বিদ্রোহের আগুনে পুড়ছে বালোচিস্তান। মুহুর্মুহু আক্রমণ শানিয়ে পাকিস্তানের সরকার এবং সেনাকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশটির ‘বালোচ লিবারেশন আর্মি’ বা বিএলএ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের অতর্কিত হামলায় এ বার হাতছাড়া হল আস্ত একটা শহর। এমনটাই দাবি বিএলএ-র। ধীরে ধীরে কি গোটা এলাকার উপর থেকে রাশ আলাগা হচ্ছে ইসলামাবাদের? এই সমস্ত প্রশ্নে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
চলতি বছরের ৩০ মে বালোচিস্তানের সুরাব শহর কব্জা করার কথা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দেয় বিএলএ। এর পরই সমাজমাধ্যমে সেখানকার একাধিক ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে। তাতে সুরাবের বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন এবং থানা থেকে ঘন কালো ধোঁয়া বার হতে দেখা গিয়েছে। এ ছাড়া বিএলএ যোদ্ধাদের হাতিয়ার হাতে শহরের মধ্যে টহল দেওয়ার ছবিও প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও ভিডিয়োগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম।
বিএলএ-র জারি করা প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বিদ্রোহীরা সুরাব শহরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাঙ্ক, থানা এবং সরকারি ভবন কব্জা করেছে তারা। এলাকা পুনর্দখলে পাক ফৌজ যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলিকে আটকেছে বিদ্রোহীরা। বালোচিস্তানের ওই এলাকার কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে বিএলএ-র দাবি সত্যি হলে ইসলামাবাদের রক্তচাপ যে বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
সুরাব থেকে বালোচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার দূরত্ব মেরেকেটে ১৫০ কিলোমিটার। এই শহরের উপর থেকে গিয়েছে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। সেগুলি হল, কোয়েটা-করাচি এবং সুরাব-গিদার মহাসড়ক। বিএলএ-র দাবি, এই দু’টি রাস্তায় টহল দিচ্ছে বিদ্রোহীরা। রাস্তাগুলির বিস্তীর্ণ এলাকা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্রোহী কমান্ডারেরা জানিয়েছেন, সুরাবে হামলা চালানোর সময় স্থানীয় পুলিশ ও আধাসেনা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, সাঁড়াশি আক্রমণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিএলএ-র গুলিতে প্রাণ হারান স্থানীয় থানার এক স্টেশন হাউস অফিসার (এসএইচও)। এর পর থানায় ঢুকে যাবতীয় হাতিয়ার লুট করে বিদ্রোহীরা। পুলিশ আধিকারিকের হত্যার ঘটনাকে অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেছে বিএলএ।
সূত্রের খবর, ৩০ মে সন্ধ্যায় অতর্কিতে সুরাবের উপর আক্রমণ চালায় বিএলএ। ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সরকারি ভবনগুলিতে ঢুকে পড়ে তারা। এর পর সেখানকার আধিকারিক ও কর্মচারীদের একাংশকে পণবন্দি করে। পর পর গাড়িতে ধরিয়ে দেয় আগুন। তখনই স্থানীয় থানা থেকে পুলিশকর্মীরা এলে দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় গুলির লড়াই। এতে বেশি ক্ষণ উর্দিধারীরা টিকতে পারেননি। সেখান থেকে দ্রুত চম্পট দিতে হয় তাদের।
সমাজমাধ্যমে এই ঘটনার যে ভিডিয়োগুলি ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে অবশ্য এলাকাবাসীকে আতঙ্কে কুঁকড়ে যেতে দেখা যায়নি। উল্টে বিএলএ যোদ্ধাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁরা। বিদ্রোহীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে স্থানীয়দের কেউ কেউ নিজস্বীও তোলেন। বিশ্লেষকদের দাবি, পাকিস্তানের থেকে আলাদা হতে বালোচরা যে কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে এই ঘটনাতেই তার প্রমাণ মিলেছে।
২০২৩ সালের জনগণনা অনুযায়ী সুরাবের জনসংখ্যা ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার। বালোচ বিদ্রোহীরা সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসলে আগামী দিনে কোয়েটা আক্রমণ করতে পারে তাঁরা। আর তাই সেই ঝুঁকি নিতে রাজি নন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই অবরুদ্ধ শহরটিকে পুনর্দখল করতে ফ্রন্টিয়ার কোরকে সেখানে পাঠিয়েছেন তাঁরা। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
গত মাসে বালোচ বিদ্রোহীদের নিয়ে তৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। মুক্তিযোদ্ধাদের পিষে মারতে বাহিনীর খুব বেশি সময় লাগবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এতে ফল হয় হিতে বিপরীত। গত ১৪ মে স্বাধীন ‘রিপাবলিক অফ বালোচিস্তান’ গঠনের কথা ঘোষণা করেন সেখানকার বিদ্রোহীরা। ইসলামাবাদের থেকে স্বাধীনতা পেতে ভারতের কাছে সরাসরি সাহায্য চাইতেও দ্বিধা করেনি ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
