China Develops Zero Tariff Island

শূন্য শুল্কে পণ্যের লেনদেন, বিশ্ববাণিজ্যের চাকা ঘোরাতে সিঙ্গাপুরের চেয়ে ৫০ গুণ বড় দ্বীপে ‘মুক্তাঞ্চল’ গড়ছে কমিউনিস্ট চিন!

মুক্ত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে এ বার হাইনান দ্বীপকে গড়ে তুলছে চিন। একরকম বিনা শুল্কে সেখানে বাণিজ্য করা যাবে বলে জানিয়েছে বেজিং। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক সংঘাতের যোগ্য জবাব? উঠছে প্রশ্ন।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৫৪
Share:
০১ ১৮

পারস্পরিক শুল্কনীতি চালু করে বাণিজ্যযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই আগুনে হাত পোড়াতে নারাজ চিন। আর তাই শুল্কমুক্ত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে আস্ত একটা দ্বীপকে গড়ে তুলছে বেজিং। ড্রাগনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ চিন সাগরে গড়ে উঠবে দ্বিতীয় হংকং বা সিঙ্গাপুর, যা সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে আমেরিকার রফতানি বাণিজ্যকে। ফলে মান্দারিনভাষী প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের এই সিদ্ধান্তকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলেই মনে করছেন দুনিয়ার তাবড় কূটনীতিক এবং আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

০২ ১৮

দক্ষিণ চিন সাগরের ছোট্ট দ্বীপ হাইনান। এলাকাটা ড্রাগনভূমির অন্তর্ভুক্ত হলেও এর নিজস্ব আইন রয়েছে। সেখানেই প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে বেজিং। হংকং বা সিঙ্গাপুরের মতো ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে একে গড়ে তুলছে জিনপিং প্রশাসন। সেই লক্ষ্যে দ্রুত গতিতে চলছে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি শেষ হলে শুল্কমুক্ত একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে হাইনান।

Advertisement
০৩ ১৮

পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ডিসেম্বরের গোড়ায় হাইনানের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করে চিনা প্রশাসন। আগামী দিনে সেখানে যত পণ্য আসবে, তার ৭৪ শতাংশের উপরে থাকবে না কোনও শুল্ক। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দক্ষিণ চিন সাগরের দ্বীপটি আকারে সিঙ্গাপুরের প্রায় ৫০ গুণ বড়। তাইওয়ান বা সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপের (পড়ুন রিপাবলিক অফ চায়না) সঙ্গে এর আয়তন প্রায় সমান বলে জানা গিয়েছে।

০৪ ১৮

গত এপ্রিল থেকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সঙ্গেই শুল্ক এবং বাণিজ্যিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন ট্রাম্প। তাঁর একতরফা সিদ্ধান্তের জেরে মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ভুক্ত দেশগুলির বৈদেশিক বাণিজ্য। চিনকে অবশ্য সেই বিপদের মুখে পড়তে হয়নি। দ্রুত আমেরিকার থেকে মুখ ঘুরিয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার অন্য দেশগুলির বাজার দখলে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন মান্দারিনভাষীরা। ফলে এক লক্ষ কোটি ডলারের রফতানি উদ্বৃত্তে পৌঁছোতে পেরেছে বেজিং।

০৫ ১৮

হংকং থেকে প্রকাশিত ‘এশিয়া টাইমস’ জানিয়েছে, ট্রাম্পের শুল্কনীতির জন্য ইইউয়ের লোকসান খুব ভাল ভাবে প্রত্যক্ষ করে চিন। এর পরই গোটা একটা দ্বীপ জুড়ে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার নীলনকশা ছকে ফেলেন প্রেসিডেন্ট শি। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর কাজ সম্পূর্ণ হলে বেশ কিছু পণ্যে সেরা দর কষাকষির সুযোগ পাবে ড্রাগন সরকার। উদাহরণ হিসাবে অ্যাপ্‌লের তৈরি আইফোনের কথা বলা যেতে পারে, যেটা হাইনান ঘুরে গেলে ১০০ ডলার সস্তা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

