কথায় আছে, একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর! ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসির (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর) দ্বিতীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মুখে সেই চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছে ভারত। কারণ, শত্রুভাবাপন্ন দুই প্রতিবেশীর ওই প্রকল্পে এ বার যোগ দিচ্ছে আফগানিস্তান। ফলে জাতীয় নিরাপত্তার নিরিখে রক্তচাপ বেড়েছে নয়াদিল্লির।
চলতি বছরের ২০ অগস্ট সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের সূচনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জনপ্রিয় পাক গণমাধ্যম ‘দ্য ডন’। ইসলামাবাদের পরিকল্পনা রূপায়ণমন্ত্রী আহসান ইকবালকে উদ্ধৃত করে সেখানে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের আসন্ন চিন সফরে এর চূড়ান্ত ঘোষণা হবে। উভয়পক্ষ এ ব্যাপারে একমত হয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার আগে যৌথ সহযোগিতা কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
এ বছরের ৩১ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিনের তিয়ানজ়িনে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও ভুক্ত (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সম্মেলনে যোগ দিতে ড্রাগনভূমিতে যাবেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। সেখানে মান্দারিনভাষী প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। ওই আলোচনার পরেই সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে বলে দাবি করেছে ‘দ্য ডন’।
বেজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআইয়ের অন্যতম অঙ্গ হল ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’। ২০১৫ সালে শুরু হয় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজ। তাতে চিনের কাশগড় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম পাক প্রদেশ বালোচিস্তানের গ্বদর পর্যন্ত রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ড্রাগন সরকার। বর্তমানে এই প্রকল্প শেষের মুখে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ‘পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর’ বা পিওজেকের (পাক অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ওই রাস্তা।
সেই কারণে সিপিইসি নিয়ে প্রথম থেকে আপত্তি জানিয়ে এসেছে নয়াদিল্লি। যদিও বেজিং বা ইসলামাবাদ— কেউই তা কানে তোলেনি। প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পে রাস্তা তৈরির পাশাপাশি পরিকাঠামো এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপরে জোর দেয় ড্রাগন সরকার। গোড়ার দিকে এতে চিনের লগ্নির পরিমাণ ছিল ৪,৬০০ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে সেই অঙ্ক বেড়ে ৬,২০০ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছোয়। ২০২০ সালের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি।
‘দ্য ডন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে আরও কিছু বিষয়কে যুক্ত করছে চিন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। সেগুলি হল শিল্পায়ন, খনিজ সম্পদের উত্তোলন, রফতানি, কৃষি এবং প্রযুক্তি। এর আওতায় ইসলামাবাদের প্রতিটি প্রদেশে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা এসইজ়েড (স্পেশাল ইকোনমিক জ়োন) তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের। সেখানে ড্রাগনভূমির একাধিক শিল্প সংস্থাকে উৎপাদনের জন্য জায়গা দেবে শাহবাজ় সরকার।
এ ছাড়া সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের রাজধানী করাচি থেকে খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ার পর্যন্ত রেলপথ বিস্তারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চিন। পাশাপাশি, বালোচিস্তানের গ্বদরে গভীর সমুদ্র বন্দর এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির কাজ করবে বেজিং। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের প্রদেশটির খনিজ সম্পদ উত্তোলনের দায়িত্বও মান্দারিনভাষীদের উপরে শাহবাজ় প্রশাসন ছাড়তে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের খনিজ সম্পদ নিয়ে প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছে আমেরিকা। গত জুলাইয়ে ইসলামাবাদের ‘বিশালা তৈলভান্ডার’ নিয়ে যৌথ ভাবে কাজ করার বার্তা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর অবশ্য দাবি, তেলের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি আগ্রহ রয়েছে বালোচিস্তানের অনাবিষ্কৃত বিরল খনিজ ভান্ডারের উপর, যা বৈদ্যুতিন এবং সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের এই বিরল খনিজ সম্পদ নিয়ে কিছু দিন আগে গণমাধ্যমে লেখা একটি নিবন্ধে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। সেখান তিনি লেখেন, ‘‘আমাদের কাছে যে বিরল খনিজ সম্পদ রয়েছে তাতে জাতীয় ঋণ কমানো সম্ভব। এর সাহায্যে শীঘ্রই সমৃদ্ধ বিশ্বের মধ্যে জায়গা পাবে ইসলামাবাদ।’’ বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, বালোচিস্তানের খনিজ সম্পদের দখলকে কেন্দ্র করে অচিরেই পাকিস্তানের ভিতরে মুখোমুখি হবে আমেরিকা ও চিন।
সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ে কৃষিজাত পণ্য নিয়ে পাকিস্তানের বাজারে প্রবেশাধিকার চেয়েছে চিন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত রাস্তা সম্প্রসারণের কথা রয়েছে বেজিঙের। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের জন্য ড্রাগন সরকার মোট কত কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে, তা অবশ্য গোপন রেখেছে দু’পক্ষ।
