বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ ও বিপজ্জনক পেশার সঙ্গে জড়িত তাঁর নাম। নৃশংস অপরাধের জায়গা, আত্মহত্যা, বিস্ফোরণ এলাকা বা দুর্ঘটনার অকুস্থলে ডাক পড়ে তাঁর। রক্তের নদী, পচাগলা দেহ, হাড়গোড় সাফ করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এমন সমস্ত জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয়েছে তাঁকে, যা সাধারণের কল্পনার অতীত।
এক-আধ দিন নয়, ২৫ বছর ধরে এই ভয়াবহ কাজটি করে আসছেন ব্রিটেনের বাসিন্দা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য দক্ষতার জন্য পরিচিত বেন জাইলস। ব্রিটেনের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর’ তকমা সেঁটে গিয়েছে তাঁর নামের পাশে।
মার্চ মাসের বিকেলে ওয়েলসের কার্ডিগানের বেনের কার্যালয়ে একটি ফোন আসে। তড়িঘড়ি ছুটে আসতে বলা হয় তাঁকে। অকুস্থল লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডের একটি থিয়েটার। প্রবেশপথে মানুষের মল ও রক্তের ছড়াছড়ি। আধ ঘণ্টার মধ্যে একটি অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা। সেই নারকীয় পরিবেশ আধ ঘণ্টার মধ্যে ঝকঝকে করে তোলেন বেনের সংস্থা আলটিমার কর্মীরা।
পুরো কর্মজীবন জুড়ে, বেন এমন অনেক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন যা বেশির ভাগ মানুষ হয়তো সহ্য করতে পারবেন না। পরিষ্কার করেছেন জমাট বাঁধা রক্ত, শরীরের অংশ, প্রস্রাব, বমি এবং চাপ চাপ শ্লেষ্মা। তবে, যে সব কারণে তাঁর ডাক পড়ে, তার বিস্তারিত বিবরণ সব সময় গোচরে আসে না বেনের। সে কারণে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করেন।
বয়লার স্যুট এবং প্লাস্টিক বুট পরা বেন শিখেছিলেন কী ভাবে সংঘর্ষে, বিক্ষোভে ছিটকে পড়া দেহ উদ্ধার করে আনতে হয়। বিস্ফোরণ, আগুনের রক্তাক্ত পরিবেশ ঝকঝকে করে তুলতে হয়। বেশির ভাগ প্রমাণ মুছে ফেলতে হয়। দীর্ঘ কেরিয়ারের কারণে এক জন স্বশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন বেন। প্রতি দিন এই ধরনের ঘটনা তাঁর তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
২৫ বছরের কর্মজীবনে নিয়মিত মানবশরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজের হাতে তুলে সাফ করেছেন তিনি। শক্ত কফ থেকে শুরু করে রক্ত, প্রস্রাব পর্যন্ত প্রতিটি শারীরিক তরলের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি জানিয়েছেন, একটি সাবমেরিন ইয়ার্ডের মেঝে থেকে বীর্যের স্তর তুলে ফেলার মতো কাজও তাঁকে করতে হয়েছে।
যখন প্রথম কাজ শুরু করেন তখন যানবাহন পরিষ্কার করার জন্য নিযুক্ত এক জন আনাড়ি তরুণ হিসাবে বেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করতেন। শুধুমাত্র চুরি যাওয়া গাড়ির ভেতর থেকে আঙুলের ছাপের ধুলো অপসারণের জন্য। সেই বেন এখন মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে ভয়ঙ্করতম ঘটনার স্থল থেকে প্রমাণ লোপাট করে দিতে পারেন।
২০ বছর বয়সে তিনি ৫০ পাউন্ড কড়ারে প্রতিটি জানলার কাচ পরিষ্কার করতেন। সেই সময় তাঁর এক গ্রাহক ছিলেন যিনি অ্যাবেরিস্টউইথে থাকতেন। সেই মহিলা তাঁকে একটি ফাঁকা বাড়ি পরিষ্কার করার প্রস্তাব দেন। বেন যখন বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করেন তখন তাঁর চোখের সামনে এমন একটি দৃশ্য ভেসে ওঠে যা দেখে যে কারওরই অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসতে বাধ্য।
বেন দেখতে পান যে একটি বাথটব রয়েছে সেখানে। কানায় কানায় প্রস্রাব এবং ময়লা দিয়ে ভরা। এই সমস্ত খালি করার জন্য কত টাকা নেবেন জানতে চাইলে তিনি ২ হাডার পাউন্ড চেয়েছিলেন। সেই প্রথম শুরু। প্রথম কাজটি করে আফসোস করেছিলেন। তিনি মনে করেন, আরও বেশি টাকা চাইতে পারতেন।