এ বছরের ৯ মে বালোচিস্তানের কালাত জেলার মাঙ্গোচর এলাকা দখলের কথা জানিয়েছিল বিএলএ। ঠিক তার পরের দিন এই নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির মুখপাত্র জিয়ান্দ বালোচ। তাঁর কথায়, ‘‘কালাতের ৩৯টি জায়গায় পাক ফৌজের উপর হামলা চালিয়েছে বিএলএ-র ফতেহ্ স্কোয়াড। স্থানীয় থানা, ডাকঘর, সরকারি ভবন এবং সেনা কনভয়কে নিশানা করা হয়েছে।’’ মাঙ্গোচরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি তাঁদের কব্জায় রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন জিয়ান্দ বালোচ।
৯ তারিখের ওই ঘটনাতেও মুখ কুলুপ এঁটেছিল পাক সেনা ও সরকার। ওই সময়ে ভারতীয় ফৌজ ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালানোয় গোটা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায় ইসলামাবাদ। তাতে অবশ্য বিএলএ চুপ করে থাকেনি। বিস্ফোরণে পাক সেনার গাড়ি ওড়ানোর ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় তারা।
বিশ্লেষকদের দাবি, ভারত-পাক সংঘাতের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতার জন্য ‘অপারেশন হেরফ ২.০’ শুরু করেছে বিএলএ। এর জন্য বেছে বেছে বালোচিস্তানের কয়েকটি জেলাকে নিশানা করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে স্থানীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখে হামলা করছে তারা। এক কথায় গেরিলা যুদ্ধে পাক ফৌজের জওয়ান ও অফিসারদের নিকেশ করছে বিদ্রোহীরা।
গত ১০ মে বালোচিস্তানের খুজদার জেলার ওরনাচ ক্রস এলাকায় জাতীয় সড়কের দখল নেয় বিএলএ। ওই সময়ে গাড়ি-ট্রাক আটকে রেখে তল্লাশি চালায় বিদ্রোহীরা। বালোচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ বহনকারী গাড়িগুলিকে আটক করে তারা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই দিনই ‘যুদ্ধবিরতি’তে সম্মত হয় ভারত ও পাকিস্তান। অন্য দিকে, জাতীয় সড়কের দখল নিয়ে ১৩ মে প্রেস বিবৃতি জারি করে বিএলএ।
খুজদারে সাফল্য পাওয়ার পর বালোচ বিদ্রোহীরা যে থেমে ছিলেন, এমনটা নয়। ১১ মে রাতে পাঞ্জগুরের নোকাবাদে অতর্কিতে হামলা করে পাক সেনাবাহিনীর একটি পোস্ট দখলের চেষ্টা করে তারা। বিএলএ-র মুখপাত্র জিয়ান্দা জানান, ‘‘দখলদার ফৌজের উপর রকেট লঞ্চার এবং গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ শানানো হয়। এতে কমপক্ষে দু’জন নিহত এবং পাঁচ জন আহত হন।’’ টানা ২৫ মিনিট ধরে গুলিবর্ষণে ওই পাক পোস্টটির বেশ ক্ষতি হয়েছিল।
বালোচিস্তানের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির রয়েছে নিজস্ব গুপ্তচর বাহিনী। বিশ্লেষকদের দাবি, সেই কারণে তাঁদের কব্জা করতে হিমশিম খাচ্ছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি অফিসারেরা। এ ব্যাপারে পাক গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স’ বা আইএসআইকেও টেক্কা দিয়েছে বিএলএ-র গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। বালোচিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে প্রাণ গিয়েছে ইসলামাবাদের চার এজেন্টের।
তবে ইসলামাবাদ থেকে বালোচিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মোটেই সহজ নয়। কারণ, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এই প্রদেশটির একাধিক গুপ্তঘাঁটিতে পাক ফৌজ পরমাণু হাতিয়ার সাজিয়ে রেখেছে বলে মনে করেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। ফলে কোনও অবস্থাতেই একে হাতছাড়া করতে চাইবেন না রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা।
অন্য দিকে, বালোচিস্তানের সঙ্গে বেজিঙের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। কারণ পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’র (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর বা সিপিইসি) কাজ চালাচ্ছে ড্রাগন সরকার। এর জন্য কয়েকশো কোটি ডলার লগ্নি করেছে চিন। সংশ্লিষ্ট রাস্তাটির বড় অংশ বালোচিস্তানের মধ্য দিয়ে গ্বদর বন্দরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এই অবস্থায় প্রদেশটি পাকিস্তানের থেকে আলাদা হয়ে গেলে চিনের বিনিয়োগ করা কয়েক কোটি ডলার যে জলে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা ছাড়া আর্থিক দিক থেকে ভারতকে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে বেজিং। সেই কারণে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীনও ইসলামাবাদকে কখনও প্রকাশ্যে, কখনও আবার আড়ালে থেকে সমর্থন করে গিয়েছে ড্রাগনভূমির শি জিনপিং সরকার।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বালোচ বিদ্রোহী বা আন্দোলনকারীরা তিনটি দেশ ভেঙে স্বাধীন হতে চাইলে ভারতের পক্ষে তাঁদের সরাসরি সমর্থন করা বেশ কঠিন হবে। কারণ, ইসলামাবাদের উপর চাপ বজায় রাখতে ইরান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে কখনওই সম্পর্ক খারাপ করার রাস্তায় হাঁটবে না নয়াদিল্লি।