মারাদোনা-মেসির জন্মভূমি। একটা সময়ে কিংবদন্তি ফুটবলারদের মতোই জাদু দেখাচ্ছিল সে দেশের অর্থনীতি। সেই সময়ে ‘সুপার পাওয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুরু হয় তুলনা টানা। কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরতেই উলটপুরাণ! ভাগ্যের ফেরে বর্তমানে দেউলিয়া অবস্থায় পড়ে ধুঁকছে ওই দেশ।
দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা। প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ দেশটি একটা সময়ে উঠেছিল প্রাচুর্যের শিখরে। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে দেশটির উপর পড়ে ‘শনির বক্র দৃষ্টি’! ফলে অচিরেই ছারখার হয়ে যায় সেখানকার অর্থনীতি। ওই অবস্থা থেকে কখনওই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি মেসি-মারাদোনার জন্মভূমি।
১৯৭১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাইমন কুজ়নেৎস। পুরস্কার জেতার পর কুজ়নেৎস তাঁর ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘অর্থনীতির নিরিখে পৃথিবীর দেশগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলি হল, উন্নত অর্থনীতির দেশ, বিকাশশীল দেশ, জাপান এবং আর্জেন্টিনা।’’ সেই সময়ে এতটাই উন্নত ছিল সেখানকার আর্থিক ব্যবস্থা।
মাত্র ১০০ বছর আগেও মারাদোনা-মেসির দেশের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ছিল রীতিমতো হিংসা করার মতো। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির আর্থিক বৃদ্ধির সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এর দুর্দান্ত ভৌগোলিক অবস্থান।
আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রাজ়িল এবং উরুগুয়ে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা জুড়ে রয়েছে প্যাম্পাস তৃণভূমি। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির প্রায় মধ্য ভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ওই অঞ্চলটির মাটি অত্যন্ত উর্বর। এ ছাড়া প্যাম্পাস তৃণভূমির উপর দিয়েই বয়ে গিয়েছে একাধিক নদী। এই সব কিছু আর্জেন্টিকাকে কৃষি ক্ষেত্রে সুজলা সুফলা করেছে।
মেসি-মারাদোনার দেশের সর্ববৃহৎ নদী হল পারানা। এ ছাড়া উত্তর দিকে বয়ে গিয়েছে উরুগুয়ে নদীও। এই দু’টি স্রোতস্বিনীর জল সেচ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে সমান তালে ব্যবহার করেন সেখানকার বাসিন্দারা। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রয়েছে এই দুই নদীর।
আর্জেন্টিনার পশ্চিমে রয়েছে আন্দিজ পর্বতমালা। এই প্রাকৃতিক দেওয়াল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বছরের পর বছর সেখানকার বাসিন্দাদের রক্ষা করে এসেছে। আর পূর্ব দিকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার লম্বা উপকূল রেখা খুলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রাস্তা।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির অর্থনীতির আর একটি বড় মাধ্যম ছিল সামুদ্রিক মাছ শিকার। আর্জেন্টিনার মৎস্যজীবীদের জালে বছরে গড়ে ধরা পড়ত ১০ লক্ষ টন মাছ। এর একটি বড় অংশই বিদেশে রফতানি করতেন তাঁরা। ফলে রাজধানী বুয়েনস আইরেসের কোষাগারে জমা হচ্ছিল বিপুল বিদেশি মুদ্রা।
আর্জেন্টিনার অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক হলেও দেশটির মাটির গভীরে থাকা খনিজ সম্পদের পরিমাণও কম নয়। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম লিথিয়ামের ভান্ডার রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির হাতে। এ ছাড়া রুপো, সোনা, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেলের ক্ষেত্রে বিশ্বের নবম, সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং ৩২তম ভান্ডার রয়েছে সেখানে।
এত কিছু সম্পদ হাতে থাকার জেরে অর্থনৈতিক দিক থেকে আর্জেন্টিনাকে ‘ভগবানের উপহার’ বলে বর্ণনা করেছিলেন বিশ্লেষকদের একাংশ। ১৯ শতকের একেবারে শেষে কানাডা, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রেস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) চেয়েও ঊর্ধ্বমুখী ছিল সেখানকার আর্থিক বৃদ্ধির সূচক।
বুয়েনস আইরেসের জিডিপি বৃদ্ধির নেপথ্যে মূলত ছিল দেশটির কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। বিশ শতকের গোড়ায় বিশ্বের জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করে। অন্য দিকে শিল্পবিপ্লবের জেরে ওই সময়ে খাবারের সঙ্কটে ভুগছিল ইউরোপ-সহ গোটা বিশ্ব। আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আর্জেন্টিনা থেকে শুরু হয় খাদ্যদ্রব্য আমদানি।
এর ফলে খুব অল্প দিনেই ফুলেফেঁপে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির অর্থনীতি। ইউরোপের ধনকুবেরদের একাংশ বিপুল টাকা সঙ্গে নিয়ে সেখানে আসতে শুরু করেন। আর্জেন্টিনাকে ফ্রান্স, ব্রিটেন বা সুইজ়ারল্যান্ডের মতো সাজিয়ে তুলতে সেই অর্থ লগ্নি করেন তাঁরা। অচিরেই বুয়েনস আইরেসের পরিচিত হয় ‘দক্ষিণ আমেরিকার প্যারিস’ হিসাবে।
