কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) এ বার আমেরিকা বনাম চিন? যুক্তরষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রযুক্তির ক্ষেত্রে থাবা বসাচ্ছে বেজিং? ড্রাগনভূমি নতুন ‘ওপেন সোর্স রিজ়নিং মডেল’ বাজারে নিয়ে আসায় উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন। শুধু তা-ই নয়, এর জন্য ওয়াশিংটনের যাবতীয় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলিতে ভবিষ্যতে লালবাতি জ্বলতে পারে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষকদের একাংশ।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ২০ জানুয়ারি নতুন ‘ওপেন সোর্স রিজ়নিং মডেল’ চালু করে চিনা স্টার্ট আপ সংস্থা ডিপসিক। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি। এর নাম ‘ডিপসিক-আর১’ রেখেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। সূত্রের খবর, এআই প্রযুক্তিটি তৈরি করতে সমাজমাধ্যম ‘টিকটক’-এর মূল সংস্থা বাইটডান্সের সাহায্য নিয়েছে এই চিনা স্টার্ট আপ।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রথমেই আসবে আমেরিকার নাম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় রাজত্ব চালানো ওপেনএআই, গুগ্ল, মেটা বা অ্যাথ্রোপিকের মতো বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির জন্মদাতাও যুক্তরাষ্ট্র। ‘ডিপসিক-আর১’ সেখানে চিড় ধরাতে পারবে বলে মনে করার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
প্রযুক্তিবিদেরা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বহুল ব্যবহৃত ওপেনএআইয়ের কৃত্রিম মেধা ‘চ্যাটজিপিটি’র কথা বলেছেন। তাঁদের দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিটি তৈরি করতে আমেরিকার টেক জায়ান্ট সংস্থাটির যত খরচ হয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম টাকায় ‘ডিপসিক-আর১’ বানিয়েছে চিনা স্টার্ট আপ। আর তাই এআইয়ের প্রতিযোগিতার বাজারে এটি অচিরেই ওয়াশিংটনকে পিছনে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এত দিন পর্যন্ত চিনা কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি সংস্থাগুলি অত্যাধুনিক হার্ডঅয়্যারের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রথম বার সফ্টঅয়্যার নিয়ে কাজ করছে ডিপসিক। আর সেটাই ওয়াশিংটনের সিলকন ভ্যালির কর্তাব্যক্তিদের যথেষ্ট অবাক করেছে। ‘ডিপসিক-আর১’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা মিলবে বলেও মনে করছেন তাঁরা। ফলে চিনা স্টার্ট আপটির এআই ঘিরে যে আগ্রহ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
ইতিমধ্যেই চিনা স্টার্ট আপ সংস্থাটি এআইয়ের বাজার ধরতে বেশ কিছু লোভনীয় অফার ঘোষণা করেছে। ‘ডিপসিক-আর১’-এর প্রতি ১০ লক্ষ টোকেনের জন্য ২.২ ডলার নেবে তারা। ভারতীয় মুদ্রায় খরচ হবে মাত্র ১৯০ টাকা। এ ব্যাপারে আরও আগ্রাসী ভাবে প্রচার চালাচ্ছে ‘টিকটক’ প্রস্তুতকারী সংস্থা বাইটডান্স।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগামী দিনে বিশ্বের দুই মহাশক্তিধরের মধ্যে ‘কৃত্রিম মেধার যুদ্ধ’ বেধে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে প্রথম ধাপে এগিয়ে গেল চিন। উন্নত এআই প্রযুক্তি তৈরির জন্য প্রতি বছর কয়েক কোটি ডলার খরচ করে আমেরিকা। সেখান থেকে সরে এসে কম খরচে কত দ্রুত নতুন প্রযুক্তি সেখানকার তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি নিয়ে আসতে পারে, সেটাই এখন দেখার।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমানে চিনকে অতি উন্নত এনভিডিয়া এআই চিপ রফতানি করা বন্ধ রেখেছে আমেরিকা। কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তিকে বিকশিত করতে এই ধরনের চিপগুলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিপসিকের সাফল্যে এটা প্রমাণিত যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ড্রাগনের উপর সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং ওয়াশিংটনকেই খোলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সক্ষম হয়েছে বেজিং।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার জেরে পশ্চিমের টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার বাজারে নামতে চিনা প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছিল। এখান থেকে নিজেদের বার করে আনতে ডাউনস্ট্রিম অ্যাপ্লিকেশনের দিকে ঝুঁকেছে বেজিং। আর তাতেই বড় সাফল্য এসেছে বলে জানিয়েছে তারা।
