কখনও ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেট, কখনও আবার ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ মার্কিন পরমাণু চালিত ডুবোজাহাজ চিহ্নিতকরণের প্রযুক্তি। একের পর এক ভয়ঙ্কর সব ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ প্রকাশ্যে এনে সারা দুনিয়াকে চমকাচ্ছে চিন। সেই তালিকায় এ বার যুক্ত হল অত্যাধুনিক রাডার। এতে ‘হাইপারসনিক’ (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন) ক্ষেপণাস্ত্রও ধরা পড়বে বলে দাবি করেছে বেজিং।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দূরপাল্লার অত্যাধুনিক রাডারের ছবি প্রকাশ করে ড্রাগনভূমির সরকারি গণমাধ্যম। সেখানেই সংশ্লিষ্ট রাডারটি অন্তত হাজার মাইল দূরত্ব থেকে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিত করতে পারবে বলে দাবি করা হয়। এই খবর সম্প্রচারিত হতেই বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে হইচই। বিষয়টিকে মোটেই হালকা ভাবে নিতে নারাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বেজিঙের ওই রাডার চিন্তা বাড়িয়েছে নয়াদিল্লিরও।
সম্প্রতি চন্দ্র নববর্ষে চিনা লালফৌজ ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর উদ্দেশে ভাষণ দেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট তথা চেয়ারম্যান শি জিনপিং। অনুষ্ঠানে বাহিনীর থেকে সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানেও প্রকাশ্যে এসেছিল দূরপাল্লার অত্যাধুনিক ওই রাডারটি। এর সাহায্যে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে শত্রুর হাতিয়ারের উপর শি-র সেনা নজর রাখতে পারবে বলেও জানা গিয়েছে।
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে একটি ভিডিয়ো প্রেসিডেন্ট জিনপিঙের কার্যালয়ে পাঠায় পিএলএ। ওই ভিডিয়োয় ছিল অত্যাধুনিক একটি রাডার স্টেশনের পুঙ্খানুপুঙ্খ কার্যপ্রণালী। শত্রুর ছোড়া দূরপাল্লার হাতিয়ারগুলিকে চিহ্নিত করা এবং সেগুলিকে নিয়ে সতর্কবার্তা দিতে স্থলভিত্তিক ওই রাডার স্টেশনটি তৈরি করেছে ড্রাগন ফৌজ, খবর সূত্রের।
প্রেসিডেন্ট শি-র দফতরে পাঠানো ভিডিয়োয় পিএলএর স্থল, নৌ, বায়ু এবং মহাকাশ বাহিনীর অফিসার এবং অন্য সৈনিকদের দেখতে পাওয়া গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে চিনা লালফৌজের সব ক’টি শাখাই সংশ্লিষ্ট রাডারটি ব্যবহার করতে পারে বলে অনুমান গোয়েন্দাদের। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে একটি শব্দও খরচ করেনি ড্রাগন সরকার।
চিনের এই অত্যাধুনিক রাডার ব্যবস্থাটি কী ভাবে কাজ করে, তা জানতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। এর আনুমানিক উচ্চতা ছ’তলা বাড়ির সমান বলে মনে করা হচ্ছে। রাডারটির গায়ে রয়েছে অসংখ্য অ্যান্টেনা। এ ছাড়া অষ্টাভুজাকার একটি অ্যারের উপস্থিতির কথা জানা গিয়েছে।
ড্রাগনভূমির জ়িয়ামুসি প্রদেশে অত্যাধুনিক রাডার স্টেশনটিকে স্থাপন করেছে পিএলএ। লালফৌজের এই ‘কবচ’টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন বাহিনীর সাবেক প্রশিক্ষক ঝংপিং। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘অত্যাধুনিক রাডারটি হাতে পাওয়ায় কৌশলগত দিক থেকে বাহিনীর শক্তি অনেকটাই বৃদ্ধি পেল। এর সাহায্যে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের ক্ষেপণাস্ত্রকে অনায়াসেই চিহ্নিত করা যাবে।’’
আধুনিক যুদ্ধে ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নেওয়ার ক্ষমতা হয়েছে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রের। অত্যধিক গতির কারণে এই মারণাস্ত্রগুলির চিহ্নিতকরণ প্রায় অসম্ভব। পিএলএর সাবের প্রশিক্ষক ঝংপিঙের দাবি, অত্যাধুনিক রাডারটি ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে চিহ্নিত করতে পারবে। ফলে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ব্যবহার করে সেগুলিকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করা অনেকটাই সহজ হবে লালফৌজের কাছে। বর্তমানে দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার দিকে নজর দিয়েছেন ড্রাগনের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের দফতরে পাঠানো ভিডিয়োয় বিশাল রাডারটির সামনে দাঁড়িয়ে পিএলএ মহাকাশ বাহিনীর এক অফিসারকে ভাষণ দিতেও দেখা গিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘‘এই রাডারের সাহায্যে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি কঠোর ভাবে পর্যবেক্ষণ করব। আমাদের দিকে আসা হুমকিগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে। এর পর সেই মতো প্রতিক্রিয়া জানাবে বাহিনী।’’
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে এই রাডার স্টেশনটি তৈরি করে পিএলএ। কিন্তু ২০২১ সালে এর পরিকাঠামোকে আরও উন্নত করে ড্রাগনসেনা। গত বছর এই রাডারটি নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে মার্কিন বায়ুসেনার উপর গবেষণা চালানো ‘চায়না অ্যারোস্পেস স্টাডিজ় ইনস্টিটিউট’ (সিএএসআই)। সেখানে বলা হয়েছিল, রাডারটির সাহায্যে মহাকাশেও নজরদারি চালায় পিএলএ।
