ভারতকে প্যাঁচে ফেলতে ফের চিনের চালবাজি! নয়াদিল্লিকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন জোট তৈরিতে আগ্রহী বেজিং। পাকিস্তানের পাশাপাশি সেখানে যোগ দিতে পারে বাংলাদেশও। প্রতিরক্ষা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, সংশ্লিষ্ট জোট তৈরি হলে ভবিষ্যতে নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাকেও টেনে এনে দল ভারী করবে ‘আগ্রাসী’ মান্দারিনভাষীরা। ফলে বিষয়টি নিয়ে সাউথ ব্লকের উদ্বেগ যে বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের ১৯ জুন চিনের কুনমিং প্রদেশে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন ব্লক তৈরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন বেজিং ও ইসলামাবাদের শীর্ষকর্তারা। সেখানে হাজির ছিলেন ঢাকার প্রতিনিধি। জনপ্রিয় পাক সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বৈঠকে নতুন জোট তৈরির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ‘দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা’ বা সার্ক-ভুক্ত (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিয়োনাল কোঅপারেশন) দেশগুলিকে ওই ব্লকে আমন্ত্রণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
এত দিন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে সার্ক। বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতের নেতৃত্বে চলা সংশ্লিষ্ট জোটটিকে পুরোপুরি ‘খতম’ করতে উদ্যোগী হয়েছে চিন। সেই লক্ষ্যে নতুন ব্লক তৈরিতে বার বার জোর দিচ্ছে বেজিং। ড্রাগনের হাত ধরে ত্রিশক্তি জোটের জন্ম হওয়ার আগেই একে ‘শয়তানের ব্লক’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনা অফিসারদের বড় অংশ। পাশাপাশি, পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগে নয়াদিল্লিকে পাল্টা পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, বর্তমান সময়ে সার্কের প্রয়োজনীয়তা সত্যিই ফুরিয়ে গিয়েছে। কারণ, ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলিকে আলাদা করে দক্ষিণ এশিয়া হিসাবে গুরুত্ব দিতে নারাজ পশ্চিমি বিশ্ব। সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে আর্থিক, সামরিক বা মহাকাশ গবেষণার নিরিখে বাকিদের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি। এর জেরে ভারতের বিদেশনীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসেছে বড় বদল।
নয়াদিল্লির এ-হেন উত্থানের জেরে প্রমাদ গোনে চিন এবং পাকিস্তান। ফলস্বরূপ, গত কয়েক বছরে বেজিং এবং ইসলামাবাদের মধ্যে যথেষ্ট মজবুত হয়েছে সম্পর্ক। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট জোটটি তৈরি করতে দীর্ঘ দিন ধরেই গোপনে গোপনে আলোচনা চালিয়েছে এই দুই দেশ। কিন্তু, এ ব্যাপারে আর কেউ, বিশেষত বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশ না-করায় প্রস্তাবিত জোটটিকে বাস্তবের রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে যাবতীয় চ্যালেঞ্জ টপকে এ বার সেই লক্ষ্যে চিন এবং পাকিস্তান সফল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতকে ঘিরতে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জোট তৈরির সময়টি নির্বাচন করেছে বেজিং। কারণ আগামী চার বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে থাকবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর সাম্প্রতিক কর্মপদ্ধতিকে সন্দেহের চোখে দেখছে নয়াদিল্লি। এর জেরে ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ‘নরমে-গরমে’ থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আর এতে আখেরে লাভ হবে ড্রাগন সরকারের।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ‘শুল্কযুদ্ধ’কে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন ও বেজিঙের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটাই খাদে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এর মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি হওয়ায় সেই লোকসান অচিরেই সামলে উঠেছে চিন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে ড্রাগনকে আন্তর্জাতিক ভাবে চাপে ফেলার মতো কোনও পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র করবে, এই ধারণা কষ্টকল্পিত। ফলে সে দিক থেকে অনেকটা ‘ব্যাকফুটে’ থাকছে ভারত।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশে ভারত-বিরোধী এবং চিনপন্থী সরকার রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের কথা বলা যেতে পারে। হিমালয়ের কোলের দেশটিতে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে রয়েছেন কেপি শর্মা ওলি। গত বছর দক্ষিণের দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন অনুরা কুমারা দিসানায়েক। আর ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শাসনব্যবস্থা চালাচ্ছেন নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূস। এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে বেজিঙের সম্পর্ক বেশ মধুর। তাই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছেন না ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
