পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ যুদ্ধবিমান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের শেষ নেই। আমেরিকার দাবি, তাদের বায়ুসেনার বহরে থাকা এফ-২২ র্যাফটর বা এফ-৩৫ লাইটনিং টু-কে চিহ্নিত করতে পারে না বিশ্বের কোনও রেডার। ওয়াশিংটনের সেই গুমর এ বার ভেঙে দেবে চিন? ড্রাগনভূমির প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের তৈরি অত্যাধুনিক রেডারকে কেন্দ্র করে দুনিয়া জুড়ে তীব্র হচ্ছে সেই জল্পনা। অন্য দিকে এই খবরে ওয়াশিংটনের কপালে যে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি মিটার ওয়েভ রেডার তৈরি করেছেন সেখানকার প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এর পোশাকি নাম জেওয়াই-২৭ভি রেডার। সামরিক ট্রাকে বসিয়ে এই রেডারকে সহজেই এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যেতে পারবে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। গ্লোবাল টাইমসের দাবি, এর নজর এড়াতে পারবে না মার্কিন এফ-২২ এবং এফ-৩৫ লাইটনিং টুর মতো ‘স্টেল্থ’ লড়াকু জেটও।
সূত্রের খবর, জেওয়াই-২৭ভি রেডারে রয়েছে খুব উচ্চ মাত্রার বা ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) বেতার তরঙ্গ। ফলে এটি অত্যন্ত গোপন লক্ষ্যবস্তু, অর্থাৎ স্টেল্থ যুদ্ধবিমানকেও অনায়াসে চিহ্নিত করতে পারে। রেডারটিকে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স) সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় ব্যবহার করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রেডারটির নির্দেশ মতো পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ লড়াকু জেটকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে পারবে চিনা লালফৌজ।
জেওয়াই-২৭ভি রেডারের নির্মাণকারী সংস্থা হল বেজিঙের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘চায়না ইলেকট্রনিক্স গ্রুপ কর্পোরেশন’ বা সিইটিসি। গত ২৪ থেকে ২৬ মে-র মধ্যে আনহুই প্রদেশের হেফেইতে একটি রেডার এক্সপোর আয়োজন করে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সরকার। সেখানেই প্রথম বার জেওয়াই-২৭ভিকে দুনিয়ার সামনে আনে ড্রাগন। এর পরই তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি নিয়ে হইচই পড়ে যায়।
এই রেডারটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চিনের আর একটি সরকারি সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া। সেখানে বলা হয়েছে, জেওয়াই-২৭ভিতে রয়েছে ইলেকট্রনিক ভাবে স্ক্যান করা অ্যারে অ্যান্টেনার একটি বিশাল প্যানেল। এগুলি খুব দ্রুত খুলে গিয়ে আবার ভাঁজ হতে পারে। এর ফলে ‘স্টেল্থ’ যুদ্ধবিমানের চিহ্নিতকরণে রেডারটির মাধ্যমে খুব উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির বেতার তরঙ্গ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এর কর্মক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করছেন সিইটিসির বিজ্ঞানী জু হাইঝোকে।
চিনের এই রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা সংস্থাটি এর আগে জেওয়াই-২৭এ নামের একটি রেডার তৈরি করে। তাতে ছিল একটি বড় অ্যান্টেনা এবং কম মাত্রার বেতার তরঙ্গ পাঠানোর প্রযুক্তি। নতুন রেডারটি জেওয়াই-২৭এর উন্নত সংস্করণ বলে জানা গিয়েছে। জেওয়াই-২৭ভিকে অত্যাধুনিক করে গড়ে তুলতে এর অ্যাপারেচার এবং অ্যালগরিদমে বড় বদল এনেছে ‘চায়না ইলেকট্রনিক্স গ্রুপ কর্পোরেশন’ বা সিইটিসি।
