এ যেন মাছের তেলেই মাছ ভাজা! ভারতীয়দেরই ব্যবহার করে এ দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরাচ্ছে একদল প্রতারক। ভিন্রাষ্ট্রে বসে কম্পিউটার-ল্যাপটপের বোতামে আঙুল ছুঁইয়েই গোটা প্রক্রিয়া সেরে ফেলছে তারা। শুধু তা-ই নয়, ডিজিটাল প্রতারণাকে সামনে রেখে দিব্যি চলছে মানবপাচার! তাঁদের জালে আটকে পড়া ভারতীয়দের যন্ত্রের মতো করতে হচ্ছে দাসবৃত্তি। বিষয়টি নজরে আসায় টনক নড়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের।
পুলিশি ভাষায় এ-হেন অপরাধের নাম ‘সাইবার ক্রাইম’। মাকড়সার মতো এর জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশ। সম্প্রতি এই সংক্রান্ত একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীন ‘ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কোঅর্ডিনেশন সেন্টার’ বা আইফোরসি। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) অনলাইন জালিয়াতির কারণে লোকসান হয়েছে সাত হাজার কোটি টাকা।
আইফোরসির ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ডিজিটাল মাধ্যমে চুরি যাওয়া টাকার সিংহভাগ চলে গিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশে। সেগুলি হল মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস এবং তাইল্যান্ড। ভারতের ভিতরে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে ওই সমস্ত দেশের সাইবার অপরাধীরা। পাশাপাশি, এ দেশের বহু মানুষকেও ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের ডেরায় টেনে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগাচ্ছে তারা।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের দাবি, গোটা বিষয়টির নেপথ্যে হাত রয়েছে চিনের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে আছে মান্দারিনভাষী সাইবার অপরাধীদের গ্যাং। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাকরির টোপ দিয়ে অনলাইনে ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা। মোটা বেতনের লোভে তাদের জালে আটকা পড়েন অনেকেই। ফলে তাঁদের নিজেদের গোপন ডেরায় ডেকে নিতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না এই সমস্ত সাইবার গ্যাংয়ের।
গোয়েন্দাদের অনুমান, এ ভাবেই ভারত থেকে চাকরির টোপ দিয়ে হচ্ছে মানবপাচার। এদের কেউ কেউ সরাসরি পৌঁছোচ্ছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে। কেউ আবার চিন ঘুরে চলে যাচ্ছেন সেখানে। পরে ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে এ দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করতে পাচার হওয়া ভারতীয়দেরই কাজ লাগাচ্ছে ভিন্দেশের সাইবার অপরাধীরা। জোর করে মাদকের নেশা ধরিয়ে এই কাজে বাধ্য করা হচ্ছে তাঁদের।
আইফোরসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ধরনের অপরাধের জন্য প্রতি মাসে ভারত থেকে গায়েব হচ্ছে কম-বেশি হাজার কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা ব্যবহার করলে বছরে ১২ কোটি স্কুলপড়ুয়াকে ‘মিড ডে’ মিল খাওয়াতে পারত সরকার। মাসভিত্তিক হিসাবে দেখা যাবে, জানুয়ারিতে ১,১৯২ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ৯৫১ কোটি, মার্চে হাজার কোটি, এপ্রিলে ৭৩১ কোটি এবং মে মাসে ৯৯৯ কোটি টাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশে পাচার হয়ে গিয়েছে।
সাইবার অপরাধের এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহে বড় ভূমিকা রয়েছে আইফোরসির অন্তর্গত ‘সিটিজেন ফিন্যানসিয়্যাল সাইবার ফ্রড রিপোর্টিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বা সিএফসিএফআরএমএস-এর। দেশ জুড়ে এই ডিজিটাল অপরাধ জাঁকিয়ে বসার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঢিলেঢালা সাইবার আইনকে দায়ী করেছেন গোয়েন্দারা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সেখানকার দেশগুলিতে ‘কল সেন্টার’-এর মতো অফিস খুলতে তেমন কোনও সরকারি অনুমতি লাগে না।
আর তাই সেগুলিকে সামনে রেখে দিব্যি মানবপাচার এবং আর্থিক জালিয়াতির ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছে মান্দারিনভাষী গ্যাং। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ভাবে জুয়া এবং মাদকপাচারের জন্য ওই এলাকার দেশগুলির দুনিয়া জুড়ে কুখ্যাতি রয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দারা ইতিমধ্যেই চিনা সাইবার অপরাধচক্রের কম্বোডিয়ায় ৪৫টি, লাওসে পাঁচটি এবং মায়ানমারে একটি গোপন ঘাঁটির হদিস পেয়েছেন।
আইফোরসির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারত থেকে পাচার হওয়া বাসিন্দারা তাঁদের গোপন আস্তানায় পৌঁছোলেই পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে ডিজিটালি টাকা চুরির প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে চিনা সাইবার গ্যাং। প্রতিবাদ করলেই মারধর করে ভয় দেখানো হয় তাঁদের। এর পর তাঁদের দিয়ে মূলত তিনটি পদ্ধতিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে টাকা গায়েব করতে থাকে ওই চক্র। তার মধ্যে রয়েছে নকল স্টকের লেনদেন, ডিজিটাল গ্রেফতারি এবং চাকরির টোপ।