৪৯ বছরের বেনকে এখন অপরাধের দৃশ্য, দুর্ঘটনাস্থল, পচাগলা মৃতদেহ পরিষ্কার করার জন্য আর বিশেষ বেগ পেতে হয় না। অবশ্য তাঁর এই মানসিক দৃঢ়়তা শৈশবেই তৈরি হয়ে গেছিল। মা-বাবার সঙ্গে খামারবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে তাঁর বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়। খামার মালিক ও কৃষক পরিবারে বড় হয়ে ওঠা বেনের প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে ছিল কার্পেট থেকে পশুর মল পরিষ্কার করা।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় জৈব-ঝুঁকি পরিষ্কার বিশেষজ্ঞ হিসাবে যে পেশা তিনি বেছে নিয়েছিলেন তার জমি প্রাথমিক ভাবে প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছে শৈশবের এই অভিজ্ঞতাই।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কয়েক জন সঙ্গীকে নিয়ে বেন ‘জাইলস ক্লিনিং’ শুরু করেন। সংস্থাটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এর নাম পরিবর্তন করে ‘আলটিমা’ রাখেন। শীঘ্রই ব্রিটেনের শীর্ষ স্থানীয় জৈব-ঝুঁকিমুক্ত পরিচ্ছন্নতা পরিষেবায় পরিণত হয় সংস্থাটি। পরবর্তী কালে আলটিমাকে ‘অ্যাটলাস এফএম’ অধিগ্রহণ করে।
প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা মূল্যের এই সংস্থায় বেন এখন এক জন পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেন। মাঝেমাঝে অপরাধের দৃশ্যস্থল পরিদর্শন করেন। ২০১০ সালে একটি প্রশিক্ষণ সংস্থা শুরু করেছিলেন তিনি। যেখান থেকে প্রায় ৬০০ জন ‘ফ্রিল্যান্স ক্লিনারের’ একটি বিশাল দল তৈরি হয়েছে। সেই দলের সদস্যেরা বেনের একটি ফোনেই দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যেতে পারেন।
প্রাথমিক ভাবে একটি ঘটনা বেনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। কয়েক বছর আগে একটি ঘর পরিষ্কার করতে ডাকা হয়েছিল বেনকে। যেখানে এক ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করেন। রান্নাঘরের ড্রয়ারের ভেতরেও রক্তের ছিটে পৌঁছে গিয়েছিল। বেন পরে সংবাদমাধ্যমে বর্ণনা করেন, ‘‘এক জন বিবাহিত পুরুষ হিসাবে আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারিনি। রক্ত রান্নাঘরের ড্রয়ার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সেই অভিজ্ঞতা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।’’
জীবনে সবচেয়ে অদ্ভুত কোন জিনিসটির মুখোমুখি হতে হয়েছে বেনকে? ২০১৯ সালের ঘটনা সেটি। একটি ২২ মিটার লম্বা তিমি পণ্যবাহী জাহাজে ধাক্কা খেয়ে নোঙরে আটকে গিয়েছিল। পচন শুরু করেছিল সেটি। পোর্টসমাউথ বন্দরে সেটিকে আনা হয়। এই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না বেন ও সহকর্মীদের। পরে মৃত স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে বৈদ্যুতিন করাত দিয়ে সাবধানে কেটে টুকরো টুকরো করে জাহাজ থেকে অপসারণ করা হয়।
আপাতত এই দুনিয়া থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন বেন। সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার পর বেন একটি ইটালীয় রেস্তরাঁ কিনেছেন। একপাল গরু পুষছেন তিনি। প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমান শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়লে পরামর্শের জন্য ফোন করেন তাঁকে। বিশেষজ্ঞ হিসাবে তাঁর মতামত পাওয়ার জন্য বিদেশ থেকেও বহু বার অনুরোধ এসেছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন নিয়মকানুন রয়েছে, তাই তিনি সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি কখনও।