India-Pakistan Tensions After Pahalgam

বৈসরনের বদলার পথে কাঁটা বিছোচ্ছে চিন, পাকিস্তানপ্রেমী ড্রাগনের চক্রান্তের ‘বাড়া ভাতে’ কী ভাবে ‘ছাই’ দেবে ভারত?

পহেলগাঁওয়ের বদলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে ইসলামাবাদকে সমর্থন করবে বলে একরকম জানিয়েই দিয়েছে চিন। ফলে ফৌজি অভিযানের আগে মেপে পা ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন কূটনীতিক থেকে সাবেক সেনাকর্তারা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৫ ০৭:৩১
Share:
০১ ১৯

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সুযোগে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারার চেষ্টা করতে পারে বেজিং। উত্তর এবং উত্তর-পূর্বের জমি কব্জা করতে চুপিসাড়ে আগ্রাসী ড্রাগনের লালফৌজের এগিয়ে আসার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।

০২ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি জেনারেলদের এ হেন সাবধানবাণী ফেলে দেওয়ার নয়। কারণ অতীতে ভারত-পাক সংঘাতের সুযোগ নিয়ে বহু ক্ষেত্রে এই ধরনের ঝুঁকি নিয়েছে চিন। উদাহরণ হিসাবে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় অবশ্য নীরব ছিল বেজিং। এতে ইসলামাবাদের বাহিনীকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করতে বড় সুবিধা পায় ভারতীয় ফৌজ।

Advertisement
০৩ ১৯

মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএর গোপন নথি অনুযায়ী, ১৯৬৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তিন দিনের মধ্যে সিকিম সীমান্ত থেকে সামরিক পরিকাঠামো সরাতে বা ভেঙে ফেলতে নয়াদিল্লিকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছিল চিনের ‘পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। ওই সময়ে পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোদস্তুর লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল ভারতীয় ফৌজ।

০৪ ১৯

১৯৬৫-এর যুদ্ধে সিকিমকে কেন্দ্র করে চিন যখন চাপ সৃষ্টি করছে, উত্তর-পূর্বের রাজ্যটি পুরোপুরি ভাবে তখনও ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সেটি ছিল নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষামূলক রাজ্য বা প্রোটেক্টরেট স্টেট। সেই সুবাদে সীমান্ত সুরক্ষায় দায়িত্ব পাওয়ায় সিকিমে ঢোকার অনুমতি ছিল ভারতীয় সেনার। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার নথি অনুযায়ী, ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে এ দেশের বাহিনীর সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধিয়েছিল ড্রাগনের লালফৌজ।

০৫ ১৯

চিনা পিএলএর অভিযোগ ছিল, সিকিম সীমান্তে নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে সামরিক কাঠামো তৈরি করেছে ভারত। ১৯৬৪ সালের অগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে নাথু লা এবং সংলগ্ন এলাকায় তাদের জমিতে ঢুকে বাঙ্কার তৈরি করা হয়েছে বলেও দাবি করে বেজিং। এই সময়সীমার মধ্যে এ দেশের বাহিনী নাকি ওই এলাকায় মোট ১৮টি আক্রমণাত্মক সামরিক কাঠামো নির্মাণ করেছিল।

০৬ ১৯

সিআইএ জানিয়েছে, ১৯৬৫ সালের গোড়া থেকে এই ইস্যুতে ভারতের উপর চাপ বাড়াতে থাকে তৎকালীন ড্রাগন সরকার। ওই বছরের জানুয়ারিতে নাথু লার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ভারতের সামরিক পরিকাঠামোর সংখ্যা বেড়ে ৩১ হয়েছে বলে দাবি করে বেজিং। ১৮ জানুয়ারি এই অঙ্ককে আরও বাড়িয়ে ৫০ বলা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বার বার বলা সত্ত্বেও সিকিম সীমান্ত থেকে ভারতীয় বাহিনী সামরিক কাঠামো ভেঙে ফেলছে না বলে ২৯ জুলাই ক্ষোভপ্রকাশ করে চিনা প্রশাসন।

০৭ ১৯

বেজিঙের এ হেন অভিযোগ পুরোপুরি নস্যাৎ করে নয়াদিল্লি। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দারা মনে করেন, চিনা চাপের কারণেই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ণ শক্তি দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করতে পারেনি ভারতীয় ফৌজ। বাহিনীর একটি বড় অংশকে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মোতায়েন রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন তৎকালীন সেনাকর্তারা। ফলে বেশ কয়েকটি রণাঙ্গনে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় নয়াদিল্লিকে। যদিও ওই যুদ্ধে এক ইঞ্চি জমিও হারায়নি ভারত।

০৮ ১৯

’৬৫ সালের অগস্টে জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) অতিক্রম করে পাক সেনা হামলা করলে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বিতীয় বারের জন্য বেধে যায় পুরোদস্তুর যুদ্ধ। ইসলামাবাদের কুর্সিতে তখন সেনাশাসক তথা প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খান। তাঁর অনুমতিতে হওয়া এই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’। মার্কিন গোয়েন্দারা মনে করেছিলেন, ঠিক এই সময়ে উত্তর-পূর্বের চুম্বি উপত্যকা দিয়ে ভারতভূমিতে তীব্র আক্রমণ শানাবে চিন।

