বঙ্গোপসাগরে মটরদানার মতো ছোট্ট একটা দ্বীপ। সেখানেই নাকি ঘাঁটি গেড়েছে চিনা গুপ্তচরবাহিনী। ভারতীয় ফৌজ এবং হাতিয়ারের উপর নজর রাখাই তাদের উদ্দেশ্য! বিষয়টি নজরে আসতেই নড়েচড়ে বসে নয়াদিল্লি। দ্বীপের আসল মালিক তথা প্রতিবেশী সাবেক বর্মা মুলুকের সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কেন্দ্র। ওঠে নৌবাহিনী পাঠানোর আর্জিও, যা পত্রপাঠ খারিজ করেছে তারা। ফলে সন্দেহের পাশাপাশি জাতীয় সুরক্ষায় সাউথ ব্লকের উদ্বেগ যে বাড়ল, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানী নেপিডোতে দ্বিতীয় বার্ষিক ‘প্রতিরক্ষা সংলাপ’-এর (ডিফেন্স ডায়লগ) আয়োজন করে মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকার। সেখানে যোগ দিয়ে সাবেক বর্মা মুলুকের কোকো দ্বীপে চিনা গুপ্তচরবাহিনীর উপস্থিতির প্রসঙ্গ তোলেন ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশকুমার সিংহ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গোটা বিষয়টিকে অস্বীকার করে তৎক্ষণাৎ পাল্টা বিবৃতি দেন জুন্টার সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রধান মেজর জেনারেল কিয়াও কো তিক।
এই ইস্যুতে মায়ানমারের সামরিক সরকার জানিয়েছে, কোকো দ্বীপে কোনও চিনা নাগরিক নেই। বিষয়টি যাচাই করতে সেখানে ভারতীয় নৌবাহিনী পাঠানোর আর্জি জানান প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশকুমার। কিন্তু, নয়াদিল্লির সেই আবেদনে সবুজ সঙ্কেত দেননি মেজর জেনারেল কিয়াও কো তিক। উল্লেখ্য, কোকো দ্বীপে ড্রাগনের উপস্থিতি সংক্রান্ত একাধিক অকাট্য প্রমাণ অবশ্য ইতিমধ্যেই জোগাড় করে ফেলেছেন এ দেশের দুঁদে গোয়েন্দারা। ফলে বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় সংঘাত তীব্র হওয়ার আশঙ্কা বাড়ল বলেই মনে করা হচ্ছে।
সাবেক বর্মা মুলুকের কোকো দ্বীপের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে আন্দামান-নিকোবরের দূরত্ব মেরেকেটে ১০০ কিলোমিটার। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দ্বীপটি থেকে কলকাতা ১,২৫৫ কিলোমিটার, বিশাখাপত্তনম প্রায় ১,৩০০ কিলোমিটার এবং চেন্নাই ৪,১২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভারতীয় ফৌজ এবং তাঁদের ব্যবহার করা হাতিয়ারের উপর নজরদারিতে বেজিঙের গুপ্তচরবাহিনীর কোকো দ্বীপকে বেছে নেওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে।
প্রথমত, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এ দেশের সেনাবাহিনীর তিনটি বিভাগের উপস্থিতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সাধারণত অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ওড়িশা উপকূল থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করে থাকে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। কোকো দ্বীপে বসে চিনা গুপ্তচরবাহিনীর পক্ষে এই দু’য়ের উপর নজরদারি চালানো সম্ভব, বলছেন সাবেক সেনাকর্তা ও বিশ্লেষকদের একাংশ।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, নজরদারির উদ্দেশ্যে মায়ানমারের দ্বীপটিতে একটি শ্রোতা চৌকি (লিসনিং পোস্ট) তৈরি করেছে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। সেখান থেকে সর্ব ক্ষণের জন্য রেডার ও রেডিয়োর বেতার তরঙ্গ, ডুবোজাহাজের গতিবিধি এবং পরীক্ষামূলক ও মহড়ার সময় উৎক্ষেপণ করা ক্ষেপণাস্ত্রের টেলিমেট্রি তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা করছে ড্রাগনের লালফৌজ। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট চৌকিটি ওড়িশার বালেশ্বরে করা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার তথ্য সংগ্রহে সক্ষম বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, মূলত ভারতের দু’টি মারণাস্ত্রকে নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে চিন। সেগুলি হল, অগ্নি এবং কে-৪ সিরিজ়ের ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে প্রথমটির পাল্লা পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বলে জানা গিয়েছে। অগ্নি মূলত একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। অন্য দিকে ডুবোজাহাজ থেকে উৎক্ষেপণকারী কে-৪-এর পাল্লা সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। দু’টি হাতিয়ারই পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এগুলির সাহায্যে ড্রাগনভূমির যে কোনও এলাকাকে নিশানা করতে পারবে এ দেশের ফৌজ।