১৯২০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছুঁয়ে ফেলে আর্জেন্টিনা। ওই সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি ছিল ইউরোপের ধনকুবেরদের কাছে ‘সৌভাগ্যভূমি’। কিন্তু, ৩০-এর দশকে বিশ্ব মন্দার কবলে পড়তেই উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে সেখানকার অর্থনীতি। কারণ, তত দিনে দেশের অধিকাংশ উর্বর জমি চলে গিয়েছে ধনীদের হাতে।
আর্জেন্টিনার ধনকুবেরদের টাকা ধরে রাখার যোগ্যতা ছিল না। অতিরিক্ত লাভের জন্য খাদ্যশস্য রফতানিতেই ছিল তাঁদের নজর। ফলে মন্দার জেরে ইউরোপ তথা বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমলেও নীতির কোনও বদল করেননি তাঁরা। উল্টে টাকা দিয়ে এই সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করতে থাকেন সংশ্লিষ্ট জমি মালিকেরা।
মেসি-মারাদোনার দেশের আর্থিক দুরবস্থার নেপথ্যে দ্বিতীয় কারণ হিসাবে শিল্পের অনগ্রসরতাকে দায়ী করা হয়েছে। খাদ্যশস্য রফতানি থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার জেরে শিল্পোৎপানের দিকে একেবারেই নজর দেয়নি বুয়েনস আইরেসের সরকার ও জনগণ। ফলে বিশ্বে আর্থিক মন্দা আসার পর অর্থনীতিকে বাঁচানোর কোনও রাস্তাই খোলা ছিল না তাঁদের হাতে।
আর্জেন্টিনার দুর্বল অর্থনীতির নেপথ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার ভূমিকাও নেহাত কম নয়। ১৯৩০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল হোসে ফেলিক্স উরিবুরু। কিছু দিন এই ভাবে চলার পর সেখানে গণতন্ত্র ফিরেছিল। কিন্তু ১৯৪৩ সালে ফের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী।
বার বার সেনা অভ্যুত্থানের ফলে আর্জেন্টিনার অর্থনীতির সূচক হু হু করে নামতে থাকে। গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলার নামে রফতানি বাণিজ্যের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকেন সেখানকার সেনাশাসকেরা। আর্জেন্টিনার দরজা অন্যান্য দেশের জন্য একরকম বন্ধই করে দেন তাঁরা।
৬০-এর দশকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির সমস্ত শিল্প সংস্থাগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন সেখানকার সেনাশাসকেরা। ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় আর্জেন্টিনা। ফলে বুয়েনস আইরেস ছাড়তে শুরু করেন ব্যবসায়ী এবং লগ্নিকারীরা।
১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭৬ এবং ১৯৮১ সালে ফের সেনা অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল মেসি-মারাদোনার দেশ। তবে তাতে আর্থিক ব্যাপারে নীতির যে খুব একটা বদল হয়েছিল, এমনটা নয়। সরকার চালানো হোক বা আমজনতাকে খুশি রাখা— দু’টি ক্ষেত্রেই বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছিলেন সেনাশাসকেরা। এতে সরকারি কোষাগারের উপর বাড়ছিল চাপ।
দেশের এই আর্থিক পরিস্থিতিতে ঠিক করতে লাগাতার ঋণ নিতে শুরু করে আর্জেন্টিনার সরকার। পাশাপাশি ঘাটতি দূর করতে বিপুল অঙ্কের টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এতে রাতারাতি আকাশ ছুঁয়ে ফেলে মুদ্রাস্ফীতি। এর হার একটা সময়ে ১২৪ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছিল।
এক দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্য দিকে বিপুল ঋণের চাপ ও মুদ্রাস্ফীতি। জোড়া ফলায় ক্ষতবিক্ষত আর্জেন্টিনায় গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঠিক তখনই ১৯৮২ সালে ফফল্যান্ড দ্বীপ আক্রমণ করে বসেন সেখানকার সেনাশাসকেরা। এই যুদ্ধে সাফল্য তো মেলেইনি, উল্টে জলের মতো খরচ হওয়ায় আরও বিপাকে পড়ে বুয়েনাস আইরেস।
৯০-র দশকে মুদ্রাস্ফীতির জেরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আমজনতার নাগালের বাইরে চলে যায়। ফলে আর্জেন্টিনা জুড়ে শুরু হয় গণবিক্ষোভ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই সময়ে দেখামাত্রই গুলি করার মতো কড়া নির্দেশিকা জারি করেন সেনাশাসকেরা। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) থেকে ফের মোটা অঙ্কের ঋণ নেন তাঁরা।
আইএমএফের থেকে নেওয়া ঋণে গত শতাব্দীর শেষের দিকে কিছুটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কিন্তু প্রতি পাঁচ থেকে ছ’বছর পর ওই টাকা ফেরত দেওয়ার সময় এলেই দেউলিয়া হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ। গত ১০০ বছরে অন্তত ন’বার একেবারে সিন্দুক খালি অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে বুয়েনস আইরেস।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, আসন্ন আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৫-’২৬) আর্জেন্টিনার মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাব্য হার দাঁড়াবে প্রায় ২৪ শতাংশ। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা আর্জেন্টিনার পক্ষে কঠিন। কারণ সে ক্ষেত্রে প্রথমেই খরচ কমানোর দিকে নজর দিতে হবে সেখানকার সরকারকে।
পাশাপাশি, কর বাড়িয়ে এবং কর্মীদের বেতন কমিয়ে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এ ছাড়াও শিল্পোৎপাদনের দিকে নজর দিতে বলেছে তারা। এ ভাবে আর্থিক অবস্থা ঠিক হতে অনেকটা সময় লাগবে। ফলে দেউলিয়া অবস্থা থেকে মেসি-মারাদোনার দেশ আদৌ বেরিয়ে আসতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।