সিনেমা বানানোর স্বপ্ন ছিল তাঁর। ষাট থেকে সত্তরের দশকের মধ্যে প্রচুর ছবি বানিয়েওছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিষ্ঠিতমহলে তাঁকে বিশেষ কেউ চিনতেন না। ‘বি গ্রেড’ ছবি বানিয়ে রোজগারও তেমন হত না পরিচালকের। শেষমেশ নামকরা বলি অভিনেতাকে নিয়ে দুর্দান্ত একটি ছবি তৈরির চিন্তাভাবনা করেছিলেন পরিচালক। কিন্তু মাঝপথে কাজ ছেড়ে দিয়ে কামরান খানকে ঋণের ভরাসমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সেই বলি অভিনেতা।
দারা সিংহের মতো কুস্তিগির-অভিনেতাকে নিয়ে একাধিক অ্যাকশন ঘরানার ছবি তৈরি করেছিলেন কামরান। কেরিয়ারের ঝুলিতে ছবির সংখ্যা প্রচুর হলেও জনপ্রিয়তা তেমন ছিল না কামরানের। তাই হিন্দি চলচ্চিত্রজগতে ‘জাতে ওঠার’ জন্য অন্য ধরনের ছবি বানাতে চেয়েছিলেন কামরান।
বলিপাড়ার একাংশের দাবি, ভাল ছবি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে বাজেটের দিক থেকে কোনও রকম কার্পণ্য করেননি কামরান। নিজের জমানো সব টাকাপয়সা ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি, নিজের সম্পত্তিও বন্ধক রেখেছিলেন।
শোনা যায়, নিজের ছবির অভিনেতা হিসাবে সঞ্জীব কুমারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন কামরান। পরিচালকের প্রস্তাবে অভিনয় করতে রাজিও হয়ে গিয়েছিলেন সঞ্জীব। কিন্তু শুটিংয়ের মাঝপথে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলেন তিনি। মাঝপথে ছবি থেকে নিজেকে হঠাৎ সরিয়ে নিয়েছিলেন সঞ্জীব।
ছবির জন্য নিজের সব জমানো টাকা খরচ করে ফেলেছিলেন কামরান। এ দিকে সিনেমার শুটিং শেষ না হওয়ায় কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। কামরান এমন লোকসানের মুখে পড়েছিলেন যে, তাঁর কাঁধে ঋণের মস্ত বোঝা চেপে বসেছিল। এত টাকা কী ভাবে শোধ করবেন সেই চিন্তায় ডুবে থাকতেন তিনি।
কামরানের কন্যা ফারহা খান এবং পুত্র সাজিদ খান তখন কৈশোরে। তবে বাবা যে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন দু’জনে।
অর্থাভাবের চিন্তায় নাকি নিজেকে গৃহবন্দি করে ফেলেছিলেন কামরান। ১৩-১৪ বছর তিনি তেমন কোনও কাজ করেননি। ধীরে ধীরে মদের নেশায় ডুবে যেতে থাকেন তিনি। এমনকি, তাঁর বৈবাহিক জীবনেও চিড় ধরতে শুরু করেছিল।
কামরানের কন্যা ফারহা এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি ছোটবেলায় যা চাইতেন, তা-ই পেতেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আর্থিক পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল। বাড়ির পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, তখন আর বাড়িতে থাকতে ভাল লাগত না তাঁর।
ফারহা বলেছিলেন, ‘‘সিনেমাই আমার মন ভাল রাখত। বাড়িতে থাকলে শুধু বাবা-মায়ের ঝগড়া। এত অশান্তি সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু তিন ঘণ্টা যখন প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকতাম, তখন মনে হত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সময় কাটাচ্ছি।’’
মৃত্যুর সময় কামরানের কাছে পুঁজি বলতে না কি মাত্র ৩০ টাকা ছিল। এমনকি, কামরানের শেষকৃত্যের জন্যও তাঁর পরিবারের কাছে টাকাপয়সা ছিল না। আত্মীয়দের কাছে টাকা ধার করতে বেরিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলিপাড়ার এক জনপ্রিয় ছবিনির্মাতা।
কামরানের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব ছিল সেলিম খানের। বন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের এমন আর্থিক পরিস্থিতি দেখে কামরানের শেষকৃত্যের সম্পূর্ণ খরচ সেলিম বহন করেছিলেন।
ফারহার চেয়ে তিন বছরের ছোট সাজিদ। বাবার মৃত্যুর পর তাঁরা হিসাব করে দেখেছিলেন যে, তাঁদের মাথার উপর তিন লক্ষ টাকার ঋণ রয়েছে। সেই ঋণ শোধ করতে গাড়ি, মায়ের গয়না, দামি আসবাব সব কিছু বিক্রি করে দিতে হয়েছিল তাঁদের।
১৯৮৪ সাল। মাথার উপর শুধুমাত্র ছাদ ছিল ফারহা এবং সাজিদের। তাঁদের মা রোজগারের জন্য কাজ শুরু করলেন। মাকে সাহায্য করতে দুই ছেলেমেয়েও রোজগারের পথ খুঁজতে লাগলেন। ফারহা নাচ করতে শুরু করলেন। সেখান থেকেই উপার্জন শুরু কামরানের কন্যার।
সাজিদ লোকজনকে নকল করে হাসাতে পারতেন। সেই গুণকেই নিজের পেশা বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। জন্মদিনের পার্টিতে ‘মিমিক্রি’ করে পয়সা রোজগার করতেন তিনি।
কখনও কখনও মুম্বইয়ের সমুদ্রসৈকতে গিয়ে ‘মিমিক্রি’ করে বাড়তি রোজগার করতেন সাজিদ। দিদিকে বেশির ভাগ পয়সা দিয়ে কিছু টাকা সিনেমা দেখবেন বলে জমিয়ে রাখতেন।
ফারহা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘একসময় আমাদের মাথার উপর শুধু একটা ছাদ ছিল। ঘরে দুটো সোফা আর একটা ফ্যান। কী ভাবে এত ঋণ শোধ করব তা বুঝে উঠতে পারতাম না।’’
ফারহার কথায়, ‘‘ঋণ শোধ করার জন্য আমাদের বাড়ির বসার ঘর ভাড়া দিয়ে দিতাম। লোকজন আসত, খাওয়াদাওয়া করত, পার্টি করত। ভাড়া বাবদ কিছু টাকা পেতাম। তা জমিয়ে রাখতাম। ধীরে ধীরে আমরা তিন জন মিলে সমস্ত ঋণ শোধ করে দিই।’’