সাবেক সেনাকর্তারা মনে করেন, সেই কারণেই পরীক্ষা বা মহড়ার সময় টেলিমেট্রি তথ্য সংগ্রহ করে অগ্নি এবং কে-৪ সিরিজ়ের ক্ষেপণাস্ত্রগুলির সক্ষমতা বুঝে নিতে চাইছে পিএলএ। তাঁদের কথায়, টেলিমেট্রি তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে কোনও হাতিয়ার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে পাল্লা, গতি, বিস্ফোরক বহন এবং ধ্বংসক্ষমতা সংক্রান্ত তথ্য। সেটা হস্তগত হলে রণাঙ্গনে যে বেজিং কিছুটা এগিয়ে থাকবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে কোকো দ্বীপে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে শুরু করে চিন। প্রথম দিকে সেখানে একটি রেডার স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু নয়াদিল্লির আপত্তিতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় বেজিং। ২০২৩ সালে কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো ছবিতে সেখানে পিএলএ-র তৈরি করা একটি বিমানঘাঁটির ছবি স্পষ্ট হয়ে যায়। তাতে লম্বা রানওয়ের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছিল।
রানওয়ের পাশাপাশি উপগ্রহচিত্রে আরও কয়েকটি বিষয়টি উঠে আসে। তার মধ্যে রয়েছে রেডার স্টেশন এবং যুদ্ধবিমানের হ্যাঙ্গার। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিকাঠামোর উপর ভর করে আগামী দিনে দিব্যি বঙ্গোসাগরীয় এলাকায় লড়াকু জেট উড়িয়ে ‘দৌরাত্ম্য’ করার সুযোগ পাবে চিন। যদিও মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকারের দাবি, এগুলির কোনওটাই বেজিঙের নয়। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ড্রাগনের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামো তৈরি করেছে নেপিডো।
গত কয়েক বছর ধরেই গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে সাবেক বর্মা মুলুক। এর জেরে বর্তমানে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে সেখানকার জুন্টা সরকার। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ‘চিন-মায়ানমার অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিএমইসি (চায়না মায়ানমার ইকোনমিক করিডর) তৈরির নামে সেখানে বিপুল লগ্নি করেছে বেজিং। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি ড্রাগনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ বা বিআরআই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে ইউনান প্রদেশকে ভারতের পূর্বের প্রতিবেশী দেশটির রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে ফেলার পরিকল্পনা করেছে মান্দারিনভাষীরা।
সিএমইসির কাজ শেষ হলে বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছোনোর একটি বিকল্প রাস্তা পাবে বেজিং। তখন মলাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবে তারা। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সঙ্কীর্ণ ওই জলপথ দিয়ে বর্তমানে ৭০ শতাংশ খনিজ তেল ড্রাগনভূমিতে নিয়ে যান মান্দারিনভাষী নাবিকেরা। সংঘাত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট রাস্তাটি এ দেশের নৌবাহিনী বন্ধ করলে সেখানকার অর্থনীতি যে সমস্যায় পড়বে, তাতে অনেকেরই সন্দেহ নেই।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দীর্ঘ দিন ধরেই প্রতিবেশী দেশগুলিকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে ঘেরার চেষ্টা করছে চিন। সেই লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা, পাকিস্তানের গ্বদর, বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মায়ানমারে কিয়াকফিউতে নৌঘাঁটি তৈরি করছে বেজিং। ফলে নয়াদিল্লির রক্তচাপ বাড়িয়ে আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় ড্রাগনের ডুবোজাহাজকে নোঙর করতে দেখা যেতে পারে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারে একটি বন্দরের উদ্বোধন করে চিন। তার পর থেকেই বঙ্গোসাগরীয় এলাকায় বেজিঙের পিএলএ নৌবাহিনীর আনাগোনা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে মিলেছে খবর। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ওই এলাকায় ‘ইউয়ান ওয়াং-৫’ নামের একটি গুপ্তচর জাহাজকে মোতায়েন করে তারা। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে ঘিরে থাকা কক্সবাজার, হাম্বানটোটা এবং গ্বদর ‘মৃত্যু ত্রিভুজ’ হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ।
গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের সংঘাতে ভারতীয় ফৌজের হাতে বেদম মার খায় পাকিস্তান। ওই সময় নয়াদিল্লির বাহিনীর পরাক্রমের পাশাপাশি এ দেশের তৈরি একাধিক হাতিয়ারের পারফরম্যান্স ছিল নজরকাড়া। উল্টো দিকে ইসলামাবাদের হাতে থাকা বেজিঙের মারণাস্ত্র সংঘাত পরিস্থিতিতে একেবারেই কাজ করেনি। উদাহরণ হিসাবে ড্রাগনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এইচকিই৯পি-র কথা বলা যেতে পারে, যাকে ইজ়রায়েলি ড্রোন দিয়ে ধ্বংস করে এ দেশের সেনা।
‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন ভারতীয় লড়াকু জেট লক্ষ্য করে চিনা ক্ষেপণাস্ত্র পিএল-১৫ ছোড়ে পাক বিমানবাহিনী। কিন্তু কোনও রকমের বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে পঞ্জাবের সীমান্তবর্তী হোশিয়ারপুর এলাকায় আকাশ থেকে খসে পড়ে সেটি। স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্যে তা পরবর্তী সময়ে উদ্ধার করে ভারতীয় সেনা। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির ফরেন্সিক পরীক্ষা করেছেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সেই তথ্য অবশ্য গোপন রাখা হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, এই সমস্ত ঘটনার পরই নয়াদিল্লির বাহিনী ও হাতিয়ারের উপর নজরদারি বাড়িয়েছে ড্রাগন।
সম্প্রতি শক্তির নিরিখে বিশ্বের শতাধিক দেশের বিমানবাহিনীর একটি তালিকা প্রকাশ করে ‘ওয়ার্ল্ড ডিরেক্টরি অফ মর্ডান মিলিটারি এয়ারক্রাফ্ট’ বা ডব্লিউডিএমএমএ নামের সমীক্ষক সংস্থা। সেখানে চিনের চেয়ে এক ধাপ উঁচুতে রয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। এ দেশের আকাশযোদ্ধারা পেয়েছেন তিন নম্বর র্যাঙ্ক। সেখানে বেজিঙের স্থান চতুর্থ। প্রথম দু’টি জায়গায় আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া।
চিন অবশ্য ডব্লিউডিএমএমএ তৈরি করা র্যাঙ্কিং মানতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেজিঙের সরকারি গণমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইম্স’। সেখানে বলা হয়েছে, কাগজেকলমে কোনও বিমানবাহিনীকে সেরা হিসাবে উল্লেখ করার অর্থ নেই। ফৌজের আসল শক্তির পরীক্ষা হয় যুদ্ধের ময়দানে। ফলে সংশ্লিষ্ট র্যাঙ্কিং থেকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হলে ভুল করবে ভারত।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য মনে করেন, ডব্লিউডিএমএমএ-র করা সমীক্ষা রিপোর্ট এবং শক্তিশালী বায়ুসেনার তালিকা একেবারেই ফেলে দেওয়ার নয়। কারণ, গত সাড়ে চার দশকে কোনও লড়াইয়ে অংশ নেয়নি বেজিঙের বাহিনী। উল্টো দিকে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইজ়রায়েলের পাশাপাশি যথেষ্ট আধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে ভারত।
চিনের তৈরি করা ‘মৃত্যু ত্রিভুজ’-এর চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে মলাক্কা প্রণালীতে ক্রমাগত উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে ভারতীয় নৌবাহিনী। এর মধ্যেই কোকো দ্বীপে বেজিঙের গুপ্তচরবাহিনীর উপস্থিতি যে নয়াদিল্লির কপালের চিন্তার ভাঁজ চওড়া করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই ইস্যুতে তাই সাবেক বর্মা মুলুকের উপর কূটনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।