অস্ত্র ব্যবসায় ফের ‘তীরে এসে তরী ডুবল’! সূত্রের খবর, ভারতের থেকে হাতিয়ার কেনার ব্যাপারে আলোচনা আপাতত স্থগিত করেছে ব্রাজ়িল। শুধু তা-ই নয়, মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির ইউরোপের সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলার সম্ভাবনাও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানির ক্ষেত্রে বড়সড় ধাক্কা খাবে কেন্দ্র। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এর আগে ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও একই রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে নয়াদিল্লিকে।
সম্প্রতি, আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পেতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিল ব্রাজ়িল। নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও-র (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন) নকশায় তৈরি এই হাতিয়ারটির শক্তি ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে পাকিস্তান। তার পরই অস্ত্রের বাজারে আকাশকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। দ্রুত একে বাহিনীতে শামিল করতে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্রাজ়িল।
সব কিছু যখন সরলরেখায় চলছিল, তখন হঠাৎই ছন্দপতন। জানা যায় ইউরোপীয় সংস্থা এমবিডিএ-র থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) কিনতে চলেছে ব্রাজ়িল। বহুজাতিক ওই কোম্পানিটির ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইটালিতে। এই তিন দেশের যৌথ মালিকানায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাটিকে গড়ে তোলা হয়েছে। ব্রাজ়িলকে তারা যে হাতিয়ারটি সরবরাহ করবে তার পোশাকি নাম ‘বর্ধিত মডিউলার এয়ার ডিফেন্স সলিউশন’ বা ইএমএডিএস (এনহ্যান্সড মডিউলার এয়ার ডিফেন্স সলিউশান)।
এই সংক্রান্ত খবর প্রথম বার প্রকাশ্যে আনে ‘সিএনএন ব্রাসিল’। ব্রাজ়িলীয় ফৌজের এক পদস্থ কর্তাকে উদ্ধৃত করে তারা জানিয়েছে, ‘বর্ধিত মডিউলার এয়ার ডিফেন্স সলিউশান’ হাতে পেতে এমবিডিএ-র সঙ্গে ৫০০ কোটি রিঙ্গিতের চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। মার্কিন মুদ্রায় যেটা প্রায় ৯২ কোটি ডলার। ভারতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন সংশ্লিষ্ট সেনা অফিসার।
‘সিএনএন ব্রাসিল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রাজ়িলীয় সেনাবাহিনীর দাবি আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের পুরনো সংস্করণ বিক্রি করতে আগ্রহী ভারত। এর পাল্লা মাত্র ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার। অন্য দিকে, ইউরোপীয় সংস্থাটি তাদের বর্ধিত পাল্লার কমন অ্যান্টি-এয়ার মডিউলার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে চাইছে। এর পাল্লা ৪০ কিলোমিটারের বেশি। সেই কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়ে ভারত ডায়ানামিক্স লিমিটেড ও ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে তৈরি আকাশ।
বর্ধিত পাল্লার কমন অ্যান্টি-এয়ার মডিউলার ক্ষেপণাস্ত্র বা সিএএমএম-ইআরে (কমন অ্যান্টি-এয়ার মডিউলার মিসাইল-এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ) রয়েছে রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি সিকারের সুবিধা। যে কোনও আবহাওয়ায় কাজ করতে সমান ভাবে দক্ষ সংশ্লিষ্ট হাতিয়ার। ক্ষেপণাস্ত্রটি লম্বায় ৪.২ মিটার, ওজন ১৬০ কেজি এবং সুপারসনিক গতিতে ছোটার ক্ষমতা রয়েছে এর।
অন্য দিকে, ১০০ মিটার থেকে ২০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকায় শত্রুর যে কোনও ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, সামরিক হেলিকপ্টার এবং ড্রোনকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের আকাশের। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিকে চালানোর জন্য একটি কমান্ড গাইডেন্স সিস্টেমের প্রয়োজন হয়। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ করার দক্ষতা রয়েছে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের। ইলেকট্রনিক যুদ্ধকে মোকাবিলা করার জন্য এর ভিতরে নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে।
৫.৮৭ মিটার লম্বা এবং ৩৫০ মিলিমিটার ব্যাস যুক্ত আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন ৭১০ কিলোগ্রাম। স্থানীয় গণমাধ্যম ‘দ্য রিও টাইমস’ জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ এর উন্নত শ্রেণিটি ব্যবহার করেছে ভারতীয় ফৌজ। তার কার্যকারিতা অনেক বেশি ভাল। ব্রাজ়িলের আকাশকে সুরক্ষিত করতে ওই ধরনের সিস্টেমের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু নয়াদিল্লি সে ব্যাপারে এখনও কোনও আগ্রহ দেখায়নি। সেই কারণে ইউরোপীয় সংস্থাটির দিকে নজর দিতে বাধ্য হয় প্রেসিডেন্ট লুইজ় ইনাসিও লুলা দ্য সিলভার সরকার।
২০১৮ সাল থেকে বর্ধিত পাল্লার কমন অ্যান্টি-এয়ার মডিউলার ক্ষেপণাস্ত্র বা সিএএমএম-ইআর ব্যবহার করছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। এ ছাড়া মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটোভুক্ত একাধিক দেশে মোতায়েন রয়েছে এমবিডিএ নির্মিত এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সেই তালিকায় অবশ্যই আসবে পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডের নাম।
গত বছর ভারতের থেকে পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার (এমবিআরএল) কিনে নেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করে ‘বন্ধু’ ফ্রান্স। কিন্তু গত এপ্রিলে জানা যায় সেই সিদ্ধান্ত থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ ও তাঁর প্রশাসন। উল্টে নিজস্ব প্রযুক্তিতে একই ধরনের সমরাস্ত্র তৈরিতে মন দিয়েছে নেপোলিয়নের দেশ। ফলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানিতে ইউরোপের বাজারে পা ফেলার স্বপ্ন যে নয়াদিল্লির এখনই পূরণ হচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য।
