সপ্তাহখানেক আগের কথা। ওয়াশিংটনের ফ্রেডিজ় বিচ বার, ডোমিনো’জ় পিৎজা, ডিস্ট্রিক্ট পিৎজ়া প্যালেস এবং ক্রিস্টাল সিটি স্পোর্টস পাবের মতো দোকানগুলিতে ঢুকতে থাকে একের পর এক পিৎজ়ার অর্ডার। আসছে আমেরিকার সামরিক সদর দফতর পেন্টাগন বা তার কাছেপিঠের এলাকা থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে টনক নড়ে অনেকের। সক্রিয় হয় পেন্টাগন পিৎজ়া রিপোর্ট নামের এক্স হ্যান্ডল। শুরু হয় জল্পনা। তা হলে কি কোনও বড় প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেরিকা? বিশ্বের কোথাও কি যুদ্ধ হতে শুরু চলেছে?
কিন্তু জনপ্রিয় ইতালীয় সুস্বাদু খাবার এবং পেন্টাগনে তার বেশি করে অর্ডার পৌঁছোনো কী করে যুদ্ধ বা বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটতে চলা কোনও বড় ঘটনার ইঙ্গিত দেয়?
অবিশ্বাস্য মনে হলেও ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদীদের একাংশের মতে, সত্যিই নাকি আমেরিকার সামরিক সদর দফতরে বেশি পরিমাণ পিৎজ়ার অর্ডারের অর্থ পৃথিবীর বুকে কোনও বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে।
‘পেন্টাগন পিৎজ়া রিপোর্ট’ নামে ওই এক্স হ্যান্ডল পেন্টাগন এবং সিআইএ-এর মতো সরকারি সংস্থাগুলির কাছে অনলাইনে কত পিৎজ়ার অর্ডার যায়, তা অনুসরণ করে। ২৭ এবং ২৮ অগস্টও যেমনটা করেছিল তারা। দেখা যায় পেন্টাগনে পিৎজ়া অর্ডারের ধুম শুরু হয়েছে। সাধারণ দিনের থেকে প্রায় ৮০০ শতাংশ বেশি পিৎজ়া অর্ডার হয়েছে পেন্টাগন এবং আশপাশের এলাকা থেকে।
২৯ অগস্ট দুপুর ১টার দিকে ওই এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্টে বলা হয়েছিল, ‘‘পেন্টাগনের কাছের পিৎজ়ার দোকানগুলিতে প্রচুর অর্ডার আসছে।’’ সন্ধ্যার পরেও ওই সংক্রান্ত একটি পোস্ট করা হয় এক্স হ্যান্ডলটি থেকে। সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসেন ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদীরা। নানা গুজব ছড়ায়।
এই গুজবও ছড়ায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তবে পরে দেখা যায় তিনি সুস্থই রয়েছেন। এ ছাড়া অন্য কোনও বড় ঘটনা ঘটার কথাও প্রকাশ্যে আসেনি।
পেন্টাগনে কত পিৎজ়া যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য একটি নির্দিষ্ট সূচক রয়েছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘পেন্টাগন পিৎজ়া ইনডেক্স’ বা ‘পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক’।
কিন্তু কী এই পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক? পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এমন একটি তত্ত্ব, যা দাবি করে, গভীর রাতে পেন্টাগনে পিৎজ়ার অর্ডার বৃদ্ধির অর্থ হল হয় আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তায় কোনও সঙ্কট এসেছে, নয়তো তা কোনও সামরিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত। বিশ্বের বুকে ঘটতে চলা কোনও রাজনৈতিক উত্তেজনার ইঙ্গিতও হতে পারে সেটি।
পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক তত্ত্বটি জনপ্রিয়তা পায় ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকে। ওয়াশিংটনে থাকা সোভিয়েত চরেরা নাকি পেন্টাগনে পিৎজ়া সরবরাহের বাহুল্য দেখে বুঝতেন যে মার্কিন সরকার বড় কোনও পদক্ষেপ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক তত্ত্বে বিশ্বাসীদের মত, বড়সড় কোনও ঘটনা ঘটার আগে পেন্টাগনে তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। চরম ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতরের কর্তারা। অফিস ছেড়ে কোথাও যেতে পারেন না তাঁরা।
তখন বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খিদে মেটাতে হয় ওই আধিকারিকদের। এবং সে ক্ষেত্রে পিৎজ়াই বেশি প্রাধান্য পায়। নিজেদের জায়গায় বসে কাজ করতে করতেই পিৎজ়া খান পেন্টাগনের আধিকারিকের। তাই পেন্টাগনে পিৎজ়া অর্ডারের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলে অনেকেই ধরে নেন, বড় কিছু ঘটতে চলেছে। পিৎজ়াই হয়ে ওঠে সঙ্কটের সঙ্কেত।
যদিও সেই তত্ত্বের সমর্থনে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। যুক্তবাদীরা বিষয়টিকে যুদ্ধকালীন ‘গুজব’ এবং গোয়েন্দা গল্প ভালবাসেন এমন মানুষদের রসদ বলেই মনে করেন। আমেরিকার সরকারি কর্তারাও বিষয়টিকে গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন বার বার।
তবে পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক ‘সঠিক’ও প্রমাণিত হয়েছে একাধিক বার। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের অগস্টে সাদ্দাম হুসেন কুয়েত আক্রমণ করার কয়েক ঘণ্টা আগে নাকি ওয়াশিংটনের একটি পিৎজ়া দোকান থেকে প্রচুর পরিমাণে পিৎজ়া সরবরাহ করা হয় পেন্টাগনে।
এর পরেই কুয়েতে আকস্মিক আক্রমণ শুরু করে ইরাক। সাদ্দাম হোসেনের বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ছোট উপসাগরীয় দেশটিকে দখল করে নেয়। কুয়েতকে ইরাকের ‘১৯তম প্রদেশ’ ঘোষণা করা হয়।
পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক অনুযায়ী, ইরাকের কুয়েত আক্রমণ, সার্বিয়ার উপর নেটোর বোমা হামলা, আফগানিস্তান এবং ইরাকের যুদ্ধ, এমনকি ২০১১ সালে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের আগেও পেন্টাগনে গভীর রাতে পিৎজ়ার অর্ডার হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে জুন মাসেও পেন্টাগন পিৎজ়া সূচক ‘সঠিক’ প্রমাণিত হয়েছিল। ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যমে তেহরানে বিস্ফোরণের খবর প্রকাশ্যে আসার কয়েক ঘণ্টা আগে নাকি পেন্টাগনের আশপাশের এলাকায় পিৎজ়ার অর্ডার বৃদ্ধি পেয়েছিল।
পেন্টাগন থেকে প্রচুর পরিমাণ পিৎজ়ার অর্ডার আসা যে বড় কোনও ঘটনার ইঙ্গিত, তা মনে করেন ওয়াশিংটনের পিৎজ়া দোকানগুলির মালিক এবং কর্মীরাও।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী এক পিৎজ়া সরবরাহকারী ১৯৯০ সালের অগস্টে বলেছিলেন, ‘‘আমরা জানি বিষয়টা। পানামা হামলার আগের রাতে পেন্টাগন থেকে আসা পিৎজ়ার অর্ডার দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। গ্রানাডা আক্রমণের আগেও একই ঘটনা ঘটেছিল। আমরা অনেক অর্ডার পেয়েছিলাম। মধ্যরাত থেকে অর্ডার আসা শুরু হয়। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম কিছু একটা ঘটতে চলেছে।’’
‘নিউজ়.কম.এইউ’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পেন্টাগনে পিৎজ়ার অর্ডার দেখে কোনও বড় ঘটনার ইঙ্গিত করাকে বলে ‘পিজ়িন্ট’, অর্থাৎ পিৎজ়া গোয়েন্দা। আমেরিকার সাংবাদিক উলফ ব্লিটজ়ার একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘‘সাংবাদিকদের জন্য একটাই পরামর্শ, সব সময় পিৎজ়ার উপর নজর রাখুন।’’