০৯ ১৯

সামরিক কৌশলগত দিক থেকে চুম্বি উপত্যকার গুরুত্ব অপরিসীম। জায়গাটি ভারতের সেনার হাতছাড়া হলে অসমকে বিচ্ছিন্ন করতে পারত চিনা পিএলএ। পাশাপাশি, ওই রাস্তায় পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ঢুকে ইসলামাবাদের হাত শক্ত করা বেজিঙের পক্ষে সহজ হবে বলে মনে করেছিলেন আমেরিকার গুপ্তচরেরা। আর সেটা হলে নয়াদিল্লি যে যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজি সাহায্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠবে, ওয়াশিংটনে পাঠানো রিপোর্টে সে কথার উল্লেখ করেছিলেন তাঁরা।

১০ ১৯

তবে পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে ভারত যে সোভিয়েত ইউনিয়ানের (বর্তমান রাশিয়া) দ্বারস্থ হবে না, সে কথা জোর দিয়ে বলতে পারেননি মার্কিন গুপ্তচরেরা। রিপোর্টে তাঁরা লেখেন, মস্কোর সঙ্গে দিল্লির বেশ মজবুত কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দু’জনে একে অপরকে বিশ্বাস করে এবং তার মর্যাদা রাখতেও জানে। ফলে সাহায্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর প্রথম পছন্দ ওয়াশিংটনের বদলে ক্রেমলিন হলে আশ্চর্যের কিছু নেই।

১১ ১৯

এ ছাড়া সিআইএর গুপ্ত নথিতে সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান ফিল্ডমার্শাল স্যাম মানেকশ’র দিল্লিতে পাঠানো বেশ কয়েকটি চিঠির উল্লেখ ছিল। ওই সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ পদে ছিলেন তিনি। চিঠিতে স্যাম লেখেন, ‘‘নাথু লা এবং জেলেপ লাতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সীমান্তবর্তী চৌকিগুলির কাছে আসতে শুরু করেছে চিনা বাহিনী। তাদের সংখ্যা এক ব্যাটেলিয়ান (আনুমানিক ৮০০ সৈনিক)। তবে বেজিঙের লালফৌজ ১০০ গজের মধ্যে আসার সাহস দেখায়নি।’’

১২ ১৯

তবে উত্তর সিকিম, ভুটান সীমান্ত, নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি বা নেফা এবং লাদাখের ডেমচক এলাকায় চিনা আগ্রাসনের আশঙ্কা নেই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন ফিল্ডমার্শাল স্যাম। ’৬৫ সালের যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই সিকিমে আগ্রাসী মনোভাব দেখায় বেজিঙের লালফৌজ। ওই বছরের নভেম্বরে সীমান্ত সংঘর্ষে প্রাণ হারান এক জন ভারতীয় সৈনিক।

১৩ ১৯

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতেও সেই সুবিধা পাচ্ছে পাকিস্তান। কারণ পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে বিপুল পরিমাণে লগ্নি রয়েছে বেজিঙের। এর মধ্যে অন্যতম হল ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর বা সিপিইসি)। ফলে যুদ্ধ বাধলে ড্রাগনের ‘অন্ধ’ সমর্থন পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে না ইসলামাবাদ।

১৪ ১৯

চলতি বছরের ৫ মে পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে বৈঠক করেন চিনা রাষ্ট্রদূত জিয়াং জাইদং। সূত্রের খবর, সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বেজিং যে ইসলামাবাদকে সমর্থন করবে, তা স্পষ্ট করে দেন তিনি। এর আগে ২ মে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সঙ্গেও বৈঠক করেন বেজিঙের এই শীর্ষ কূটনীতিক।

১৫ ১৯

গোয়েন্দাদের দাবি, সংঘাতের আবহে পর্দার আড়ালে থেকে পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে ড্রাগন সরকার। ইসলামাবাদের বায়ুসেনার বহরে রয়েছে বেজিঙের তৈরি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান। সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটগুলির জন্য বেজিং থেকে পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র ইসলামাবাদ হাতে পেয়েছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।

১৬ ১৯

জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংবাদ সংস্থা ক্ল্যাশরিপোর্টের প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস জানিয়েছে, ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বায়ুসেনার অস্ত্রাগার থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পাকিস্তানকে সরবরাহ করেছে চিন। পাশাপাশি, পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে, এই ধরনের আরও হাতিয়ার পাক ফৌজকে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ড্রাগন সরকার।

১৭ ১৯

তবে বেজিং হাত খুলে ইসলামাবাদকে সমর্থন করলে আমেরিকা ও রাশিয়া যে চুপ করে বসে থাকবে না, সে বিষয়ে একরকম নিশ্চিত প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। এখনও পর্যন্ত এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে। তবে মার্কিন সমর্থনের পাল্লা কিছুটা ভারতের দিকে ঝোঁকা বলে মনে করা হচ্ছে। এই বিবাদে চিন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ালে ওয়াশিংটন ইউটার্ন নিতে বাধ্য, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১৮ ১৯

অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে নয়াদিল্লির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। মোদী তাঁকে দিল্লিতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আর সেটা গ্রহণও করেছেন পুতিন। তিনি ভারত সফরে এলে অনেক অঙ্কই বদলাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

১৯ ১৯

গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। ওই ঘটনার বদলা নিতে তিন সেনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেই প্রত্যাঘাতের পথে একমাত্র কাঁটা চিনকে কী ভাবে নয়াদিল্লি সামলায় সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement