মাছেভাতে বাঙালির সর্বকালের সঙ্গী মাছপ্রেমী বিড়াল। মাথা থেকে লেজ অবধি নরম লোমে ঢাকা এই চারপেয়ে প্রাণীটিকে সকলে ভালবেসে বাড়িতে না-ই রাখতে পারেন। কিন্তু সে সকলের বাড়িতে ঠিক নিজের জায়গা করেই নেয়। থাকতে না পেলেও, খাবার আদায় করে নেওয়ার ব্যাপারে এরা অন্যান্য প্রাণীর থেকে একটু এগিয়েই থাকে।
কিন্তু এই বিশ্বে আমাদের রোজকার জীবনে দেখতে পাওয়া সাদা, কমলা, কালো প্রভৃতি রঙের ‘সাধারণ’ মার্জারদের বাইরেও আরও নানা ‘অসাধারণ’ বিড়াল রয়েছে। তাদের হদিস জানলেও, নাগাল পাওয়ার সামর্থ্য সকলের নেই। তাদের কারও গায়ে লোমের আভাসমাত্র নেই, কেউ আবার দেখতে সাক্ষাৎ চিতাবাঘের মতো।
দামি বিড়ালদের তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে এক ‘লোমহীন’ মার্জার, স্ফিংস। এদের গায়ে যে একটাও লোম নেই তা নয়, তবে সেই লোমগুলি আকারে এতই ছোট যে তাদের অস্তিত্ব বোঝা যায় না বললেই চলে। স্ফিংসদের গায়ে অন্যান্য বিড়ালের তুলনায় লোম থাকেও নামমাত্র পরিমাণে।
স্ফিংস নামটি শুনলে মিশর থেকে আনা হয়েছে বলে মনে হলেও, আদতে এই মার্জারগোষ্ঠীর ‘জন্মস্থান’ হল কানাডা। ভারতে এই বিড়ালের দাম শুরু হয় আনুমানিক দেড় লক্ষ টাকা থেকে। সর্বাধিক দাম প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার গণ্ডি পেরিয়ে যায়।
কানাডিয়ান এই বিড়ালের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এদের চোখের পাতা থাকে না। এমনকি স্ফিংসদের গোঁফও থাকে না। গোঁফ ও ‘লোমহীন’ এই বিড়ালদের দেখে ভয় লাগলেও বাস্তবে তারা অত্যন্ত মিশুকে হয়।
স্ফিংসরা পাত্তা পেতে এবং দিতে খুবই ভালবাসে। কিন্তু বাড়িতে কোনও নতুন অতিথি এলে তাঁর সঙ্গে মেশার জন্য এই বিড়ালদের কিছুটা সময় দিতে হয়। নচেৎ, একটা-দুটো থাবার বাড়ি খেতে হতে পারে।
এই বিড়ালদের মুখ হয় ছোট আকৃতির, তবে প্রায় ‘নেড়া’ দেহের সঙ্গে সেটি বেশ ভাল মানিয়ে যায়। কানগুলি হয় বড় বড় এবং ত্রিকোণাকৃতির। এদের মধ্যে সাধারণত সোনালি, নীল, হলুদ ও সবুজ রঙের চোখ দেখা যায়। এই বিড়ালদের বুকের কাছের কিছুটা অংশ এবং পিছনের পায়ের কাছের চামড়াটা কুঁচকে থাকে। স্ফিংসেরা লম্বায় মাঝারি হয়। সাধারণত আট ইঞ্চি থেকে দশ ইঞ্চির বেশি লম্বা হয় না এই বিড়ালেরা।
বিশ্বের বহুমূল্য মার্জারদের তালিকার চার নম্বরে রয়েছে পিটারবাল্ড প্রজাতির বিড়াল। এই বিড়ালের ‘আঁতুড়ঘর’ সুদূর রাশিয়া। ভারতীয় মুদ্রায় এই বিড়ালেরও দাম শুরুই হয় প্রায় দেড় লক্ষ টাকা থেকে। আর তা শেষ হয় গিয়ে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকায়।