সার্কের গুরুত্ব হারানোর জন্য কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে দায়ী করে থাকেন। কারণ, ২০১৬ সালের পর থেকে সংশ্লিষ্ট জোটটিকে একরকম ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেয় নয়াদিল্লি। ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে শেষ বার সার্কভুক্ত দেশগুলির বৈঠকে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ২০২০ সালে কোভিড অতিমারি চলার সময়ে অবশ্য ভিডিয়ো কনফারেন্সে সংশ্লিষ্ট জোটের নেতৃবর্গের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি।
২০১৬ সালের নভেম্বরে সার্কের ১৯তম শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে ইসলামাবাদ। কিন্তু ওই বছর জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে ‘ফিদায়েঁ’ হামলা চালায় পাক মদতপুষ্ট জইশ-ই-মহম্মদ নামের জঙ্গিগোষ্ঠী। এর জেরে সংশ্লিষ্ট সম্মেলনে যোগ না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ভারতের ওই পদক্ষেপের পর পাকিস্তানে না-যাওয়ার কথা ঘোষণা করে দেয় আফগানিস্তান, ভুটান এবং বাংলাদেশ। ফলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল করতে বাধ্য হয় পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ।
১৯৮৫ সালে সাতটি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত হয় সার্ক। ভারত ছাড়াও তালিকায় ছিল পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং মলদ্বীপ। ২০০৭ সালের শেষ দিকে সংশ্লিষ্ট জোটে যোগ দেয় আফগানিস্তান। সার্কের সদস্যপদ পেতে একটা সময়ে অবশ্য মরিয়া ছিল চিন। কিন্তু, মূলত ভারতের বিরোধিতায় সেখানে ঢুকতে পারেনি বেজিং।
ভারত-বিরোধী চিন-পাকিস্তানের এই আঁতাঁত কতটা সফল হবে, তা নিয়ে অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, কুনমিঙের বৈঠক থেকে ফিরে এই নিয়ে বিবৃতি দেয় ঢাকা। সেখানে বলা হয়েছে, নতুন জোট গঠনের বিষয়ে কোনও কথা হয়নি। শুধুমাত্র সরকারি আধিকারিক স্তরে কিছু আলোচনা হয়েছে। বেজিং ও ইসলামাবাদের ব্লকে বাংলাদেশ যাচ্ছে না বলেও বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়েছে।
দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের দাবি, সংশ্লিষ্ট জোটটি তৈরি হলে ভবিষ্যতে তাতে যোগ দেবে আফগানিস্তান এবং ইরান। কিন্তু, কূটনীতিকেরা মনে করেন সেই সম্ভাবনা বেশ কম। কারণ, তালিবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কাবুলের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক একরকম তলানিতে চলে গিয়েছে। উল্টে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি চালাতে নয়াদিল্লিকে আরও বেশি করে কাছে পেতে চাইছে হিন্দুকুশের কোলের দেশ।
গত ১৩ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ইজ়রায়েলের সঙ্গে চলা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতকে আলাদা করে ধন্যবাদ দেয় তেহরান। পশ্চিম এশিয়ার এই সংঘাতে প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল ভারত। সাবেক পারস্য দেশে চাবাহার সমুদ্রবন্দর তৈরি থেকে শুরু করে একাধিক ক্ষেত্রে বিপুল লগ্নিও করেছে মোদী সরকার। এই পরিস্থিতিতে চিন-পাকিস্তানের জোটে যোগ দিয়ে নিজের অবস্থান খারাপ করবে না ইরান, মত বিশ্লেষকদের।
কিন্তু, তার পরেও নয়াদিল্লিতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক সেনাকর্তারা। ‘আগ্রাসী’ চিনকে মোকাবিলা করতে জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির সঙ্গে ভারতের সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁদের।
এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স এবং ভিয়েতনাম-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে গত কয়েক বছরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে ভারতের। সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রও বিক্রি করেছে নয়াদিল্লি। এই রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে মোদী সরকার নতুন জোট তৈরির দিকে নজর দিতেই পারে। এতে বেজিংকে পাল্টা চাপ দিতে সফল হবে সাউথ ব্লক, বলছেন কূটনীতিকেরা।
পাক গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন জোটে ভারতকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে কুনমিঙের বৈঠকে কোনও আলোচনা হয়নি। ফলে এতে যোগ দেওয়ার সুযোগ নয়াদিল্লির প্রায় নেই বললেই চলে। গত ২৬ জুন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন-এর (এসসিও) প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনের পার্শ্ববৈঠকে কিংডাওতে চিনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডং জ়ুনের সঙ্গে আলোচনা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সীমান্ত সমস্যার জটিল ক্ষেত্রগুলির সমাধানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি (রোডম্যাপ) তৈরির উপর জোর দেয় ভারত।
কিন্তু, ভারতের সঙ্গে সীমান্তবিরোধের স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ বলে জানিয়েছেন চিনা বিদেশমন্ত্রী মাও নিং। গত ৩০ জুন তিনি বলেন, ‘‘সীমান্ত নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনার জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত।’’ এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় বেজিঙের নতুন জোট তৈরির স্বপ্নকে মোদী সরকার কী ভাবে প্রতিহত করে, সেটাই এখন দেখার।