আনহুইয়ের এক্সপোয় চিনা প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানী জু হাইঝো জানিয়েছেন, ‘‘রেডারের অ্যান্টেনার ব্যাস যত বেশি হবে, তত যন্ত্রটির শনাক্তকরণের পরিধি বৃদ্ধি পাবে। ‘স্টেল্থ’ যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তির কথা মাথায় রেখে একে তৈরি করা হয়েছে।’’ রেডারটির পাল্লা অবশ্য এখনও প্রকাশ্যে আনেনি বেজিং। তবে পিএলএতে এটি দ্রুত শামিল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৬ সালে ঝুহাই এয়ার শোয়ে অত্যাধুনিক রেডারটির পূর্বসূরি জেওয়াই-২৭একে প্রথম বার দুনিয়ার সামনে আনে চিন। ওই প্রদর্শনীতে আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল আরও একটি রেডার। তার নাম ওয়াইএলসি-৮বি। অতি উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির বা ইউএইচএফ (আল্ট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি) প্রতিরক্ষা যন্ত্রটি স্টেল্থ শ্রেণির যে কোনও উড়ন্ত বস্তুকে চিহ্নিত করতে পারবে বলে দাবি করেছিল বেজিং। যদিও ওয়াইএলসি-৮বির কর্মদক্ষতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
২০১৬ সালে পূর্ব চিন সাগরে ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির যুদ্ধবিমান চিহ্নিত করতে ওয়াইএলসি-৮বি রেডারের পরীক্ষা চালান পিএলএ নৌসেনার পদস্থ কর্তারা। সেখানে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রটি যে সব ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছিল এমনটা নয়। বেজিং অবশ্য বিশ্বাস করে জেওয়াই-২৭ভি এবং ওয়াইএলসি-৮বি— এই দু’টি রেডার একসঙ্গে ব্যবহার করে ২৫০ কিলোমিটার দূর থেকে মার্কিন এফ-২২ বা এফ-৩৫ লড়াকু জেটকে চিহ্নিত করা যাবে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ভিএইচএফ রেডার সাধারণত ৩০ থেকে ৩০০ মেগাহার্ৎজ়ের বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে থাকে যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রযুক্তিতে জেওয়াই-২৭ভি রেডারটিকে তৈরি করেছে চিন। অন্য দিকে, ওয়াইএলসি-৮বি ইউএইচএফ রেডার ৩০০ থেকে ৩,০০০ মেগাহার্ৎজের বেতার তরঙ্গ এবং ০.১ থেকে ১ মিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাধ্যমে শনাক্তকরণের কাজ করে থাকে।
চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা জানিয়েছেন, পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ লড়াকু জেটে যে রেডার শোষণকারী আবরণ থাকে তা শুধুমাত্র ০.০১ থেকে ০.১ মিটারের তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে ঠেকাতে সক্ষম। কিন্তু, তাঁদের তৈরি রেডারে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তারতম্য থাকায় সেগুলিকে ফাঁকি দেওয়া এফ-২২ বা এফ-৩৫-এর পক্ষে সম্ভব হবে না। এ ছাড়া ভিএইচএফ বা ইউএইচএফ প্রযুক্তির সাহায্যে যুদ্ধবিমানের ডানা ও লেজের অংশটির হদিস পাওয়া যাবে বলেও মনে করেন তাঁরা।
তবে বেজিঙের এই মিটার ওয়েভ রেডারের বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় এটিকে ব্যবহার করা খুবই কঠিন। কারণ এর অ্যান্টেনার আকার খুব বড়। ফলে এটি খুব সহজে শত্রুর নজরে পড়তে পারে। রেডারটি ড্রোন হামলা চিহ্নিত করতে কতটা সক্ষম, তা স্পষ্ট নয়। যুদ্ধের সময়ে আত্মঘাতী উড়ুক্কু যানের সাহায্যে একে সহজেই ওড়ানো যাবে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনা প্রতিরক্ষা সংস্থা সিইটিসি অবশ্য জানিয়েছে, এই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী দিনে কৌশলগত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করার