কেন হঠাৎ পিনাকার ব্যাপারে মনবদল করল ফরাসি সরকার ও সেনা? বিশ্লেষকদের দাবি, এর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে বিদেশি নির্ভরতা কমাতে চাইছে প্যারিস। বিষয়টি নিয়ে জোরালো সওয়াল করেছেন সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। আর তাই ঘরের মাটিতে প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং শিল্পের উপর জোর দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মাকরঁ।
দ্বিতীয়ত, ২০০৫ সাল থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রকেট ব্যবহার করে আসছে মার্কিন গোলন্দাজ বাহিনী। সেগুলির পোশাকি নাম এম১৪২ হিমার্স (হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম)। এই সমরাস্ত্রের ইউরোপীয় সংস্করণ প্রায় তৈরি করে ফেলেছে ফ্রান্স। সূত্রের খবর, সেই কারণেই পিনাকার থেকে আপাতত মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে মাকরঁ সরকার।
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী বছরের মাঝামাঝি নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা করবেন ফরাসি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন সেখানকার ডিরেক্টর জেনারেল অফ আর্মামেন্ট (ডিজিএ)। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরও উন্নত হাতিয়ার তৈরি করতে চাইছি। সেটা আগামী বছরের মাঝামাঝি শেষ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে।’’
আমেরিকার বিখ্যাত প্রতিরক্ষা সংস্থা লকহিড মার্টিনের হাত ধরে প্রাণ পেয়েছে হিমার্স। এর সাহায্যে ৪৮০ কিলোমিটার দূরের শত্রুঘাঁটিতে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে পারে মার্কিন গোলন্দাজ বাহিনী। হিমার্স চালাতে অন্তত তিন জন সৈনিকের প্রয়োজন। একসঙ্গে একগুচ্ছ রকেট ছোড়ার পাশাপাশি কৌশলগত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সুবিধাও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেমে।
গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ ফৌজের দ্রুত এগিয়ে আসা রুখে দিয়ে খবরের শিরোনামে চলে আসে হিমার্স। অতীতে আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইরাকের লড়াইয়ে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির বহুল ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে মার্কিন গোলন্দাজ় বাহিনীকে। দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস অবশ্য জানিয়েছে, ফ্রান্স যে হিমার্সের ইউরোপীয় সংস্করণ তৈরি করছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতটা শক্তিশালী নয়।
সূত্রের খবর, ফরাসি হাতিয়ারটির পাল্লা হবে ১৫০ কিলোমিটার। ইতিমধ্যেই এর নমুনা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে প্যারিসের দু’টি প্রতিরক্ষা সংস্থা। সেগুলি হল, থ্যালেস অ্যান্ড আরিয়ান গ্রুপ এবং সাফরান অ্যান্ড এমবিডিএ।
গত বছর ভারত সফরে এসে প্রথম বার পিনাকার প্রসঙ্গ তোলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্টিফেন রিচু। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই সমরাস্ত্রটি খুব খুঁটিয়ে মূল্যায়ন করছি। কারণ আমাদের বাহিনীর এই ধরনের হাতিয়ার খুবই প্রয়োজন।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পরই পিনাকাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে বলে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে প্যারিস কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় হাত খালিই রইল নয়াদিল্লির।
ভারতের সঙ্গে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে দর কষাকষির ব্যাপারে অবশ্য সরকারি ভাবে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ব্রাজ়িলের লুলা সরকার। অন্য দিকে, নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারের প্রযুক্তি হাতে পেতে আগ্রহী। সেই ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। অর্থাৎ, এখনও এ ব্যাপারে ক্ষীণ আশা টিকে আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, প্রতিরক্ষা শিল্পে ভারতের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ব্যাপারে প্রবল উৎসাহী ব্রাজ়িল।
ফ্রান্সের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও ইউরোপের বাজারে অস্ত্র বিক্রির চেষ্টায় কোনও ত্রুটি করছে না নয়াদিল্লি। সম্প্রতি, ভারত এবং গ্রিসের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে চলেছে বলে হইচই বাধিয়েছে তুরস্কের একাধিক গণমাধ্যম। আঙ্কারার সংবাদসংস্থাগুলির দাবি, নয়াদিল্লির থেকে দূরপাল্লার ভূমি থেকে আক্রমণকারী ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বা এলআর-এলএসিএম (লং রেঞ্জ-ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ় মিসাইল) কিনতে চলেছে আথেন্স। এজ়িয়ান সাগর সংলগ্ন এলাকায় সেগুলিকে মোতায়েন করবে গ্রিক ফৌজ।
গত বছরের নভেম্বরে এলআর-এলএসিএমের সফল পরীক্ষা করে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। টার্বোফ্যান ইঞ্জিন পরিচালিত ওই ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ছিল ১,৫০০ কিলোমিটার। মূলত রেডার স্টেশন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) এবং কৌশলগত সামরিক পরিকাঠামো ধ্বংস করতে এর নকশা তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এই হাতিয়ারের প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে ভারত ও গ্রিসের মধ্যে কোনও আনুষ্ঠানিক সমঝোতা অবশ্য এখনও হয়নি।
বিশ্বের অস্ত্রের বাজারে আমেরিকা, রাশিয়া, পশ্চিম ইউরোপের একাধিক দেশ এবং চিনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, সেখানে ভারতকে কিছুতেই জায়গা ছেড়ে দিতে নারাজ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির যাবতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা। আর তাই ফ্রান্স বা ব্রাজ়িলকে হাতিয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে বার বার বাধার মুখে পড়ছে নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে আরও সাবধানি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।