নতুন এআই প্রযুক্তি বাজারে এনে রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়া ডিপসিকের বাজেটেও রয়েছে চমক। এর আগে ‘ডিপসিক-ভি৩’ নামের একটি কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরি করতে মাত্র ৫৬ লক্ষ ডলার খরচ করেছে ওই চিনা স্টার্ট আপ। অন্য দিকে স্যাম অল্টম্যানের নেতৃত্বাধীন ওপেনএআই তাদের ‘জিপিটি-৪’ মডেলের জন্য এখনও পর্যন্ত ব্যয় করেছে প্রায় ১০ কোটি ডলার।
‘ডিপসিক-ভি৩’ কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরি করতে জিপিইউ ব্যবহার করতে হয়েছে চিনা স্টার্ট সংস্থাটিকে। আমেরিকায় এটি সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি হিসাবে বিবেচিত। আগামী দিনে ডিপসিকের এআই ‘জিপিটি-৪’ এবং মেটার তৈরি ‘লামা’ প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ড্রাগনভূমির হ্যাংঝো প্রদেশে রয়েছে ডিপসিকের প্রধান কার্যালয়। সংস্থাটির সিইও পদে রয়েছেন লিয়ান ওয়েনফেং। ‘কোয়ান্টিটিভ হেজ ফান্ড হাই-ফ্লায়ার’ সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০২১ সালে কয়েক হাজার এনভিআইডিআইএ জিপিইউ কেনেন তিনি। তখন অনেকেই বিষয়টি নিয়ে মজা করেছিলেন। পরে সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে নতুন কৃত্রিম মেধা তৈরি করেন লিয়ান।
২০২৩ সালে এআই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে ডিপসিক গড়ে তোলেন ওয়েনফেং। চিনা গণমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘কৃত্রিম মেধা থেকে কত টাকা লাভ হবে, সেটা তখন ভাবিনি। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য।’’ আর তাই দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পিএইচডি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
চিনা স্টার্ট আপের নতুন এআই প্রযুক্তি তৈরির ক্ষেত্রে ওয়েনফেংয়ের টিমের কৃতিত্বও কম নয়। অসংখ্য জার্নালে তাঁর দলের বহু সদস্যের লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পেয়েছেন পুরস্কারও।
‘ডিপসিক-আর১’ কী কী কাজ করতে পারবে, খোলাখুলি ভাবে তা জানিয়ে দিয়েছে চিনা প্রযুক্তি সংস্থা। কৃত্রিম মেধাটি গণিত, কোডিং এবং সাধারণ জ্ঞানের দুনিয়ায় দুর্দান্ত কাজ করছে বলে জানা গিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ওপেনএআইয়ের সর্বশেষ ‘ও১’ প্রযুক্তিকে টেক্কা দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কুর্সিতে বসেই চিনা পণ্যের উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছেন তিনি। ফলে আমেরিকার বাজারে ডিপসিক বড় বাধার মুখে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েই স্টাকগেট প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। এতে ৫০ হাজার কোটি ডলার খরচ করবে যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্য ওপেনএআই, ওরাকল এবং সফ্টব্যাঙ্কের মতো টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির কাছে আর্থিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। ফলে ডিপসিককে পাল্টা চালে মাত দিতে পারে ওয়াশিংটনের সিলকন ভ্যালি।
স্টারগেট প্রকল্পের মাধ্যমে আমেরিকায় এক লক্ষের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করতে চাইছেন ট্রাম্প। ঘরের মাটিতে অত্যাধুনিক এআই পরিকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। এই প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বনেতা হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছেন তিনি।