০৬ ১৮

৩২ হাজার ৯০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত হাইনান দ্বীপের পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে বেশ খ্যাতি রয়েছে। ফলে সেখানকার চোখজুড়োনো সৈকতে গজিয়ে উঠেছে একাধিক রিসর্ট। সম্প্রতি একে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বা এফটিজ়েড (ফ্রি ট্রে়ড জ়োন) হিসাবে ঘোষণা করে বেজিং। এর জেরে রাতারাতি ভাগ্যবদল হয় হাইনানের। কারণ ওই ঘোষণার জেরে মোট আমদানি করা পণ্যের তিন-চতুর্থাংশের উপর কোনও কর দিতে হচ্ছে না স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। ফলে দ্বীপটি চিনা বাজারে প্রবেশের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছে।

০৭ ১৮

‘এশিয়া টাইমস’ জানিয়েছে, বর্তমানে চিনে মোট ২২টি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাইনানের গুরুত্ব কয়েক গুণ বাড়তে চলেছে। কারণ, সংশ্লিষ্ট দ্বীপটিতে একটি সমন্বয়কারী মুক্ত বাণিজ্য বন্দর বা এফটিপি (ফ্রি ট্রেড পোর্ট) তৈরি করছে জিনপিং প্রশাসন। নিজের মতো করে শুল্ক বা কর আরোপ করার অধিকার থাকবে ওই বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে। ফলে অধিকাংশ পণ্যকে শূন্য শুল্কের আওতায় রাখতে পারবেন তাঁরা।

০৮ ১৮

ড্রাগনভূমির অন্তর্ভুক্ত বেশির ভাগ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি শিল্প শহর সংলগ্ন এলাকায়। সেখানকার সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, হাইনানকে আয়তনের নিরিখে বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য বন্দর হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং। সেখানে অবাধে বিদেশি পণ্য ঢোকানোই বেজিঙের মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিস্তার ঘটানোর সুবিধা হবে বলে আশাবাদী মান্দারিনভাষী প্রশাসন।

০৯ ১৮

চৈনিক আর্থিক বিশ্লেষকেরা প্রেসিডেন্ট শি-র হাইনান প্রকল্পকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বেজিঙের অর্থনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করবে। ইতিমধ্যেই সেখানে একাধিক বিদেশি কোম্পানি লগ্নি বাড়াতে শুরু করেছে। হংকং থেকে প্রকাশিত ‘বাস্টিল পোস্ট’ আবার দাবি করেছে, হাইনানে নতুন শুল্ক ব্যবস্থা চালু হওয়ার প্রথম দিনেই সেখানে একটি সহযোগী সংস্থা স্থাপন করে সিমেন্স এনার্জি। পাশাপাশি ইয়াংপু আর্থিক উন্নয়ন অঞ্চলে একটি গ্যাস টার্বাইন অ্যাসেম্বলি বেস এবং পরিষেবা কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছে তারা।

১০ ১৮

শি প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে প্রায় ১,৪৬০ কোটি ডলারের বিদেশি লগ্নি পেয়েছে হাইনান দ্বীপ। এই সূচক বার্ষিক গড়ে ১৪.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘বাস্টিল পোস্ট’ জানিয়েছে, এই সময়সীমার মধ্যে আট হাজারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগে পরিচালিত সংস্থা সংশ্লিষ্ট দ্বীপটিতে তাদের পণ্য উৎপাদনের কাজ শুরু করেছে। ২০২০ সালে মোট ১৭টি দেশ থেকে লগ্নি পেয়েছিল চিনের হাইনান দ্বীপ।

১১ ১৮

সূত্রের খবর, প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই দ্বীপের শুল্কের মাত্রা একবারে কমায়নি স্থানীয় প্রশাসন। প্রথম দিকে হাইনান শুল্ক বিভাগে ২১ শতাংশ বিদেশি পণ্যকে করমুক্ত ভাবে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। পরে সেটাই বেড়ে হয় ৭৪ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট দ্বীপটির পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এই অঙ্ক আরও ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে জানা গিয়েছে।

১২ ১৮

এশিয়া টাইমস’ জানিয়েছে, হাইনানে মূলত বিনা শুল্কে শিল্প সরঞ্জাম এবং বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল আমদানির পরিকল্পনা করেছে শি প্রশাসন। এতে জিনপিং সরকারের করবাবদ খরচ হ্রাস পাবে প্রায় ২০ শতাংশ। ওই দ্বীপেই কিছু সামগ্রীর প্রক্রিয়াকরণ সম্পূর্ণ করবে বেজিং প্রশাসন। এতে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে তাদের প্রদেয় মূল্য। প্রক্রিয়াকরণের কাজ শেষ হলে কোনও কর ছাড়া মূল ড্রাগনভূমির কারখানাগুলিতে পাঠানো হবে ওই সমস্ত পণ্য। এ ভাবেই শিল্প উৎপাদনের মাত্রাকে আরও বৃদ্ধি করতে চাইছে মান্দারিনভাষীরা।