জন্য এর পরীক্ষা করার পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের সমরাস্ত্র গবেষকদের। সূত্রের খবর, সেটা চলতি বছরের শেষের দিকে শুরু হতে পারে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের সমস্ত পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান স্টেল্থ শ্রেণির। অর্থাৎ, রেডারে সেগুলি প্রায় ধরা পড়ে না বলা চলে। সেই তালিকায় এফ-৩৫ যে সকলের উপরে রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর তাই মার্কিন সংস্থা লকহিড মার্টিনের তৈরি এই লড়াকু জেটের ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিমানটির হাজারের বেশি ইউনিট নির্মাণ করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
রাডারে কোনও বস্তু কতটা শনাক্তযোগ্য, তা চিহ্নিত করার বিশেষ একটি প্রযুক্তি রয়েছে। তার নাম রেডার ক্রস সেকশন বা আরসিএস। এতে সাধারণত ০.০০১ থেকে ০.০০৫ বর্গমিটার আকারে ধরা পড়ে এফ-৩৫। ফলে অধিকাংশ সময়ই মার্কিন জেটটির উপস্থিতি বুঝতে পারে না শত্রুসেনা। ফলে সহজেই তাদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে পারে লকহিড মার্টিনের যুদ্ধবিমান।
এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানকে ‘স্টেল্থ’ করতে এর নকশা অন্য সমস্ত লড়াকু জেটের থেকে আলাদা করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা। এ ছাড়া এই যুদ্ধবিমানে রয়েছে অত্যাধুনিক ‘এএন/এপিজি-৮১ অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে’ (এইএসএ) রেডার এবং ‘ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যাপারচার সিস্টেম’ (ডিএএস)। এই দুইয়ের সাহায্যে নজরের বাইরের লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে পারেন এর পাইলট।
এ হেন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানকে আদৌ চিনা রেডার চিহ্নিত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। কারণ, ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে চিনা হাতিয়ার। বেজিঙের রেডার ব্যবহার করে নয়াদিল্লির ক্ষেপণাস্ত্রকে আটকাতে পারেনি ইসলামাবাদের বাহিনী। উল্টে ড্রোন হামলায় হারাতে হয়েছে লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’।
সূত্রের খবর, লাহৌরে ড্রাগনের তৈরি এইচকিউ-৯পি নামের এয়ার ডিফেন্স মোতায়েন রেখেছিল পাক ফৌজ। ইজ়রায়েলের তৈরি ‘হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোন দিয়ে তা ভারতীয় সেনা ধ্বংস করে বলে স্বীকার করে নিয়েছে ইসলামাবাদ। এ ছাড়া সংঘর্ষে চিনের তৈরি দু’টি জেএফ-১৭ লড়াকু জেট হারাতে হয়েছে তাঁদের। এ ছাড়া বেজিঙের তৈরি পিএল-১৫ ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র (এয়ার টু এয়ার মিসাইল) কাজই করেনি। ইলেকট্রনিক যুদ্ধ পদ্ধতিতে একে নিষ্ক্রিয় করে নয়াদিল্লি। ফলে নিশানা হারিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটি আকাশ থেকে পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরে খসে পড়ে।
ফলে চিন মুখে যে দাবিই করুক না কেন, তাদের তৈরি অত্যাধুনিক রেডার আদৌ মার্কিন যুদ্ধবিমানকে আটকাতে সক্ষম কি না, তা নিয়ে সন্দিহান দুনিয়ার দুঁদে ফৌজি অফিসারেরা। উল্টে এফ-৩৫ লাইটনিং টুকে ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট’ বা দুর্দান্ত শিল্পকর্মের লড়াকু জেট বলে মনে করেন তাঁরা। ড্রাগনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি চুরি করে সমরাস্ত্র তৈরির অভিযোগও রয়েছে।