Indo-China Conflict in Indian Ocean

ওত পেতে অতর্কিতে ড্রাগন-ডুবোজাহাজের আক্রমণ? ভারত মহাসাগর থেকে ভারতকেই উৎখাতের প্যাঁচ কষছে চিনা নৌবাহিনী

নয়াদিল্লির হাত থেকে ভারত মহাসাগরকে ছিনিয়ে নিতে গুপ্তচরবৃত্তিতে নেমেছে একাধিক চিনা জাহাজ। সমুদ্রতলের মানচিত্র আঁকতে তাদের ময়দানে নামিয়েছে বেজিং। সেই ছবি তৈরি হয়ে গেলে নতুন রাস্তায় লুকিয়ে আক্রমণ শানাবে ড্রাগনের ডুবোজাহাজ? উঠছে প্রশ্ন।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৫ ১৮:০০
Share:
০১ ২০

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের আবহে চিন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চলতি বছরের ৩১ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চলা দু’দিন ব্যাপী ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দেবেন তিনি। কিন্তু ঠিক তার আগে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ফের ধরা পড়ল বেজ়িঙের আর এক ‘চালবাজি’, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এ দেশের নৌবাহিনী।

০২ ২০

‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি বঙ্গোপসাগরে ঢোকে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনীর গুপ্তচর জাহাজ ‘জিয়াং ইয়াং হং ০৩’। ভারতের ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ইইজ়েডের (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন) গা ঘেঁষে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় তাকে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ইইজ়েড হল এ দেশের সামুদ্রিক জলসীমা। সেখানকার যাবতীয় সম্পদের উপরে নয়াদিল্লির রয়েছে নিরঙ্কুশ অধিকার।

Advertisement
০৩ ২০

তবে এ বারই প্রথম নয়। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, গত কয়েক বছর ধরেই ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি বাড়াচ্ছে চিন। এর নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন তাঁরা। প্রথমত, নয়াদিল্লির নৌবাহিনীকে উৎখাত করে ওই এলাকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রাখতে চায় বেজ়িং। কারণ, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় সর্বাধিক আধিপত্য রয়েছে এ দেশের নৌবাহিনীর। ড্রাগনের জন্য সেটা হারালে দেশের নিরাপত্তা যে প্রশ্নের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।

০৪ ২০

চিন অবশ্য ভারতের অভিযোগ মানতে নারাজ। বেজিঙের বক্তব্য, ‘জিয়াং ইয়াং হং ০৩’-এর মতো জাহাজগুলি মোটেই গুপ্তচর জাহাজ নয়। মূলত পরিবেশ ও জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণার জন্যেই এগুলিকে ব্যবহার করছে তারা। অন্য দিকে, সাবেক সেনাকর্তাদের দাবি, সমুদ্রতলের মানচিত্র আঁকতে সংশ্লিষ্ট জলযানগুলিকে ব্যবহার করছে পিএলএ নৌবাহিনী। এক বার সেই ছবি তৈরি হয়ে গেলে ভারত মহাসাগরীয় এলাকার বিভিন্ন জায়গা নিজেদের বলে দাবি করতে পারে ড্রাগন সরকার।

০৫ ২০

সমুদ্রবিজ্ঞানী পূজা ভট্টের দাবি, সাগরতলের মানচিত্র আঁকার বেশ কিছু বিশেষ সামরিক সুবিধা রয়েছে। এক বার সেটা তৈরি হয়ে গেলে ডুবোজাহাজের নতুন রাস্তা খুঁজে পেতে পারে পিএলএ নৌবাহিনী। ফলে লুকিয়ে আক্রমণ শানানোর ক্ষেত্রে সুবিধাজনক জায়গায় থাকতে পারবে তারা। পাশাপাশি ‘ডুবো ড্রোন’-এ হামলা চালানোও সহজ হবে। ফলে লড়াইয়ের সময় আন্দামান-নিকোবর, লক্ষদ্বীপ এবং পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের নৌঘাঁটিগুলিতে বড় আঘাত নেমে আসতে পারে।

০৬ ২০

বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় বার বার গুপ্তচর জাহাজ পাঠিয়ে ম্যাঙ্গানিজ়, নিকেল, তামা ও কোবাল্টের মতো পলিমেটালিক ধাতুর খোঁজ চালাচ্ছে চিন। ছলে-বলে-কৌশলে ওই সম্পদ হস্তগত করার পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের। এ ছাড়া সেখানে খনিজ তেলের বিপুল ভান্ডারের মিলতে পারে হদিস। সে দিকেও নজর রয়েছে ড্রাগনভূমির সরকার ও সেনার।