১৩ ১৮

হাইনানে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও একটি সুবিধা দিচ্ছে চিনা প্রশাসন। সেখানকার নথিভুক্ত সংস্থাগুলির থেকে মাত্র ১৫ শতাংশ কর্পোরেট কর নেবে বেজিং। মূল চিনা ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে যা ২৫ শতাংশ। অন্য দিকে হংকঙের কর্পোরেট কর ১৬.৫ শতাংশ। অর্থাৎ, নামমাত্র টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে দক্ষিণ চিন সাগরের ওই দ্বীপে দিব্যি ব্যবসা চালাতে পারবে যে কোনও বিদেশি সংস্থা।

১৪ ১৮

দক্ষিণ চিন সাগরের ওই দ্বীপে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে এখন থেকেই উৎসাহ দিচ্ছে চিন। সেই তালিকায় আছে মহাকাশ উৎক্ষেপণ কেন্দ্র নির্মাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং গ্রামীণ পর্যটন। হাইনানে মেধা অনুযায়ী একটি দক্ষ এবং পেশাদার শ্রমিক গোষ্ঠী তৈরি করছে বেজিং। আয়করে ১৫ শতাংশ ছাড় পাবেন তাঁরা। যদিও ড্রাগনভূমির মূল ভূখণ্ডে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করছাড় পেয়ে থাকেন দক্ষ শ্রমিক এবং পেশাদারেরা।

১৫ ১৮

এ ছাড়া আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যকে গতিশীল করতে বেশ কিছু প্রশাসনিক বাধা দূর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইনানের স্থানীয় প্রশাসন। ‘এশিয়া টাইমস’-এর দাবি, দ্বীপটির পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ পুরোপুরি ভাবে শেষ হলে যান্ত্রিক এবং বৈদ্যুতিক পণ্যের লাইসেন্স প্রক্রিয়া তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। সেখানে ব্যবসা বা শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে যাবতীয় আইনগত জটিলতাকে একরকম তুলে দিতে চাইছে জিনপিং সরকার, খবর সূত্রের।

১৬ ১৮

হাইনান দ্বীপ নিয়ে বেজিঙের পরিকল্পনার খবর প্রকাশ্যে আসতেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে চিন এবং হংকঙের শেয়ার বাজার। লাফিয়ে লাফিয়ে সেখানে বাড়তে থাকে স্টকের সূচক। সম্প্রতি এই ইস্যুতে একটি জনসভায় হাইনানের মুক্ত বাণিজ্য বন্দর নিয়ে মুখ খোলেন শি সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী হে লিফেং। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ব উন্মুক্ততার নতুন যুগের প্রবেশদ্বার হিসাবে গড়ে উঠবে দক্ষিণ চিন সাগরের ওই দ্বীপ। সেইমতো পরিকল্পনা করে কাজে নামা হয়েছে।’’

১৭ ১৮

বেজিঙের একদলীয় শাসনক্ষমতায় থাকা ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ বা সিপিসির নীতি নির্ধারক কমিটি পলিটব্যুরোর সদস্য লিফেং সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে বামপন্থী দলের ‘কৌশলগত সিদ্ধান্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘শুধুমাত্র দেশীয় বাণিজ্যের কথা ভেবে ওই দ্বীপের পরিকাঠামোগত উন্নতি ঘটানো হচ্ছে না। সামগ্রিক ভাবে বিশ্ববাণিজ্যের কথাও পলিটব্যুরো স্তরে আলোচনা করা হয়েছে।’’

১৮ ১৮

সূত্রের খবর, ২০৩৫ সাল নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শেষ করবে শি প্রশাসন। চলতি বছরের প্রথম তিনটি ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি বা এফডিআই-এর (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের পতন লক্ষ করেছে চিন। আগামী দিনে সেটা যাতে কাটিয়ে ওঠা যায়, এখন থেকেই তার মরিয়া চেষ্টা করছে বেজিং। সেখানে শুল্কমুক্ত হাইনান দ্বীপ মান্দারিনভাষীদের তুরুপের তাস হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement