পাকিস্তানের হাত শক্ত করতে মরিয়া চিন। চলতি বছরের অগস্ট মাসের মধ্যেই ৩০টি পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির জে-৩৫এ লড়াকু জেট ইসলামাবাদকে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেজিং। সূত্রের খবর, যুদ্ধবিমানগুলির দামে ৫০ শতাংশ ছাড় দেবে ড্রাগন। চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের এ হেন সিদ্ধান্ত ঘিরে সমাজমাধ্যমে উঠেছে ঝড়। কড়া সমালোচনায় তাঁর বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন সাধারণ মান্দারিনভাষীরাও।
শি সরকারের কাছে চিনা নেটাগরিকদের প্রশ্ন, কেন হঠাৎ পাকিস্তানকে সস্তা দরে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির যুদ্ধবিমান বিক্রি করা হচ্ছে? এতে যে আর্থিক লোকসান হবে, সেই অর্থ কী ভাবে বা কোথা থেকে জোগাড় করবে বেজিং? তাঁদের আশঙ্কা, লড়াকু জেটের বাকি টাকা মেটাতে হবে ড্রাগনভূমির সাধারণ খেটে খাওয়া বাসিন্দা ও করদাতাদের। আর তাই জিনপিং প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি রয়েছে তাঁদের।
মান্দারিনভাষী সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের দাবি, সংশ্লিষ্ট জে-৩৫এ লড়াকু জেটটির না কি ঠিকমতো পরীক্ষাই হয়নি। তাই একে এখনও বহরে সামিল করেনি চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর বিমানবাহিনী। ফলে নিয়ম অনুযায়ী এই যুদ্ধবিমান বিদেশে রফতানি করার কথা নয়। কিন্তু, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি ইসলামাবাদকে তা সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেজিং। ফলে এখানে কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন ড্রাগনভূমির নেটাগরিকেরা।
এই আবহে প্রকাশ্যে এসেছে আরও একটি বিতর্ক। চিনা সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, বেজিংকে এখনও পর্যন্ত জে-১০সি লড়াকু জেটের পুরো দাম চোকায়নি পাক সরকার। বকেয়া অর্থ ইসলামাবাদ কবে দেবে বা আদৌ দেবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তার পরও কিসের ভরসায় রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের পঞ্চম প্রজন্মের জে-৩৫এ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করা হচ্ছে? প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট করেছেন ‘ইয়াংইয়াং মেডিক্যাল স্কুল (@ঝেজিয়াং)’ নামের এক নেটাগরিক। তাঁর কথায়, ‘‘আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) থেকে ঋণ নিয়ে দেশ চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ইসলামাবাদ। এই অবস্থায় কোনও ভাবেই তাঁদের পক্ষে জে-৩৫এর মতো উচ্চ মূল্যের যুদ্ধবিমান কেনা সম্ভব নয়।’’
ওই চিনা নেটাগরিকের অভিযোগ, একরকম বিনামূল্যে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি ইসলামাবাদের হাতে তুলে দিচ্ছে জিনপিং সরকার। জে-৩৫এর বাণিজ্যিক উৎপাদন এখনও শুরু করতে পারেনি বেজিং। তার আগে শি-প্রশাসন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমজনতাকে যে এর মূল্য চোকাতে হবে, তা নিয়ে সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্ট মান্দারিনভাষী সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী। তাঁর করা এই পোস্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ৫০ শতাংশ ছাড়ে পাকিস্তানকে জে-৩৫এ বিক্রির সিদ্ধান্ত বেজিঙের জন্য বুমেরাং হতে পারে। কারণ, এর জেরে আগামী দিনে অন্য দেশগুলিও সস্তায় পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কিনতে চাইবে। সেই দাবি মানলে আর্থিক লোকসান হবে লড়াকু জেটটির নির্মাণকারী সংস্থার। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারে নিজের অবস্থান খারাপ হতে পারে জিনপিং সরকারের।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জে-৩৫এ লড়াকু জেট কেনার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দেয় শরিফ প্রশাসন। তবে ওই সময়ে যুদ্ধবিমানগুলি ২০২৭ সালের আগে পাক বায়ুসেনার বহরে শামিল হবে না বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে হওয়া সংঘর্ষে ভারতীয় সেনার হাতে মার খাওয়ার পর দ্রুত বদলে যায় পরিস্থিতি। তড়িঘড়ি লড়াকু জেটগুলি বহরে সামিল করতে বেজিং ছোটেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ ও সেনা অফিসারেরা।
জে-৩৫এ-র নির্মাণকারী সংস্থা হল চিনের ‘শেনইয়াং এয়ারক্রাফ্ট কর্পোরেশন’। সূত্রের খবর, পঞ্চম প্রজন্মের এই লড়াকু জেটকে ওড়ানো এবং যুদ্ধকৌশল জানতে বর্তমানে বেজিঙে রয়েছেন পাক বায়ুসেনার একগুচ্ছ অফিসার। সেখানে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে পিএলএ বিমানবাহিনী। প্রশিক্ষণ শেষে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানগুলি নিয়ে ইসলামাবাদে ফিরবেন তাঁরা।
দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট ‘স্টেলথ’ শ্রেণির জে-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রথম বার আকাশে ওড়ে ২০১২ সালে। যে কোনও পরিবেশে সমান দক্ষতায় হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে এই লড়াকু জেটের। ‘স্টেলথ’ শ্রেণির হওয়ায় সহজে এটি শত্রুর রাডারের নাগালে আসবে না। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এর জে-৩৫এ ভ্যারিয়েন্টটি তৈরি করে ‘শেনইয়াং’। পাকিস্তানই প্রথম দেশ, যাকে এই যুদ্ধবিমান রফতানি করছে বেজিং।
