ফের হাতিয়ারের দুনিয়ায় চিনা চমক! নতুন প্রজন্মের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালাল বেজিং। ড্রাগনভূমির প্রতিরক্ষা গবেষকদের দাবি, এর সাহায্যে চোখের পলকে ধ্বংস হবে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির লড়াকু জেট। পাশাপাশি, ওড়ানো যাবে বিমানবাহী রণতরী-সহ অন্যান্য যুদ্ধপোত। মান্দারিনভাষীদের এ-হেন সাফল্যে ঘুম উড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে নয়াদিল্লিরও।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিন যে নতুন প্রজন্মের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটির পরীক্ষা চালিয়েছে, তার গতিবেগ ৫ ম্যাক। অর্থাৎ, শব্দের পাঁচ গুণেরও বেশি গতিতে ছুটতে পারে ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। তবে হাতিয়ারটির আসল শক্তি লুকিয়ে আছে তার নকশায়। সেখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন বেজিঙের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন আকার নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ড্রাগনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
সাধারণত, গতির ঝড় তুলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে আছড়ে পড়ে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। মাঝ-আকাশে লড়াকু জেটের মতো ভল্ট খাওয়া বা সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া এর পক্ষে অসম্ভব। সূত্রের খবর, সেখানেই সাফল্য পেয়েছে চিন। বেজিঙের দাবি সত্যি হলে একে আটকানো যে কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র্যাফটর এবং এফ-৩৫ লাইটনিং টু-র মতো ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির লড়াকু জেটকে নিশানা করতে এর জন্ম হয়েছে বলে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
চিনা প্রতিরক্ষা জার্নালকে উদ্ধৃত করে ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্স’ জানিয়েছে, বেজিঙের তৈরি নতুন প্রজন্মের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটিকে রয়েছে এক জোড়া ডানা। সেগুলিকে আবার প্রয়োজনমতো খোলা বা জোড়া যায়। এ ছাড়া উড়ন্ত অবস্থায় ডানাগুলিকে ভাঁজ করে রাখার সুযোগ রয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, এর জন্যেই লক্ষ্যে আঘাত হানার মুখে মাঝ-আকাশে প্রয়োজন মতো ডিগবাজি খেতে বা সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটতে পারে ড্রাগনের তৈরি ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদসংস্থা ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এ মুখ খুলেছেন চিনের ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ ডিফেন্স টেকনোলজি’র কলেজ অফ অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক ওয়াং পেং। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা প্রথাগত হাইপারসনিক যানের নকশা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছি। আর তাই এই ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করতে পারবে না কোনও রেডার। ফলে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) এর আটকে যাওয়ার ভয় নেই।’’
ওয়াং পেং অবশ্য মনে করেন সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিটি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই ব্যবহার হবে, এমনটা নয়। তাঁর দাবি, ভবিষ্যতে মহাকাশ গবেষণায় এই ধরনের রকেটের বহুল ব্যবহার করবে বেজিং। কারণ, আগামী দিনে কম সময়ে এবং কম খরচে বহু সংখ্যায় কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের। আবহাওয়া এবং টেলি-যোগাযোগের পাশাপাশি সেগুলি যে গুপ্তচরবৃত্তির কাজেও ব্যবহৃত হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
পেংয়ের কথা বিশ্লেষণ করে সাবেক সেনাকর্তারা জানিয়েছেন, আধুনিক হাতিয়ারে এই ধরনের ডানার ব্যবহার মোটেই নতুন নয়। এর আগে ভাঁজ করা এবং খোলা-জোড়ার সুবিধাযুক্ত ডানা লাগিয়ে ওড়ানো হয়েছে বেশ কিছু সামরিক ড্রোন। এতে উল্লম্ব ভাবে ওঠানামায় সুবিধা পেয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট পাইলটবিহীন যান। একাধিক রোটার থাকায় বাড়ানো যায় এর গতিবেগও।
উদাহরণ হিসাবে ‘রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা আরওকের (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) ‘ফ্লাইং স্কুইরেল’ ড্রোনের কথা বলা যেতে পারে। এতে ভাঁজযুক্ত ডানা ব্যবহার করেছেন সোলের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ফলে যথেষ্ট গতিতে থাকা অবস্থাতেই মাঝ-আকাশে বাঁক নিতে পারে ওই যান। এ ছাড়া দ্রুত থেমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্ষিপ্রতায় নীচের দিকে নেমে আসার ক্ষমতার রয়েছে এই ড্রোনের। এর আকার অনেকটা উড়ন্ত কাঠবিড়ালির মতো।
সূত্রের খবর, স্থিরের চেয়ে ভাঁজযুক্ত ডানা থাকলে সামরিক ড্রোনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় অন্তত ১৩ শতাংশ। তবে পাঁচ ম্যাক গতির কোনও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে এই ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার মোটেই সহজ নয়। কারণ, লক্ষ্যের দিকে দৌড় শুরু করতেই সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির পিঠের তাপমাত্রা এক ঝটকায় পেরিয়ে যায় দু’হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে বায়ুমণ্ডলেও ক্রমাগত রাসায়নিক এবং ভৌত পরিবর্তন হতে থাকে।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, চলতি বছরের অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে সংশ্লিষ্ট হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় চিন। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি বেজিং। অন্য দিকে এ ব্যাপারে আমেরিকার যুদ্ধ দফতরের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে ড্রাগন তো বটেই রাশিয়া, ইরান এবং ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকে-র (পড়ুন উত্তর কোরিয়া) চেয়েও অনেক পিছিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র।
২১ শতকের গোড়াতেই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকে নজর দেয় পেন্টাগন। কিন্তু, এখনও এ ব্যাপারে সে ভাবে সাফল্য পাননি ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে এর জন্য ৬৯০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৩-’২৪ এবং ২০২২-’২৩ আর্থিক বছরে টাকার অঙ্কটা ছিল যথাক্রমে ৪৭০ কোটি এবং ৩৮০ কোটি ডলার।
সূত্রের খবর, বর্তমানে একসঙ্গে তিনটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে আমেরিকা। সেগুলি হল, স্থলসেনার জন্য লং-রেঞ্জ হাইপারসনিক ওয়েপন, নৌসেনার কনভেনশনাল প্রম্পট স্ট্রাইক এবং বিমানবাহিনীর হাইপারসনিক অ্যাটাক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলির কোনওটিরই নমুনা বা প্রোটোটাইপ তৈরির কাজও শেষ করতে পারেনি ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজের জন্য হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের দায়িত্বভার ‘ডিফেন্স অ্যাডভান্স রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি’ বা ডিএআরপিএ-র কাঁধে দিয়েছেন ট্রাম্প। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে মহড়ার সময় ‘ডার্ক ইগল’ নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রকাশ্যে আনে আমেরিকা। ১,৭০০ কিলোমিটার পাল্লার সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির হাইপারসনিক গতিতে ছোটার ক্ষমতা রয়েছে। তার পরেও রাশিয়া এবং চিনের থেকে এ ব্যাপারে ওয়াশিংটন পিছিয়ে আছে বলেই মনে করেন তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন মার্কিন ফৌজের পদস্থ অফিসার মেজর জেনারেল ফ্রাঙ্ক লোজ়ানো। তিনি বলেন, ‘‘আমরা যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে হাইপারসনিক হিসাবে ব্যবহার করছি, সেগুলির গতিবেগ বড়জোর পাঁচ থেকে ছ’ম্যাক। কিন্তু রাশিয়া বা চিনের হাতিয়ারগুলি ১০ থেকে ১২ ম্যাক গতিতে ছুটতে সক্ষম। এটা আমাদের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের।’’
মেজর জেনারেল লোজ়ানো জানিয়েছেন, দ্বিতীয় অসুবিধা হল একসঙ্গে বিপুল সংখ্যায় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্রের কোনও প্রতিরক্ষা সংস্থা। বর্তমানে তাঁদের হাতে মাত্র এক ইউনিট ‘ডার্ক ইগল’ রয়েছে। এ বছরের একেবারে শেষে বা আগামী বছরের গোড়ায় সংশ্লিষ্ট ‘ব্রহ্মাস্ত্র’টির আরও একটি ব্যাটারি বাহিনীর অস্ত্রভান্ডারে যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্য দিকে রাশিয়ার হাতে তিন ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। সেগুলি হল, কিনজ়ল, সিরকন এবং অ্যাভানগার্ড। এ ছাড়া এ বছরের জুনের শুরুতে চতুর্থ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ওরেশনিকের ব্যাপক উৎপাদনের নির্দেশ দেয় মস্কো। গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালাতে এগুলির বহুল ব্যবহার করেছে ক্রেমলিন।
এ ছাড়া গত ২১ অক্টোবর পরমাণু অস্ত্রবহনে সক্ষম ‘৯এম৭৩০ বুরেভেস্টনিক’ (স্টর্ম পেট্রল) ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় মস্কো। ক্রেমলিনের দাবি, উৎক্ষেপণের পর ১৪ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ওই হাতিয়ার, যা আকাশে ছিল অন্তত ১৫ ঘণ্টা! সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি যাবতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ভেদ করে আক্রমণ শানাতে পারবে। রুশ প্রতিরক্ষা গবেষকদের এ-হেন সাফল্যের পর গোটা পশ্চিমি দুনিয়ায় হইচই পড়ে যায়।
চিনা লালফৌজের কাছে আবার দু’ধরনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। সেগুলি হল, ডিএফ-১৭ এবং ওয়াইজ়ে-২১। দ্বিতীয়টিকে সমুদ্রভিত্তিক বলে জানিয়েছে বেজিং। এ ছাড়া প্রথমটি পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম। ফলে সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে এগুলির সাহায্যে প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন ঘাঁটিগুলিকে অনায়াসে নিশানা করতে পারবে ড্রাগনের ফৌজ।
বিশ্লেষকদের দাবি, এ-হেন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চুপ করে বসে থাকা একেবারেই সম্ভব নয়। ফলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পে গতি আনার নির্দেশ দিতে পারেন ট্রাম্প। সম্প্রতি পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষায় সবুজ সঙ্কেত দিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এ ছাড়া ‘গোল্ডেন ডোম’ নামের একটি মহাকাশভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে আমেরিকা। সেই জালে চিনা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ধরা পড়ে কি না, তার জবাব দেবে সময়।