গত ২০ অগস্ট কাবুলে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করেন আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি, চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই এবং পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী ইশক দার। সেখানেই সিপিইসিতে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিকে সামিল করার ব্যাপারে বিষয়টিতে চূড়ান্ত সিলমোহর দেয় বেজিং এবং ইসলামাবাদ। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ কবে থেকে শুরু হবে, তা নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা রয়েছে।
পাক গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, অগস্টের শেষ সপ্তাহ বা সেপ্টেম্বরের গোড়ায় শুরু হয়ে যাবে সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। এ বছরের অক্টোবরে বেজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে এই নিয়ে যৌথ সহযোগিতা কমিটি বা জেসিসির (জয়েন্ট কো-অপারেশন কমিটি) বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তাই অধিকাংশ বিশ্লেষকেরই অনুমান, ওই বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিক ভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে উদ্যোগী হবে ড্রাগন সরকার।
এ দেশের সাবেক সেনাকর্তারা মনে করেন, সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের মাধ্যমে পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে ভারতকে ঘেরার চেষ্টা করছে চিন। একে বেজিঙের ‘মুক্তোর সুতো’ বা ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’ নীতির অঙ্গ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। গ্বদরের গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আরব সাগরের দিক থেকে এ দেশের পশ্চিম উপকূলে নজরদারি চালাতে পারবে ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনা।
দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে গ্বদর বন্দরকে ব্যবহার করে পারস্য উপসাগরের দিকে ভারতের সমুদ্রবাণিজ্য বন্ধ করার চেষ্টা করতে পারে চিন। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে বেজিং, ইসলামাবাদ এবং কাবুলের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার নিরিখে নয়াদিল্লির কাছে সেটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
২০২১ সালে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর দ্বিতীয় বারের জন্য আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসে তালিবান। ওই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই কাবুলের নতুন সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয় বেজিং। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও হিন্দুকুশের কোলের দেশটির সঙ্গে এখনও সরকারি ভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি নয়াদিল্লি। যদিও তালিবানের সঙ্গে নানা ইস্যুতে যোগাযোগ রেখে চলেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ে পাকিস্তানের সামনেও রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, প্রথম পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকাঠামো বেজিং তৈরি করেছে, সেগুলি এসইজ়েডে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ফলে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে বিদ্যুতের ঘাটতি কমার কোনও সম্ভাবনা নেই। একে কেন্দ্র করে সিন্ধ, বালোচিস্তান এবং খাইবার-পাখতুনখোয়ায় প্রবল গণবিক্ষোভের আশঙ্কা রয়েছে।
‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’র প্রথম পর্যায়ে বেজিঙের থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে ইসলামাবাদ। সেই অর্থের সিকিভাগও শোধ করতে পারেনি তারা। এই অবস্থায় দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হলে ঋণের বোঝা যে পাকিস্তানের উপরে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। ফলে আগামী দিনে ‘আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার’ বা আইএমএফের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড) মতো সংস্থার থেকে আর্থিক অনুদান পাওয়া শাহবাজ় সরকারের পক্ষে কঠিন হবে।
সূত্রের খবর, সিপিইসির প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য নেওয়া ঋণ নিয়ে চিনের সঙ্গে কিছু দিনের মধ্যে বৈঠকে বসবে পাকিস্তান। সেখানে ঋণ মকুবের শর্ত হিসাবে বেজিঙের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে কয়লা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে ইসলামাবাদ। পাশাপাশি, বালোচিস্তান এবং খাইবার-পাখতুনখোয়ায় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় জোর দিচ্ছে ড্রাগন সরকার।
বালোচিস্তানের গ্বদর সমুদ্রবন্দর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে ৪০ বছরের চুক্তি করেছে চিন। সেখান থেকে আয় হওয়া অর্থের ৮৫ থেকে ৯১ শতাংশ পাবে বেজিং। বাকি টাকা যাবে ইসলামাবাদের কোষাগারে। এ ছাড়া খনিজ সম্পদ উত্তোলনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের প্রদেশটির আমজনতার মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ। ফলে সেখানে দানা বেঁধেছে সশস্ত্র বিদ্রোহ।
বিশ্লেষকদের অনুমান, সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুর আগেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে পারে ‘বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি’ বা বিএলএর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী। এর আগেও চিনা ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মীদের নিশানা করেছে তারা। পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরেও মূল্যবৃদ্ধির মতো ইস্যুকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভ তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে বিমার খরচ ড্রাগন সরকার বাড়াতে চলেছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
আর তাই সিপিইসিকে পাকিস্তানের আর্থিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ হিসাবেই দেখছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি, এতে সব দিক থেকেই চিনের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ফের একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে ইসলামাবাদের।