এক দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন, অন্য দিকে ইরান বনাম আমেরিকা-ইজ়রায়েল। ভয়ঙ্কর যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে পূর্ব ইউরোপ ও আরব দুনিয়া। এ-হেন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যেই ‘চুপিসারে’ পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে চিন। আর সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। এ বার কি তবে ওয়াশিংটনকে নিশানা করবে বেজিং? ড্রাগনের নিঃশ্বাসে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতেরও।
বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির আণবিক অস্ত্রের আনুমানিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে থাকে সুইডিশ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ বা সিপ্রি। সম্প্রতি তাদের দেওয়া রিপোর্টকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। সেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের যৌথ পরমাণু অস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি আণবিক ‘ওয়ারহেড’ রয়েছে বেজিঙের কাছে। শুধু তা-ই নয়, অন্যদের তুলনায় অনেকটাই দ্রুত এই হাতিয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
গত ১৬ জুন ওই রিপোর্ট প্রকাশ করে সিপ্রি। সুইডিশ সংস্থাটির দাবি, বছরে প্রায় ১০০টি করে নতুন পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ বাহিনীতে শামিল করছে চিন। ২০২৩ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছে বেজিং। এর জেরে বর্তমানে ড্রাগনভূমির ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র অস্ত্রাগারে আণবিক হাতিয়ারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০। সিপ্রির দেওয়া এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের ‘গোপন রিপোর্ট’-এর যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে। ফলে উদ্বেগ বেড়েছে ওয়াশিংটনের।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ‘চাইনিজ় মিলিটারি পাওয়ার’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট জমা পড়তেই পেন্টাগনের অন্দরে পড়ে যায় হইচই। সূত্রের খবর, সেখানে চিনা লালফৌজের কাছে অন্তত ৬০০টি পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ রয়েছে বলে সতর্ক করেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা। পাশাপাশি, ২০৩০ সালের মধ্যে বেজিঙের আণবিক হাতিয়ারের সংখ্যা আরও বেড়ে হাজারের ঘরে পৌঁছোবে বলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে উল্লেখ করেন তাঁরা।
সিপ্রি জানিয়েছে, পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএমের (ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল) সংখ্যাও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করছে চিন। ২০৩০ সালের মধ্যে ওয়াশিংটনের সমসংখ্যক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র থাকবে বেজিঙের হাতে। আণবিক হাতিয়ার বৃদ্ধির বর্তমান গতি বজায় থাকলে ২০৩৫ সালের মধ্যে একে দেড় হাজারে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে ড্রাগন সরকার।
বর্তমানে বিশ্বের যাবতীয় পরমাণু অস্ত্রের সিংহভাগই রয়েছে রাশিয়া এবং আমেরিকার কাছে। মস্কোর আণবিক অস্ত্রাগার সবচেয়ে বড়। সেখানে আনুমানিক ৫,৫০০ পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৫,১৭৭। অর্থাৎ, আণবিক অস্ত্রসংখ্যা বৃদ্ধি করলেও ২০৩৫ সালের মধ্যে এই দুই দেশকে কিছুতেই ছুঁতে পারবে না বেজিং।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, পরমাণু ‘ওয়ারহেড’-এর থেকেও পিএলএ-র আইসিবিএম সাইলো নিয়ে বেশি মাথাব্যথা রয়েছে আমেরিকার। সিপ্রি জানিয়েছে, উত্তর চিনের মরুভূমির মধ্যে তিন জায়গা এবং পূর্বের পাহাড়ি এলাকা জুড়ে একের পর এক এই সাইলো তৈরি করছে বেজিঙের লালফৌজ। চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে সেই সংখ্যা ৩৫০ ছাপিয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের সময় এগুলি থেকে আক্রমণ শানিয়ে ‘খেলা ঘোরাতে’ পারে ড্রাগন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই সাইলো? পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ যুক্ত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে কখনওই আর পাঁচটা হাতিয়ারের মতো সেনাছাউনির অস্ত্রাগারে রাখা হয় না। ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে বিশেষ ভাবে এগুলিকে সাজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। সেখানে বিশেষ ভাবে তৈরি উল্লম্ব লঞ্চার রেখেছে চিন। ফলে যুদ্ধের সময় ‘পাতালপুরী’ থেকে পরমাণু হামলা চালাতে পারবে বেজিং। এই ধরনের লঞ্চারগুলিকেই বাহিনীর পরিভাষায় বলা হয় আইসিবিএম সাইলো।
পিএলএ-র হাতে থাকা আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘ডংফেং’ বা ডিএফ-৫ এবং ডিএফ-৪১। প্রথমটির পাল্লা ১৩ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিলোমিটার। দ্বিতীয়টি আবার শব্দের চেয়ে ২৫ গুণ গতিতে ছুটতে পারে। ডিএফ-৪১-এর পাল্লা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার বলে দাবি করেছে বেজিং। সিপ্রির রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে দু’টি ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছেন ড্রাগনভূমির প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও-র তৈরি অগ্নি সিরিজ়ের দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে বিশেষ একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এর নাম, ‘মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্টলি টার্গেটেবল রিএন্ট্রি ভেহিকল’ বা এমআইআরভি। এই প্রযুক্তির জেরে অনেক বেশি ঘাতক এবং বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র। সিপ্রির রিপোর্ট অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিটি ডিএফ-৫ এবং ডিএফ-৪১-এ যুক্ত করতে বর্তমানে উঠেপড়ে লেগেছে জিনপিং সরকার।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে অধিকাংশ ‘ডংফেং’ সিরিজ়ের ক্ষেপণাস্ত্রকে পরমাণু ‘ওয়ারহেডে’ সজ্জিত করার পরিকল্পনা রয়েছে শি প্রশাসনের। ভূগর্ভস্থ সাইলোগুলিকে বেজিং কী ভাবে ব্যবহার করছে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে অনুমানের উপর ভিত্তি করে রিপোর্ট একটি তথ্য দিয়েছে সিপ্রি। আর সেটি প্রকাশ্যে আসতেই চোখ কপালে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের।