০৭ ২০

সমুদ্রবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভারত মহাসাগরে গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে চিনের মাছ ব্যবসাও ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আরও বেশি মাছের প্রয়োজন রয়েছে বেজিঙের। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভারত মহাসাগরে মাছ শিকার বাড়াতে পারলে সেটা অনায়াসে পূরণ করতে পারবেন মান্দারিনভাষীরা। এই সমুদ্রে মজুত থাকা মাছের পরিমাণ আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের তুলনায় বেশি বলে মনে করেন এক শ্রেণির গবেষক।

০৮ ২০

পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, বিশ্বের ৯৯ শতাংশের বেশি টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যবহনকারী জলের নীচের কেব্‌ল জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায়। সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরি করতে পারলে সেগুলিকে অনায়াসেই ধ্বংস করতে পারবে চিন। সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যাহত হতে পারে ভারতের টেলিযোগাযোগ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা। যুদ্ধের সময়ে সেটা নয়াদিল্লিকে বড় ঝুঁকির মুখে ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

০৯ ২০

কয়েক বছর আগে এই ইস্যুতে চিনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ আনে এস্তোনিয়া। এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) অংশ থাকা পূর্ব ইউরোপের দেশটি হঠাৎই দাবি করে বসে যে গুপ্তচর জাহাজ ব্যবহার করে তাদের সমুদ্রের নীচের টেলিযোগাযোগ কেটে দিয়েছে পিএলএ নৌবাহিনী। যদিও পত্রপাঠ সেই অভিযোগ খারিজ করে দেয় বেজিং। তার পরেও সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়েছে এমনটা নয়।

১০ ২০

এ দেশের প্রাক্তন কমান্ডারেরা অবশ্য মনে করেন, ভারত মহাসাগরীয় এলাকা দখল করার দ্বিমুখী উদ্দেশ্য রয়েছে চিনের। প্রথমত, এতে সাফল্য পেলে বিরাট একটা সমুদ্রের উপর একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে বেজিঙের। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে শুরু করে খনিজ সম্পদ উত্তোলন— কোনও কিছুতেই তাকে আটকানোর কেউ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, এশিয়ায় একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলতে পারবে ড্রাগন।

১১ ২০

অন্য দিকে, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রভাব কমলে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর নেতা হওয়ার স্বপ্ন ছাড়তে হবে নয়াদিল্লিকে। ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপরেও পড়বে মারাত্মক প্রভাব। কঠিন হবে আরব সাগর এবং হরমুজ় প্রণালীর দিক থেকে মালবাহী জাহাজের খনিজ তেলের পরিবহণ। এমনকি বঙ্গোপসাগরেও একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে ভারতীয় নৌসেনাকে।

১২ ২০

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অধিকাংশই মনে করেন, হয় লাদাখ-সিকিম-অরুণাচল প্রদেশ, নয়তো ভারত মহাসাগরীয় এলাকা— যে কোনও একটিকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে মুখোমুখি সংঘাতে জড়াবে ভারত ও চিন। দু’পক্ষ ইতিমধ্যেই সেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। বেজিঙের মোকাবিলায় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি। সেগুলির পরীক্ষা মূলত হয় বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায়। গুপ্তচর জাহাজ পাঠিয়ে আগাম সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রের ক্ষমতা বুঝে নেওয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছে পিএলএ নৌসেনা।

১৩ ২০

২০২২ সালের নভেম্বরে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য বঙ্গোপসাগরে ‘নোটিস টু এয়ার মিশন্স’ বা নোটাম জারি করে কেন্দ্র। ফলে ‘নো ফ্লাই জ়োন’ হিসাবে ঘোষিত হয় ওই এলাকা। এর পরই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মুখে সেখানে ঘোরাঘুরি শুরু করে ‘ইউয়ান ওয়াং ৫’ এবং ‘ইউয়ান ওয়াং ৬’ নামের দু’টি চিনা গুপ্তচর জাহাজ। ফলে বাধ্য হয়ে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছিল ভারত।

