কথায় আছে, ঈশ্বর যখন কিছু দেন, তখন দু’হাত ভরে দেন! দক্ষিণ (পড়ুন ল্যাটিন) আমেরিকার দুই দেশ চিলি ও আর্জেন্টিনার জন্য সত্যি হল এই প্রবাদ। চলতি বছর আন্দিজ় পর্বতমালায় নতুন খনি আবিষ্কারে একরকম জ্যাকপট পেয়ে গিয়েছে তারা। ফলে অচিরেই নতুন আর্থিক বিশ্বশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে সান্টিয়াগো এবং বুয়েনাস আইরেস, বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি আন্দিজ় পর্বতমালায় সোনা, রুপো এবং তামার বিপুল ভান্ডারের খোঁজ পায় ভূবিজ্ঞানীদের একটি দল। তাঁদের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে এই তিন ধাতুর এত বড় মজুত আর কখনও পাওয়া যায়নি। যে এলাকায় ওই ‘কুবেরের ধন’ সঞ্চিত আছে তা আর্জেন্টিনার সীমান্তবর্তী সান হুয়ান প্রদেশ এবং চিলির আতাকামা অঞ্চলের অন্তর্গত। সেখানে কত পরিমাণে সোনা, রুপো এবং তামা জমা আছে, তার সম্ভাব্য পরিসংখ্যানও দিয়েছেন ভূতাত্ত্বিকেরা।
ল্যাটিন আমেরিকার পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা এ-হেন ‘কুবেরের ধন’ যেখানে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে তার নাম ভিকুনা। এর হদিস পেতে রাত-দিন এক করে পরিশ্রম করেছে লুন্ডিং মাইনিং এবং বিএইচপি নামে দুই সংস্থা। সংশ্লিষ্ট খনি এলাকায় আনুমানিক ১ কোটি ৩০ লক্ষ টন তামা, ৩ কোটি ২০ লক্ষ আউন্স সোনা এবং ৬৫ কোটি ৯০ লক্ষ আউন্স রুপো মজুত আছে বলে জানিয়েছে তারা। সারা বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি খনিতে এত পরিমাণে পাওয়া যায় এই তিন ধাতু।
লুন্ডিং মাইনিং জানিয়েছে, আন্দিজ়ের সোনা-রুপো-তামার মজুত দু’ভাগে বিভক্ত। একটি অংশের নাম ফিলো ডেল সোল। অপরটি জোসেমারিয়া নামে পরিচিত। প্রথমটিতে সংশ্লিষ্ট তিনটি ধাতুর মজুতের পরিমাণ আনুমানিক ৬০ কোটি টন। এর মধ্যে ১.১৪ শতাংশ তামা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া জোসোমারিয়া থেকে মোট ২০ লক্ষ টন খনিজ সম্পদ পাওয়া যেতে পারে, যার ০.৭৩ শতাংশ তামা হতে পারে বলে জানিয়েছে ওই খনি সংস্থা।
ভূ-বিজ্ঞানীদের দাবি, সংশ্লিষ্ট খনি এলাকা থেকে ওই তিন ধাতু তুলতে কয়েক দশক সময় লেগে যাবে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন লুন্ডিং মাইনিংয়ের ‘চিফ এক্জ়িকিউটিভ অফিসার’ বা সিইও জ্যাক লুন্ডিং। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা আর ভিকুনার তামা উত্তোলনকারী সংস্থা হিসাবে থাকব না। সোনা এবং রুপো উৎপাদনেও বড় ভূমিকা থাকবে আমাদের। এটা দুই দেশের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে।’’
কানাডার বহুজাতিক খনি সংস্থা লুন্ডিং মাইনিংয়ের কর্তাব্যক্তিদের অবশ্য অনুমান, আন্দিজ়ের ভিকুনায় নতুন করে সোনা-রুপো এবং তামার বিপুল ভান্ডারের হদিস মেলায় চিলির থেকে বেশি লাভবান হবে আর্জেন্টিনা। কারণ তামা রফতানিতে ইতিমধ্যেই বিশ্বে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে সান্টিয়াগো। সেই বাজারে এ বার থাবা বসাতে পারবে বুয়েনাস আইরেস।
সবুজ শক্তি উৎপাদন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিন যানবাহনে তামার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই ধাতুটির প্রধান সরবরাহকারী দেশ হল চিলি। বিশ্লেষকদের দাবি, দ্রুত সেখানে আর্জেন্টিনা উঠে এলে বাড়বে প্রতিযোগিতা। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে তামার দাম বেশ কিছুটা কমতে পারে। শুধু তা-ই নয়, নতুন খনি আবিষ্কারে বিপুল কর্মসংস্থান, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং দেশের পরিকাঠামোগত উন্নতির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে আর্জেন্টিনীয় সরকার।
দীর্ঘ দিন ধরেই আর্থিক ভাবে যথেষ্ট খারাপ অবস্থায় রয়েছে বুয়েনাস আইরেস। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী সান হুয়ান প্রদেশে একসঙ্গে সোনা-রুপো-তামার খনির হদিস মেলা তাদের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার শামিল। আর তাই এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়েছে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন। সেখানে এলাকার আর্থিক উন্নতির কথাই বার বার বলতে শোনা গিয়েছে তাঁদের।
আর্জেন্টিনার সান হুয়ান প্রদেশের এক প্রশাসনিক কর্তা বলেছেন, ‘‘খনির জন্য এখানে বিপুল বিনিয়োগ আসবে বলে আমরা আশাবাদী। সীমান্তবর্তী এই এলাকাগুলি যথেষ্টই বঞ্চিত। অর্থের অভাবে আমরা এখানকার বাসিন্দাদের পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। সেই সমস্যা মিটতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে।’’ সান হুয়ানে লগ্নি বাড়লে সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থের সিংহভাগ শিক্ষা, পরিবহণ ও স্বাস্থ্যখাতে খরচ করা হবে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
তবে আন্দিজ়ের ওই এলাকা থেকে সোনা-রুপো ও তামা তুলে আনা একেবারেই সহজ নয়। বিশ্লেষকদের দাবি, এর জন্য দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে আর্জেন্টিনা ও চিলির সরকার। প্রথমত, খনি কাটার কাজ শুরু হলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আন্দিজ়ের বাস্তুতন্ত্র। ফলে পরিবেশ সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই জীববৈচিত্র রক্ষা করার জন্য সরব হতে শুরু করেছে।
দ্বিতীয়ত, খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ এলাকাটিতে রয়েছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। ফলে পাহাড় কেটে সোনা-রুপো-তামা তুলতে হলে তাঁদের জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। আর সেখানেই আইনগত সমস্যার মুখে পড়তে পারে আর্জেন্টিনার সরকার। কারণ, বুয়েনাস আইরেসের আইনে এই ধরনের পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করার ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আর্জেন্টিনীয় প্রশাসন অবশ্য সংশ্লিষ্ট খনির অংশীদারি স্থানীয় আদিবাসীদের দিতে রাজি আছে। আর তাই সরকারের শীর্ষকর্তাদের দাবি, জনজাতিভুক্ত বাসিন্দাদের থেকে জমি পাওয়াটা খুব একটা সমস্যার হবে না। কারণ, সোনা-রুপো-তামার বাণিজ্যিক উত্তোলন শুরু হলে আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকছে তাদের। তবে আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতিতে পদক্ষেপ করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
লুন্ডিং মাইনিংয়ের সিইও জ্যাক আবার জানিয়েছেন, পরিবেশগত বিপর্যয় যাতে না ঘটে সে দিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যেই বর্জ্য জল পরিশোধনের অনুশীলন শুরু করে দিয়েছে তারা। প্রতিবেশী দেশ চিলি এবং পেরুর খনি কোম্পানিগুলিকে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ফলে এ ব্যাপারে তিন দেশের মধ্যে প্রকৌশলগত প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
পৃথিবীর যে কোনও দেশকে আর্থিক ভাবে শক্তিশালী করতে পারে সোনা ও রুপোর ভান্ডার। কারণ, ‘হলুদ ধাতু’কে লগ্নির অন্যতম বড় মাধ্যম বলে মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। অন্য দিকে মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম নির্মাণ ও সৌরশক্তিতে রুপোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। দামি ধাতু হিসাবে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। সে দিক থেকে আর্জেন্টিনার সরকার লাভবান হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্রাজ়িলে ‘ব্রিকস’ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে বুয়েনাস আইরেস সফর করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে আর্জেন্টিনীয় প্রেসিডেন্ট জেভিয়ার মিলেইয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। সেখান হাজির ছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীও। বর্তমানে পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে খবর, মিলেইয়ের সঙ্গে বৈঠকে প্রতিরক্ষা, কৃষি, খনিজ, তেল ও গ্যাস, বাণিজ্য, বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভারত এবং আর্জেন্টিনার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার উপর জোর দেন মোদী। বস্তুত, প্রায় ৫৭ বছর পরে ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী আর্জেন্টিনায় করেছেন দ্বিপাক্ষিক সফর। ফলে আন্দিজ়ের খনি এলাকায় লগ্নির সুযোগ নয়াদিল্লির হাত আসতে পারে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ।
অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ আর্জেন্টিনার উপর গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে পড়ে ‘শনির বক্রদৃষ্টি’। ফলে অচিরেই ছারখার হয়ে যায় সেখানকার অর্থনীতি। ওই অবস্থা থেকে কখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি মেসি-মারাদোনার জন্মভূমি। যদিও ১৯ শতকের একেবারে শেষে কানাডা, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রেস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) চেয়েও ঊর্ধ্বমুখী ছিল সেখানকার আর্থিক বৃদ্ধির সূচক।
সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছর (পড়ুন ২০২৫-’২৬) শেষে আর্জেন্টিনার মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাব্য হার দাঁড়াবে প্রায় ২৪ শতাংশ। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা বুয়েনাস আইরেসের পক্ষে বেশ কঠিন। সদ্য খোঁজ মেলা আন্দিজ়ের সোনা-রুপো-তামার খনি সব খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।