গত কয়েক বছরে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমজনতার মধ্যে বাড়ছে শেয়ারে লগ্নির প্রবণতা। তদন্তকারীদের দাবি, এটাকেই কাজে লাগাতে শুরু করেছে বিদেশে বসে থাকা সাইবার অপরাধচক্র। বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে বিনিয়োগ টানছে তারা। সুনির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা হয়ে গেলে চোখের নিমেষে সেটা গায়েব করছে ওই সমস্ত গ্যাং। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্টক লেনদেনের ভুয়ো অ্যাপে চলে এই জালিয়াতি। টাকা সরানো হয়ে গেলে যেগুলির আর কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হল ডিজিটাল গ্রেফতারি। এতে সাধারণত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই), সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি), সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই), শুল্ক দফতর, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা আইএএস-আইপিএসের মতো পদাধিকারিদের নাম করে ফোনে বা ইমেলে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে সাইবার অপরাধীরা। এর পর নানা অছিলায় কথার জালে জড়িয়ে ব্যক্তিগত তথ্য জেনে নিয়ে ব্যাঙ্ক ফাঁকা করে দেয় তারা।
অনেক সময়ে আবার উঁচু সরকারি পদাধিকারীদের নাম করে ব্ল্যাকমেলও করে থাকে ডিজিটাল গ্রেফতারির সঙ্গে যুক্ত সাইবার অপরাধীরা। ভয় পেয়ে তাদের কথামতো বার বার টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হতেও দেখা গিয়েছে দেশের বহু সাধারণ নাগরিককে। তদন্তকারীদের দাবি, এই কাজে বিদেশি সাইবার গ্যাংগুলি পাচার হওয়া ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে। এতে ভাষাগত সমস্যা মেটাতে পেরেছে তারা। ফলে বিশ্বাস অর্জন করতে সুবিধা হচ্ছে তাদের।
এ ছাড়া ঘরে বসে কাজের টোপ দিয়ে প্রতারণা করে থাকে এই সমস্ত গ্যাং। মাসে ৫০০ থেকে ৫,০০০ টাকা রোজগারের টোপ দিয়ে বহু তরুণ-তরুণীকে ‘সিকিউরিটি মানি’ জমা করতে বলে তারা। প্রথম দু’-তিন মাস ঠিকমতো বেতন দিয়ে তাঁদের সামনে রাখা হয় অতিরিক্ত কাজ এবং আরও বেশি টাকার লোভ। সেটা পেতে মোটা অঙ্কের ‘সিকিউরিটি মানি’ জমা করেন বেকার যুবক-যুবতীদের একাংশ। টাকা অ্যাকাউন্টে চলে গেলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ওই গ্যাংয়ের সদস্যেরা।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, কাজের টোপ দিয়ে ভারত থেকে মানবপাচারের জন্য এ দেশের ভিতরেই বেশ কিছু এজেন্টকে নিয়োগ করে রেখেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই সমস্ত চিনা সাইবার গ্যাং। প্রতিটা পাচারের জন্য এক থেকে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে তারা। এ ছাড়া ভুয়ো চাকরির পোর্টাল খোলা এবং বিদেশযাত্রার প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করতে আরও কিছু টাকা তাঁদের হাতে প্রায়ই তুলে দেয় ড্রাগনের কুচক্রীরা।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা মহারাষ্ট্রে ৫৯ জন, তামিলনাড়ুতে ৫১ জন, জম্মু-কাশ্মীরে ৪৬ জন, উত্তরপ্রদেশে ৪১ জন এবং দিল্লিতে ৩৮ জন এই ধরনের এজেন্টের খোঁজ পেয়েছেন। তাদের সবাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের থেকে ভুয়ো সিমকার্ড-সহ উদ্ধার হয় একাধিক সরঞ্জাম। আর্থিক লেনদেনের জন্য তাঁরা ‘ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস’ বা ইউপিআই ব্যবহার করেছেন বলে জানা গিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন আইফোরসির এক পদস্থ কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘ভারত ছাড়াও আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার বহু জালিয়াত এই সমস্ত চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাদের কয়েক জনকে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। তবে সেটা হিমশৈলের চূড়ামাত্র।’’
ভারত থেকে মানবপাচার এবং সাইবার জালিয়াতি ঠেকাতে ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কেন্দ্র। সম্প্রতি, এ ব্যাপারে আলোচনা করতে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলকে নয়াদিল্লিতে পাঠায় কম্বোডিয়ার সরকার। বিদেশমন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির সঙ্গে বৈঠক করে তারা। সাইবার গ্যাংগুলির কোমর ভাঙতে তাদের গোপন ঠিকানার হদিস চেয়েছে নাম পেন।
এই অপরাধচক্রের জাল ছিঁড়তে সাবেক পুলিশকর্তারা অবশ্য একাধিক দফতরকে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই তালিকায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র এবং বিদেশ মন্ত্রকের পাশাপাশি রয়েছে ইডি, সিবিআই এবং এনআইএ-র মতো তদন্তকারী সংস্থা। পাশাপাশি, দেশ জুড়ে সাইবার অপরাধ নিয়ে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। এর শিক্ষা স্কুলস্তর থেকে দেওয়া উচিত বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।