পিএলএ বায়ুসেনার পাশাপাশি জে-৩৫এ যুদ্ধবিমানটি চিনা নৌবাহিনীর ব্যবহার করার কথা রয়েছে। বেজিং হামেশাই সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটিকে পঞ্চম প্রজন্মের মার্কিন ‘স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ লাইটনিং টুর সঙ্গে তুলনা করে থাকে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এর কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি ড্রাগনের এই জে-৩৫এ। অন্য দিকে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ভালই রয়েছে আমেরিকার এফ-৩৫ লাইটনিং টুর।
সাম্প্রতিক ভারত-পাক ‘যুদ্ধে’ ব্যর্থ হয় চিনের তৈরি জে-১০সি যুদ্ধবিমান। ইসলামাবাদের ওই জেটগুলিকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করে নয়াদিল্লির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। লড়াইয়ের সময়ে এর থেকে ছোড়া পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রও ঠিক মতো কাজ করেনি। সীমান্ত লাগোয়া পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরে অক্ষত অবস্থায় জেট থেকে খুলে পড়ে ওই ক্ষেপণাস্ত্র। এলাকাবাসীরাই সেটিকে উদ্ধার করে ভারতীয় সেনার হাতে তুলে দেয়।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জে-১০সির এই পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রটিও ছিল চিনের তৈরি। ফলে এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই হু-হু করে পড়তে থাকে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির নির্মাণকারী সংস্থা ‘চেংডু এয়ারক্রাফ্ট কর্পোরেশন’-এর শেয়ারের দর। ইসলামাবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা রকমের অপপ্রচার করেও স্টকের এই ধস আটকাতে পারেনি বেজিং।
এ ছাড়া সংঘাত চলাকালীন ড্রোন হামলা চালিয়ে পাক পঞ্জাব প্রদেশের লাহৌরের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। সেখানে মোতায়েন ছিল চিনের তৈরি ‘এইচকিউ-৯পি’ নামের একটি এয়ার ডিফেন্স। এ ছাড়া বেজিং থেকে কেনা জেএফ-১৭ নামের দু’টি লড়াকু জেটকে ধ্বংস করে নয়াদিল্লি। সে কথা অবশ্য স্বীকার করে নেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা।
কিন্তু, লড়াইয়ের মধ্যেই ইসলামাবাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দাবি করতে শুরু করেন, ভারতীয় বিমানবাহিনীর রাফাল লড়াকু জেটকে মাঝ-আকাশে উড়িয়েছে চিনা যুদ্ধবিমান। এর পরই আসরে নামে ড্রাগনভূমির একাধিক সংবাদমাধ্যম। এই ইস্যুতে প্রবল মিথ্যাচার শুরু করে তারা। কিন্তু কোনও প্রমাণ দেখাতে না পারায় ভুয়ো খবরের দৌড় বেশিক্ষণ চলেনি।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, চিনের এই যুদ্ধবিমানগুলির কোনওটিরই ফ্রান্সের তৈরি রাফাল লড়াকু জেটকে ধ্বংস করার ক্ষমতা নেই। তা ছাড়া জে-১০সি নির্মাণের ক্ষেত্রে রুশ ইঞ্জিন ব্যবহার করছে বেজিঙের সংস্থা। এর নকশাটিও চুরি করা বলে ড্রাগনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। আর তাই মিশর, ব্রাজ়িল এবং উজবেকিস্তানকে সংশ্লিষ্ট জেটটি বিক্রির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় জিনপিং সরকার।
এ বছরের মে মাসে জে-৩৫এ লড়াকু জেট দ্রুত হাতে পেতে বেজিং সফরে যান পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আসিফ। সেখানে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার উপর জোর দেন তিনি। চিনা সরকারের পদক্ষেপকে ‘পুরস্কার’ হিসাবে উল্লেখ করেছে ইসলামাবাদ। কারণ, ভারতের হাতে বর্তমানে কোনও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান নেই।
দীর্ঘ দিন ধরেই লড়াকু জেটের স্বল্পতায় ভুগছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। এই অবস্থায় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যুদ্ধবিমান নির্মাণের উপর জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি। যদিও জেট ইঞ্জিন তৈরিতে সে ভাবে সাফল্য পাননি এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ফলে দ্রুত আমেরিকা বা রাশিয়া থেকে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে চুক্তি করতে পারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। সেই দৌড়ে মস্কোর এসইউ-৫৭ এগিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্য দিকে নেটাগরিকদের প্রশ্নের মুখে পড়ে অস্বস্তি বাড়লেও পাকিস্তানকে সস্তা দরে যুদ্ধবিমান বিক্রির বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে চিনা প্রশাসন। বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমানে তাইওয়ানকে কব্জা করার দিকে বেশি নজর দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি। আর তাই ভারতকে পশ্চিম সীমান্তে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছেন তাঁর পিএলএ কমান্ডাররা। এর জেরে সস্তা দরে ইসলামাবাদকে ‘খেলনা’ লড়াকু জেট তুলে দিচ্ছেন তাঁরা।