স্থলভাগের পাশাপাশি বিশ্বের প্রথম সমুদ্রতল রাডার নির্মাণের দাবিও করেছে চিন। সাগরের নীচে প্রায় হাজার মিটার গভীরতা থেকে লড়াকু জেট শনাক্ত করার ক্ষমতা রয়েছে সেটির। দক্ষিণ চিন সাগরে ওই রাডার মোতায়েন করেছে ড্রাগন ফৌজ।
রাডারের পাশাপাশি নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) প্রায় তৈরি করে ফেলেছেন চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। মূলত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর কথা মাথায় রেখে সেটিকে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ সেটিকে আমেরিকার ‘টার্মিনাল হাই অল্টিচুড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাডের নকল বলে উল্লেখ করেছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে ঝুহাই এয়ারশোতে নতুন বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটিকে প্রথম বার প্রকাশ্যে আনে পিএলএ। এর পোশাকি নাম ‘এইচকিউ-১৯’ রেখেছে ড্রাগনসেনা। ২০০ কিলোমিটার পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের। এ ছাড়া রাশিয়ার তৈরি ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে চিনা লালফৌজ।
অন্য দিকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে দেশের আকাশকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলতে ফের এক বার ‘চিরকালীন বন্ধু’ রাশিয়ার শরণাপন্ন হয়েছে ভারত। মস্কোর থেকে দূরপাল্লার (লং রেঞ্জ) ‘ভোরোনেজ়’ রাডার ব্যবস্থা পেতে চূড়ান্ত পর্যায়ের কথাবার্তা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত মিললে ৪০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর তিন দিনের রুশ সফরে যান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। মস্কোয় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। দু’জনের মধ্যে লম্বা সময় ধরে চলে বৈঠক। তার পরই ‘ভোরোনেজ়’ রাডার ব্যবস্থা কেনার ব্যাপারে নয়াদিল্লির আগ্রহের কথা প্রকাশ্যে আসে। এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে বলেও সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
দূরপাল্লার এই রাডার ব্যবস্থার নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘আলমাজ়-অ্যান্টে কর্পোরেশন’। ভোরোনেজ় সিরিজের একাধিক রাডার দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে পুতিন ফৌজ। এর নজর এড়িয়ে আকাশপথে আক্রমণ শানানো যে একরকম অসম্ভব, তা একবাক্যে মানেন দুনিয়ার দুঁদে জেনারেলরা।
রুশ সংবাদ সংস্থাগুলির দাবি, ‘ভোরোনেজ়’ রাডারের পাল্লা আনুমানিক আট হাজার কিলোমিটার। একসঙ্গে ৫০০-র বেশি বস্তুকে শনাক্ত করতে পারে অত্যাধুনিক এই রাডার। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘স্টেলথ’ যুদ্ধবিমানের চিহ্নিতকরণ। বিশ্বের অধিকাংশ রাডারই এই কাজ করতে ব্যর্থ।
২০১২ সাল থেকে ‘ভোরোনেজ়’ রাডার ব্যবস্থা ব্যবহার করা শুরু করে রুশ সেনা। ওই বছর থেকে ধীরে ধীরে সোভিয়েত আমলের সমস্ত রাডার বাতিল করে মস্কো। এই রাডার ব্যবস্থার কোন সংস্করণের জন্য ভারত আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি।
এই রাডার ব্যবস্থার ক্ষমতা নিয়ে মুখ খুলেছেন রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক ইন্ডিয়া’র সামরিক-রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান আলেকজ়ান্ডার মিখাইলভ। তাঁর কথায়, বর্তমানে এটিকে নতুন উপাদানের সঙ্গে আরও উন্নত করা হচ্ছে। আগামী দিনে মিটার থেকে সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিভিন্ন কম্পাঙ্কের ব্যান্ড জুড়ে এটি কাজ করতে পারবে।
মিখাইলভ দাবি করেছেন, ভূপৃষ্ঠের কিছুটা উপরে তো বটেই, পৃথিবীর নিকটবর্তী মহাশূন্যের পরিবেশের উপর নজর রাখতে সক্ষম এই ‘ভোরোনেজ়’ রাডার। ফলে সেখান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে এটি তা চিহ্নিত করতে পারবে। অতি ক্ষুদ্র ড্রোনের উপরে নজরদারিতেও এর জুড়ি মেলা ভার।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা ‘দ্য সানডে গার্ডিয়ান’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বরে ভারতে আসেন ভোরোনেজ় রাডার ব্যবস্থার নির্মাণকারী রুশ সংস্থার ডেপুটি চেয়ারম্যান ভ্লাদিমির মেদোভনিকভ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সংস্থার আরও ন’জন পদস্থ কর্তা। রাডার ব্যবস্থাটি নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে অফসেট অংশীদারি কারা পাবেন, তা নিয়ে আলোচনা সেরেছেন তাঁরা।
সূত্রের খবর, এই রাডার ব্যবস্থাকেও দেশের মাটিতে নির্মাণের উপর জোর দিচ্ছে কেন্দ্র। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে গোটা ব্যবস্থাটির ৬০ শতাংশ এ দেশের প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলিকে দিয়ে তৈরি করতে হবে বলে শর্ত রেখেছে কেন্দ্র। আর তাই ‘আলমাজ়-অ্যান্টে কর্পোরেশন’-এর পদস্থ কর্তারা দিল্লি ও বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন এলাকায় সফর করেছেন বলে জানা গিয়েছে।