‘ফের আমেরিকাকে মহান করুন’ (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা সংক্ষেপে মাগা)— দ্বিতীয় বার জয়ী হওয়ার আগে এই স্লোগানই অন্যতম অস্ত্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। এই স্লোগানকে কটাক্ষ করেই ট্রাম্পবিরোধী নারীবাদীরা স্লোগান তোলেন ‘মাটগা’, যার পুরো কথা হল ‘মেক অ্যাকোয়া টোফানা গ্রেট অ্যাগেইন’। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে গর্ভপাতের অধিকার-সহ নারীদের আরও নানা বিষয় ঝুঁকির মুখে পড়বে, এই উদ্বেগ থেকেই এই আন্দোলনের সূচনা।
কিন্তু কী এই অ্যাকোয়া টোফানা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৪০০ বছর। অ্যাকোয়া টোফানা হল আর্সেনিক, সিসা এবং বেলেডোনার মিশ্রণে তৈরি একটি শক্তিশালী বিষ। এর জন্মস্থান ভূমধ্যসাগরের সর্ববৃহৎ দ্বীপ সিসিলি। ‘আবিষ্কারক’ ছিলেন সিসিলির রাজধানী পালেরমোর বাসিন্দা টিয়োফোনিয়া ডি আডামো। তাঁর নামানুসারেই নাকি নামকরণ করা হয় এই বিষটির।
১৬৩০ সাল নাগাদ এই বিষ তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করেন টিয়োফোনিয়া। সঙ্গীকে হত্যা এবং অবৈধ প্রাণঘাতী বিষ পাচারের দায়ে ১৬৩৩ সালের ১২ জুলাই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। এর বছরখানেক আগে বিষ বিক্রির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড হয় টিয়োফোনিয়ার সহযোগী ফ্রান্সেসকা লা সারদার।
টিয়োফোনিয়ার মৃত্যুর পর রোমে পালিয়ে যান জুলিয়া টোফানা। সম্ভবত টিয়োফোনিয়ার কন্যা ছিলেন জুলিয়া। অ্যাকোয়া টোফানার প্রসঙ্গে বার বার উঠে এসেছে এই জুলিয়ার নাম। রোমে গিয়ে আবার এই বিষ সরবরাহ করা শুরু করেন জুলিয়া। শোনা যায়, ফাদার জিরোলামো অফ সাঁ অ্যাগনেস ইন আগোনে ছিলেন এই বিষের মূল উপাদান আর্সেনিকের জোগানদার। এটি তিনি জোগাড় করতেন তাঁর ওষুধবিক্রেতা ভাইয়ের কাছ থেকে।
তবে জুলিয়া একা নন, আরও বেশ কয়েক জন মহিলা তাঁর সঙ্গে রোমে চলে যান। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জিরোলামা। ইনি জুলিয়ার কন্যা বলেই ধারণা করা হয়। এ ছাড়াও জিরোনিমা স্পানা, জিওভান্নো ডে গ্রান্ডিস, মারিয়া স্পিনোলা, গ্রাজ়িওসা ফারিনা নামে আরও কয়েক জনের খোঁজ পাওয়া যায়।
জুলিয়ার সহযোগী এই নারীদের কেউ ছিলেন ধাত্রী, কেউ গর্ভপাতে সাহায্য করতেন, কারও বা পেশা ছিল জাদুবিদ্যা, আবার কারও জীবিকা ছিল বেশ্যাবৃত্তি। এঁরা সকলেই নিযুক্ত ছিলেন বিষ তৈরি এবং পাচারের কাজে।
যেমন-তেমন কাজে নয়, বিশেষ এক কারণে ব্যবহার করা হত এই স্বাদহীন, গন্ধহীন তরল। শুধুমাত্র রোম নয়, রেনেসাঁর সময়কালে পালেরমো, নেপলস, পেরুজিয়া জুড়ে ব্যবহার ছিল এই তীব্র বিষের। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় মনে করা হত মেয়েরা তাঁদের বাবা, ভাই কিংবা স্বামীর ‘সম্পত্তি’। তাঁদের নিজস্ব মতামত বা স্বাধীন জীবনযাপনের কোনও দাম ছিল না।
নবজাগরণের কাল হওয়া সত্ত্বেও বিবাহবিচ্ছেদে কেবলমাত্র ধনী পুরুষদেরই একচেটিয়া অধিকার ছিল। কোনও যন্ত্রণাদায়ক সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাওয়া মহিলাদের ক্ষেত্রে সহজসাধ্য ছিল না। অত্যাচারী স্বামীর নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব ছিল বলা যায়। এই রকম পরিস্থিতিতেই তাঁদের পরিত্রাতা হয়ে ওঠেন জুলিয়া।
শোনা যায়, নির্দিষ্ট মাত্রায় চার বার খাওয়াতে পারলেই ভবলীলা সাঙ্গ হত অত্যাচারী পুরুষটির। এই বিষের সর্বপ্রধান ‘গুণ’ হল মৃত্যুর পরে শরীরে আর কোনও চিহ্ন পাওয়া যেত না। তাই, নির্যাতন থেকে নিষ্কৃতি পেতে জুলিয়ার উপরে ভরসা করতে শুরু করেন অত্যাচারিত নারীরা। বিশেষ এই তরল নির্যাতিতা নারীদের হাতে তুলে দিতেন জুলিয়া।
কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ‘মান্না দি সান নিকোলা’ লেবেল দেওয়া বোতলে রাখা হত এই প্রাণঘাতী বিষ। সান নিকোলা ডি বারির ছবিও ছিল এই লেবেলে। একনজরে দেখে যাতে মনে হয় এর মধ্যে থাকা তরল অত্যন্ত পবিত্র, সে কারণেই বিষের এই ‘ছদ্মবেশ’। অনায়াসে সকলের চোখের সামনে রেখে দেওয়া যেত এই শিশি। স্যুপে মিশিয়ে খাওয়ানো হলে কেউ সন্দেহও করতেন না।
শহরের রহস্যঘেরা গলিঘুঁজিগুলির একটি ওষুধের দোকানে নাকি এই বিশেষ দলটি কাজ করত। সেখানে মহিলারা যেমন তাঁদের ব্যথা-বেদনার কথা বলতে আসতেন, সন্তানপ্রসবের ক্ষেত্রে ফলদায়ী ভেষজ ওষুধও পেতেন। ট্যারট কার্ড পড়ে ভাগ্যগণনাও করা হত তাঁদের। আর এই বিষ হাতবদল হত গোপনে।
বলা হয়, ৬০০ জনেরও বেশি পুরুষের প্রাণ নেয় এই বিষ। এঁদের বেশির ভাগই বিবাহিত ছিলেন। কালজয়ী সুরস্রষ্টা মোৎজ়ার্ট এক বার দাবি করেছিলেন যে, এই প্রাণঘাতী বিষ নাকি তাঁর উপরেও প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলেই মনে করা হয়।
এই বিষ কিনতে সেখানে সাধারণ ঘরের মহিলারা যেমন আসতেন, তেমনই এক বার নাকি পা পড়েছিল এক ডাচেসেরও। গুজব, কেরির ডাচেস আনা মারিয়া আলডোব্রানডিনি এই দলের সাহায্য নিয়েছিলেন। মনে করা হয়, এই ডাচের মৃত্যুই জুলিয়ার দলের কাজকর্মের সমাপ্তি ডেকে আনে।
তবে, জুলিয়ার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, বিপদ আঁচ করে একটি কনভেন্টে আশ্রয় নেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধারী জুলিয়া। ১৬৫১ সালে ঘুমের মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাঁর। আবার কেউ কেউ বলেন, ওই কনভেন্ট থেকেই বিষের কারবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন জুলিয়া এবং ধরা পড়েন। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে।
আবার আর একটি মত বলে, শয়ে শয়ে পুরুষের মারা যাওয়ার খবরে নড়েচড়ে বসেন পোপ সপ্তম আলেসানড্রো। শহরে সে সময় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ছিল, তা সত্ত্বেও এমন মশামাছির মতো মৃত্যু, তা-ও আবার শুধুমাত্র পুরুষদেরই, ভাবিয়ে তোলে তাঁকে। সে তালিকায় যেমন ছিল কোনও ডিউকের নাম, তেমনই ছিলেন সাধারণ মানুষও।
স্টেফানো ব্রাচি নামে এক তদন্তকারীকে ওষুধ বিক্রি করা সেই বিশেষ দলটির গতিবিধির উপর নজর রাখার ভার দেন পোপ। ব্রাচি গুপ্তচরদের একটি দল নিয়োগ করেন। শহরের ছোট ছোট গলি, নিষিদ্ধপল্লি, সরাইখানা, এমনকি গির্জাগুলিতেও ওই মহিলাদের অনুসরণ করা শুরু করে এই দলটি। এ ভাবেই এই দলের নিষিদ্ধ কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা যায়।
কারও কারও মতে, বিষ কিনেছিলেন এমন এক নারী পোপের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি অ্যাকোয়া টোফানা ব্যবহার করে তাঁর স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করছেন। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির বিনিময়ে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। অথবা, কোনও বিষের কারবারী হয়তো পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন, এই ভাবেই পুরো দলটির খোঁজ পাওয়া যায়।
১৬৫৯ সালে অ্যাকোয়া টোফানা তৈরি এবং সরবরাহের সঙ্গে জড়িত পাঁচ জন মহিলাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁদের থেকে বিষ কিনতেন এমন চল্লিশ জন নারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০২৪ সালে ক্যাথরিন কেম্প ‘আ পয়জ়নার্স টেল’ নামে একটি বই লেখেন। সেই বইতেই জুলিয়া টোফানা সম্পর্কে জানা যায়। মনে করা হয়, জুলিয়াই বিশ্বের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার। যদিও, তাঁর বইয়ে ক্যাথরিন প্রশ্ন তুলেছেন যে, জুলিয়া কি কেবলই এক জন খুনি, না কি তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বিপুলসংখ্যক নিগৃহীত নারীর পরিত্রাতা?