সুইডিশ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে, বর্তমানে নির্মীয়মাণ প্রতিটি সাইলোতে চিনা পিএলএ যদি অন্তত একটি করে একক পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ বিশিষ্ট আইসিবিএম রাখে, তা হলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৬৫০টি আণবিক অস্ত্র মোতায়েন করে ফেলবে বেজিং। কিন্তু, একটি সাইলোতে যদি দু’-তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র রাখার ব্যবস্থা থাকে, তা হলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকবে অন্তত ১,২০০ পরমাণু ‘ওয়ারহেড’! এই পরিসংখ্যান যে আমেরিকার রাতের ঘুম কেড়ে নেবে, তা বলাই বাহুল্য।
এর পাশাপাশি পরমাণু শক্তিচালিত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী ডুবোজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে পিএলএ নৌসেনার। সিপ্রি জানিয়েছে, এই ধরনের কতগুলি ডুবোজাহাজ বাহিনীতে শামিল করা হবে, তা এখনও স্পষ্ট করেনি বেজিং। উল্টে ডুবোজাহাজের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা এবং শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সংখ্যার নিরিখে কয়েক বছর আগেই মার্কিন নৌসেনাকে ছাপিয়ে গিয়েছে ড্রাগন। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী রয়েছে প্রেসিডেন্ট শির কাছে।
পরমাণু হামলা চালানোর আর একটি বড় অস্ত্র হল কৌশলগত বোমারু বিমান। এই দিক থেকে চিনের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে রয়েছে আমেরিকা। মার্কিন বায়ুসেনার বহরে আছে ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির ‘বি-২ স্পিরিট’। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সংস্থা ‘নর্থরপ গ্রুমম্যান’-এর তৈরি এই কৌশলগত বোমারু বিমান ১,১০০ কেজির ১৬টি আণবিক বোমা বহনে সক্ষম। দীর্ঘ সময় আকাশে ভেসে থাকার ক্ষমতা রয়েছে এই যুদ্ধবিমানের। তা ছাড়া মাঝ-আকাশে জ্বালানি ভরতে পারে ওয়াশিংটনের ‘বি-২ স্পিরিট’।
সিপ্রির রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্কিন বায়ুসেনার সমক্ষমতা সম্পন্ন বোমারু বিমান তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের। তা ছাড়া ২০৩০ সালের পিএলএ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হবে পরবর্তী প্রজন্মের পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ। ফলে সমুদ্রের গভীরে থেকে পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ যুক্ত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলার শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে জিনপিং ফৌজের, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সুইডিশ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থাটির পাশাপাশি ‘চাইনিজ় নিউক্লিয়ার ওয়েপন, ২০২৫’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট ইন ওয়াশিংটন’ নামের একটি সংগঠন। এর পরমাণু তথ্য প্রকল্পের ডিরেক্টর হ্যান্স এম. ক্রিস্টেনসেন জানিয়েছেন, চলতি বছরে বেজিং কতগুলো নতুন পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ তৈরি করতে পারবে, সেটা মূলত তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করছে। ড্রাগনের কাছে প্লুটোনিয়াম, অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এবং ট্রিটিয়ামের যত বেশি পরিমাণে মজুত থাকবে, এর সংখ্যা ততই লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই বিষয়ে অবশ্য স্পষ্ট কোনও সরকারি তথ্য নেই। ২০২৩ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ফিসাইল ম্যাটেরিয়ালস’-এর প্রকাশ করা রিপোর্ট অনুযায়ী, চিনের কাছে প্রায় ১৪ টন অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এবং প্রায় ২.৯ টন প্লুটোনিয়াম মজুত রয়েছে। এগুলির সাহায্যে হাজারের বেশি পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ অনায়াসেই তৈরি করতে পারবে বেজিং।
পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত সিপ্রির ওই রিপোর্টকে অবশ্য পুরোপুরি অস্বীকার করেছে ড্রাগন। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়েছে বেজিঙের বিদেশ মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থেই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে চিন। আর তাই দ্রুত গতিতে এর সংখ্যাবৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তা মনগড়া, অবাস্তব এবং কাল্পনিক। একে পশ্চিমি দুনিয়ার উস্কানি এবং চাপ তৈরির কৌশল বলে সুর চড়িয়েছে শি-র প্রশাসন।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অবশ্য দাবি, মুখে সুনির্দিষ্ট পরমাণু অস্ত্র নীতির কথা বললেও এ ব্যাপারে ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছে বেজিং। সেই কারণেই আণবিক ‘ওয়ারহেডে’র সঠিক সংখ্যা কখনওই প্রকাশ করেনি চিন। এই ‘মারণাস্ত্র’র সংখ্যা হ্রাস বা নিরস্ত্রীকরণের নীতিতেও বিশ্বাসী নয় ড্রাগন। তবে আণবিক অস্ত্রমুক্ত দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটি ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি অবশ্য দিয়ে রেখেছে জিনপিংয়ের দেশ।
সিপ্রির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পরমাণু ‘ওয়ারহেড’-এর সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে ভারত। বর্তমানে নয়াদিল্লির হাতে ১৮০টি আণবিক হাতিয়ার রয়েছে। অন্য দিকে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় তা দাঁড়িয়ে আছে ১৭০-এ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন করে অশান্তির কালো মেঘ জমতে থাকায় কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।