তমানে ২,৬২৭টি ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে। তবে ভারতের সঙ্গে ট্যাঙ্কের মুখোমুখি লড়াইয়ে কখনওই জয়ের মুখ দেখতে পারেননি রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
১৯৬৫ সালের পঞ্জাবের আসাল-উত্তরের যুদ্ধে আমেরিকার তৈরি ‘এম৪৭’ এবং ‘এম৪৮’ প্যাটন ট্যাঙ্ক নিয়ে আক্রমণ করে পাক ফৌজ। কিন্তু, সেগুলির ৭০টিকেই ধ্বংস করে ভারতীয় সেনা। ওই সংঘর্ষে মোট ৯৭টি ট্যাঙ্ক হারিয়েছিল ইসলামাবাদ।
১৯৬৫ সালে, অর্থাৎ ৬০ বছর আগে ৮ সেপ্টেম্বর আসাল-উত্তরের যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল পঞ্জাবের খেম করণ শহর। আসাল-উত্তর যুদ্ধের আগে অপারেশন জিব্রাল্টারের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় পাকিস্তান। লক্ষ্য ছিল কাশ্মীর দখল। ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর অমৃতসর দখলের লক্ষ্যেও অগ্রসর হচ্ছিল পাকিস্তান।
আসাল-উত্তরের যুদ্ধে ভারতের পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে আক্রমণ শুরু করেছিল পাকিস্তান। পঞ্জাবও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। পঞ্জাবের খেম করণের আসাল-উত্তর গ্রামের আখখেতগুলির কাছে ট্যাঙ্কযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ভারত এবং পাক সেনাবাহিনীর মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কুর্স্কের যুদ্ধের পর সেটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাঙ্কযুদ্ধ।
আসাল-উত্তরের সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের ভরসা ছিল আমেরিকার থেকে পাওয়া ‘এম৪৭’ এবং ‘এম৪৮’ প্যাটন ট্যাঙ্ক। সেই সময় প্যাটন ট্যাঙ্ক বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ট্যাঙ্কগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। সে তুলনায় ভারতের হাতে ছিল পুরনো শেরম্যান এবং সেঞ্চুরিয়ান ট্যাঙ্ক, যা গতি এবং গোলাগুলির নিরিখে প্যাটন ট্যাঙ্কের চেয়ে দুর্বল ছিল। তবুও খেম করণের রণাঙ্গনে কৌশলে সেই ‘বুড়ো ঘোড়া’ দিয়েই পাকিস্তানের অত্যাধুনিক প্যাটন ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে ভারতীয় সেনা।
ভারতীয় সেনার অসাধারণ দক্ষতা, কৌশল এবং সাহসিকতা আসাল-উত্তরের পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দেয়। তিন দিনের তীব্র লড়াইয়ের পর পাক ট্যাঙ্কবাহিনী পর্যুদস্ত হয়। পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের ধ্বংসস্তূপেও পরিণত হয় আসাল-উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্র।
আসাল-উত্তরের সংঘর্ষ ব্যক্তিগত সাহসিকতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের একটি। কেবল ভারতের সামরিক ইতিহাসে নয়, বিশ্বব্যাপী সমাদৃত যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম ছিল আসাল-উত্তরের যুদ্ধ।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর মাধ্যমে ভারতের বুকে প্রথম হামলা চালায় পাকিস্তান। পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয়দের ছদ্মবেশে জম্মু ও কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ শুরু করে। লক্ষ্য ছিল, উপত্যকায় অশান্তি ছড়িয়ে দেওয়া।
কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে অভিযানটি সফল হয়নি। শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যর্থ হয় ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’। পাক অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বার করে ভারতীয় সেনা।
এর পর হতাশ পাকিস্তান ১ সেপ্টেম্বর ‘অপারেশন গ্র্যান্ডস্লাম’ শুরু করে। জম্মু ও কাশ্মীরের আখনুর শহরকে লক্ষ্য করে সেই অঞ্চলে ভারতের সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
শীঘ্রই পশ্চিমের সীমান্তবর্তী রাজ্য— পঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাতে আক্রমণ শুরু করে পাক সেনা। পঞ্জাবে অমৃতসরের উপর নজর ছিল পাকিস্তানের। পাক বাহিনীর মধ্যে ছিল ১ আর্মার্ড ডিভিশন এবং ১১ ইনফ্যান্টরি বাহিনী। সীমান্ত অতিক্রম করে খেম করণ দখল করে তারা। পাক বাহিনীকে সেখান থেকে উৎখাত করতে অভিযান শুরু করে ভারতীয় সেনা।
৪ মাউন্টেন ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল গুরবক্স সিংহের নেতৃত্বে শেরম্যান এবং সেঞ্চুরিয়ান ট্যাঙ্ক-সহ ৩টি অশ্বারোহী বাহিনী, ৯টি ডেকান হর্স এবং ২ ইনডিপেন্ডেন্ট আর্মার্ড ব্রিগেড অগ্রসর হয় খেম করণের দিকে।
আসাল-উত্তরে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ট্যাঙ্কযুদ্ধ শুরু হয় ৮ সেপ্টেম্বর। তিন দিনের লড়াইয়ে যুদ্ধের গতিপথ বদলে দিয়েছিল ভারতের ৪ মাউন্টেন ডিভিশন।
আপার বারি দোয়াব খালের পাশে অবস্থিত খেম করণের সমতল ভূখণ্ড ট্যাঙ্কযুদ্ধের জন্য আদর্শ ছিল। ফলে পাকিস্তানের হাতে থাকা আমেরিকার অত্যাধুনিক প্যাটন ট্যাঙ্কের সামনে যে ভারতের ট্যাঙ্কগুলির টেকা মুশকিল, তা আন্দাজ করেছিলেন ভারতের সেনাকর্তারা।
সেই আশঙ্কা থেকে সেনাকে আপার বারি দোয়াব খাল কেটে দেওয়ার নির্দেশ দেন জেনারেল গুরবক্স। ফলে খেম করণের সমতল ভূখণ্ড কাদামাটিতে ভরে যায়। জলাজমিতে আটকে যায় পাকিস্তানি ট্যাঙ্কগুলি।
এর মধ্যেই খেম করণের আখখেতের আড়ালে অপেক্ষাকৃত হালকা ট্যাঙ্ক নিয়ে এগোতে থাকে ভারতীয় সেনা। তাঁদের পথ চেনাতে সাহায্য করেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা।
আসাল-উত্তরের যুদ্ধের কৃতিত্ব যাঁদের, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আব্দুল হামিদ। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি জিপের উপরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন হামিদ। হাতে থাকা রিকোয়েললেস (আরসিএল) বন্দুক নিয়ে আধ ডজনের বেশি প্যাটন ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছিলেন তিনি।
হামিদ ছিলেন ভারতীয় সেনার ৪ গ্রেনেডিয়ার্সের সদস্য। আসাল-উত্তরের যুদ্ধে ৪ গ্রেনেডিয়ার্স এবং ১/৯ গোর্খা রাইফেল্স প্রায় ৮০টি ট্যাঙ্ক নিয়ে সামনের সারিতে ছিল। সেই ট্যাঙ্কগুলির অধিকাংশই ছিল শেরম্যান। ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যে পাকিস্তানের ১১টি প্যাটন ধ্বংস হয়ে যায়।
সে দিন আরও পাঁচটি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ককে ধ্বংস করে দেয় ভারতের ৯ ডেকান হর্স। পরের দিন অর্থাৎ ৯ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তান ৪ এবং ৬ আর্মার্ড রেজিমেন্ট মোতায়েন করে। ভারতীয় গোয়েন্দারা তাদের রেডিয়ো যোগাযোগ আটকে দিয়ে জেনারেল গুরবক্সকে সতর্ক করেন। ওই দিন সন্ধ্যার মধ্যে আরও ৩০টি ট্যাঙ্ক হারায় পাকিস্তান।
১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা নাগাদ আবার হামলা শুরু করে পাকিস্তান। কিন্তু দুপুরের মধ্যে পাকিস্তানের ১ আর্মার্ড ডিভিশন পিছু হটে। হামিদ তাঁর রিকোয়েললেস বন্দুক নিয়ে একের পর এক পাক ট্যাঙ্ক ধ্বংস করতে থাকেন। সেই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের হাতে নিহতও হন হামিদ।
১০ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে পিছু হটতে শুরু করে পাক সেনা। পাকিস্তানের ৭২টি প্যাটন-সহ মোট ৯৭টি ট্যাঙ্ক দখল করে ভারতীয় সেনা। ধ্বংসস্তূপে ভরা যুদ্ধক্ষেত্রটি ‘প্যাটন নগর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আসাল-উত্তরের যুদ্ধ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয়গুলির মধ্যে অন্যতম।