রাশিয়ার এই বিড়ালের বিশেষত্ব কী? পিটারবাল্ডেরা আক্ষরিক অর্থেই ‘বাল্ড’। অর্থাৎ, এই প্রজাতির বিড়ালের গায়ে লোম থাকে না বললেই চলে। কারও গায়ে লোম থাকলেও তা এতই ছোট হয় যে চোখে দেখতে পাওয়া যায় না, ছুঁয়ে দেখলে বোঝা যায়।
পিটারবাল্ড দেখতেও আর পাঁচটা বিড়ালের থেকে একটু আলাদা। এরা এক থেকে দেড় ফুট মতো লম্বা হয়। দেহের তুলনায় মাথাটি বেশ ছোট এবং ত্রিকোণাকার। এদের গলাটি বেশ লম্বা ও সরু। লেজটিও দেহের মতোই বেশ বড় ও সরু হয়।
মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকে শিঙাড়ার মতো দু’টি লম্বা লম্বা কান। চোয়ালের কাছটা ভোঁতা মতো। গোল গোল চোখজোড়া নীল, সবুজ, সোনালি প্রভৃতি নানা রঙের হতে পারে।
তবে আচরণের দিক থেকে পিটারবাল্ড আর পাঁচটা বিড়ালের মতোই আদুরে হয়। অন্যান্য বিড়াল, এমনকি কুকুরদের সঙ্গেও এরা বেশ মানিয়ে চলতে পারে। রুশদেশীয় এই মার্জারদের বুদ্ধিও হয় প্রবল। এরা প্রায় ১২-১৫ বছর আপনার একাকিত্বের সঙ্গী হয়ে থেকে যাবে।
আমেরিকার বেঙ্গল প্রজাতির বিড়াল বিশ্বের সবথেকে দামি বিড়ালদের তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছে। এই বিড়ালগুলি মিশ্র প্রজাতির। গবেষণাগারে এশীয় চিতাবাঘ প্রজাতির বিড়াল ও সাধারণ বিড়ালের প্রজনন ঘটিয়ে বেঙ্গল প্রজাতির বিড়ালদের সৃষ্টি করা হয়েছে।
আমেরিকান এই বিড়ালদের দেখতে অনেকটা চিতাবাঘের মতো। এদের সারা গা পাটকিলে বা রুপোলি লোম দিয়ে ঢাকা থাকে। তার উপর থাকে বাদামি বা কালো রঙের ছোপ ছোপ। দেখলে মনে হয়, স্বয়ং ‘চিতাবাঘের মাসি’ পায়ের কাছে এসে ঘোরাঘুরি করছে।
বেঙ্গলদের দাম শুরুই হয় প্রায় দু’লক্ষ টাকা থেকে। তবে আনুমানিক সাড়ে আট লক্ষ বা তার বেশি টাকা দিয়েও এই বিড়াল কিনতে হতে পারে। বেঙ্গল প্রজাতির বিড়ালদের চিতাবাঘের মতো রূপই তাদের এই বিশাল দামের কারণ।
দেখতে বন্য হলেও, স্বভাবের দিক থেকে কিন্তু এরা বেশ আদুরে। খেলাধুলা করতে ভালবাসে, মানুষের গা ঘেঁষে থাকতেও খুব পছন্দ করে। বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে খুব একটা পছন্দ করে না বেঙ্গল প্রজাতির বিড়ালেরা। ঘরের আয়েশই পছন্দ এদের।
বেঙ্গলদের চোখের রং সাধারণত সবুজ বা সোনালি হয়ে থাকে। লম্বায় এরা আট ইঞ্চি থেকে ১৫ ইঞ্চি মতো হয়। বাড়ির অন্যান্য পোষ্যের সঙ্গে মানিয়ে থাকার ব্যাপারে এরা বেশ পটু।
আমেরিকার গবেষণাগারে সৃষ্ট সাভানা প্রজাতির বিড়ালেরা দামি বিড়ালদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ভারতীয় মুদ্রায় এই প্রজাতির বিড়ালের মূল্য শুরুই হয় আনুমানিক সাড়ে আট লক্ষ টাকা থেকে, সেই দাম গিয়ে শেষ হয় প্রায় ৪০ লক্ষেরও বেশি অঙ্কে।
গবেষণাগারে আফ্রিকার বনবিড়াল ও সাধারণ বিড়ালের প্রজনন ঘটিয়ে সাভানা প্রজাতির বিড়ালদের সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই কারণেই এই মার্জারদের দাম এমন আকাশছোঁয়া।
সাভানা প্রজাতির বিড়ালদের মধ্যেও নানা ভাগ রয়েছে। এদের কেউ কেউ সম্পূর্ণ ভাবে গৃহপালিত হলেও, কয়েকটি আবার বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে। কিন্তু এই প্রজাতির বিড়ালদের কেউই ভয়াল নয়, উপরন্তু অন্য বিড়ালদের মতো সাভানারাও মানুষের সঙ্গে মিশে থাকতে, খেলতে খুব পছন্দ করে।
এরা লম্বায় এক ফুটের বেশি হয়। গায়ের রং হয় পাটকিলে, তার উপর থাকে কালো কালো ছোপ। সাভানাদের অনেকটা পেশিবহুল হায়নার মতন দেখতে হয়। কিন্তু হিংস্র সেই প্রাণীর স্বভাবের সঙ্গে আদরপ্রেমী এই মার্জারদের কোনও মিল নেই।
আমেরিকার গবেষণাগারে সৃষ্ট এই বিড়ালদেরও দেহের তুলনায় মাথা ছোট আকৃতির হয়। সাভানাদের কানগুলি হয় মাঝারি আকৃতির এবং ত্রিকোণাকার। পাটকিলে বর্ণের লেজটি হয় বেশ লম্বা ও সরু। লেজের মাথায় কালো রঙের দাগ কাটা থাকে।
বিশ্বের সবচেয়ে দামি বিড়ালদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে আশেরা প্রজাতির বিড়াল। ভারতীয় মুদ্রায় এদের এক একটির দাম শুরুই হয় ১৮ লক্ষ টাকা থেকে এবং গিয়ে থামে কোটির ঘরে। শুধু দামিই নয়, এটি বিরলও বটে।
আশেরা প্রজাতির বিড়ালগুলি হল মিশ্র প্রজাতির। গবেষণাগারে আফ্রিকার বনবিড়াল, এশীয় চিতাবাঘ প্রজাতির বিড়াল ও সাধারণ বিড়ালের প্রজনন ঘটিয়ে আশেরা প্রজাতির বিড়ালদের সৃষ্টি করা হয়েছে।
উচ্চতার দিক থেকে এক একটি আশেরা প্রজাতির বিড়াল চার থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কিন্তু আকারে বিশাল হলেও, স্বভাবের দিক থেকে এরা আর পাঁচটি সাধারণ বিড়ালের মতোই শান্ত ও আদুরে প্রকৃতির।
লম্বা বলে যে এরা বনেবাদাড়ে থাকে তেমনটা কিন্তু নয়। আশেরা প্রজাতির বিড়ালেরাও গৃহপালিত প্রাণী। তবে, এদের প্রজনন ঘটানো ব্যয়সাপেক্ষ বলে বিশ্বে এই প্রজাতির বিড়ালের সংখ্যা বেশ কম।
এদের মুখটি দেহের তুলনায় ছোট আকৃতির হয়। ছোট্ট মাথার উপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দু’টি বড় বড় কান। উজ্জ্বল সবজে রঙের দু’চোখ জুড়ে থাকে আদরের আবদার। গায়ের রং হয় পাটকিলে। আশেরার সারা গা জুড়ে থাকা কালো বা বাদামি রঙের ছোপ ছোপ তাকে যোগ্য ‘বাঘের মাসি’র তকমা দেয়। খাওয়াদাওয়ার দিক থেকে এরা অন্য বিড়ালদের মতোই মাংসাশী।