১৪ ২০

এ ছাড়া সামুদ্রিক রাস্তায় ভারতকে ঘিরতে ‘মুক্তোর সুতো’ (স্ট্রিং অফ পার্লস) নামের একটি নীতি অনুসরণ করছে বেজিং। এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় বিভিন্ন দেশে একাধিক নৌঘাঁটি তৈরি করেছে চিন। এর মধ্যে অন্যতম হল শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা, পাকিস্তানের গ্বদর এবং জ়িবুতির সামরিক ঘাঁটি। এ ছাড়া মলদ্বীপকেও ভারতের বিরুদ্ধে নানা ভাবে ব্যবহার করে থাকে পিএলএ নৌবাহিনী।

১৫ ২০

বিশ্লেষকদের দাবি, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ‘দাদাগিরি’র ক্ষেত্রে চিনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল জাহাজের সংখ্যা। বেজিঙের হাতে ৬৪টি গুপ্তচর জলযান রয়েছে। সমুদ্রতলের মানচিত্র আঁকার জন্য সেগুলিকে ব্যবহার করছে তারা। অন্য দিকে, ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে ওই ধরনের গুপ্তচর জাহাজ রয়েছে মেরেকেটে ১৪টি, যার মধ্যে অন্যতম হল ‘আইএনএস সন্ধ্যায়ক’। জলবিদ্যুৎ জরিপের কাজে গত বছর থেকে এই জলযানটিকে কাজে লাগাচ্ছে নৌসেনা। তবে অন্য একটি দিক থেকে কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে নয়াদিল্লি।

১৬ ২০

ভারত মহাসাগরীয় এলাকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে একটি ‘মেরিটাইম ফিউশন সেন্টার’ তৈরি করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। এর সদর দফতর রয়েছে গুরুগ্রামে। এর মাধ্যমে প্রতিবেশী একাধিক দেশকে সামুদ্রিক জরিপের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া মুম্বই, কোচি এবং পোর্টব্লেয়ারে রয়েছে ‘ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল সার্ভেলেন্স সিস্টেম’। এই ধরনের কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে মরিশাস, মলদ্বীপ, সেশলস এবং শ্রীলঙ্কা সংলগ্ন সমুদ্রে চিনা গুপ্তচর জাহাজ এবং রণতরীর উপর নজর রাখতে পারছে এ দেশের নৌসেনা। এতে রয়েছে ৪৬টির বেশি রেডার।

১৭ ২০

২০২৪ সালের জুনে ভারত মহাসাগরীয় এলাকার দেশগুলির অন্তত ৮০০ জন সমুদ্র বিশেষজ্ঞকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় নয়াদিল্লি। নৌবাহিনীর উদ্যোগে সেটা গোয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত কয়েক বছরে চিনা নৌসেনার ‘দৌরাত্ম্যে’ ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার অধিকাংশ দেশই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ফলে তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে বেজিঙের বিরুদ্ধে তাদের প্রায় প্রত্যেককেই পাশে পাচ্ছে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে এই এলাকা নিয়ে যুদ্ধ বাধলে তা একাই লড়তে হবে ড্রাগনকে।

১৮ ২০

চিনের ‘মুক্তোর সুতো’ ষড়যন্ত্রের কথা টের পেয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই ভারত। পাল্টা ‘হিরের হারে’ বেজিঙের গলা পেঁচিয়ে ধরার নীলনকশা ছকে ফেলেছে নয়াদিল্লি। কেন্দ্রের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে প্রথমেই বলতে হবে ইরানের চাবাহার বন্দরের কথা। গ্বদর থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ১৭০ কিলোমিটার। সাবেক পারস্য দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ওই সামুদ্রিক বন্দরটি তৈরি করেছে ভারত।

১৯ ২০

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের বড় অংশই চাবাহারকে নয়াদিল্লির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ ওই সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে ভারত। দ্বিতীয়ত, চাবাহারের মাধ্যমে গ্বদরে চিনের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখার সুযোগ পাচ্ছে এ দেশের নৌবাহিনী।

২০ ২০

চাবাহারের পাশাপাশি ওমান, ইন্দোনেশিয়া, সেশলস, মরিশাস এবং ভিয়েতনামে ধীরে ধীরে নৌঘাঁটি তৈরি করছে ভারত। ফলে মলাক্কা প্রণালী-সহ চিনের সমস্ত সামুদ্রিক রাস্তা প্রয়োজনে বন্ধ করতে পারবে নয়াদিল্লি। যুদ্ধের সময়ে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে রাতারাতি ভেঙে পড়তে পারে বেজিঙের অর্থনীতি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement