আমেরিকার সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে বেকায়দায় চিন। ড্রাগনভূমিতে হু-হু করে বাড়ছে বেকারত্ব। সেই সঙ্গে চরম আকার নিচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষও। এ হেন জোড়া ফলায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় সুর নরম করতে কিছুটা বাধ্য হয়েছে বেজিং। শুল্ক সংঘাত মিটিয়ে ফেলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত দিয়েছেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অন্য দিকে, এই ঘটনাকে ওয়াশিংটনের ‘জয়’ হিসাবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চিনের শ্রমিক বিক্ষোভ এবং আর্থিক মন্দা সংক্রান্ত খবর ইতিমধ্যেই বিশ্বের সামনে এনেছে ‘রেডিয়ো ফ্রি এশিয়া’ নামের বেতার গণমাধ্যম। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে নামা ইস্তক ড্রাগনভূমিতে বন্ধ হয়েছে একের পর এক কারখানা। একাধিক বড় সংস্থায় চলেছে ছাঁটাই। সেই কারণে তুঙ্গে উঠেছে শ্রমিক অসন্তোষ।
‘রেডিয়ো ফ্রি এশিয়া’ জানিয়েছে, চিনের শিল্পসমৃদ্ধ হুনান প্রদেশের ডাও কাউন্টিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন চাকরিহারা শ্রমিকেরা। একই ছবি দেখা গিয়েছে সিচুয়ানের সুইনিং শহর এবং ইনার মঙ্গোলিয়ার টংলিয়ায়। বিক্ষোভকারীদের একাংশ আবার বকেয়া মজুরি মিটিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। তাঁদের মুখ বন্ধ করতে শি প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ করছে বলেও খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
এই পরিস্থিতিতে আবার সিচুয়ানের বৈদ্যুতিন বোর্ড নির্মাণকারী একটি সংস্থার বিরুদ্ধে উঠেছে মারাত্মক অভিযোগ। সেখানকার শ্রমিকদের দাবি, চলতি বছরের গোড়া থেকে তাঁদের বিনা বেতনে কাজ করানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ২০২৩ সালের জুন থেকে প্রায় দু’বছর ধরে সামাজিক সুরক্ষার দায়িত্বও নেয়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থা। চিনের আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের জন্য যেটা করা বাধ্যতামূলক।
শুল্কযুদ্ধে বেজিঙের অবস্থা নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছে মার্কিন লগ্নিকারী ব্যাঙ্ক গোল্ডম্যান স্যাক্সের বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, এই আর্থিক লড়াই শুরুর এক মাসের মধ্যে চিনের কমপক্ষে ১ লক্ষ ৬০ হাজার কর্মসংস্থান মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অবস্থার বদল না হলে এই সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবল আশঙ্কার কথা বলেছেন তাঁরা।
বিশ্লেষকদের দাবি, চিনের অধিকাংশ শিল্পই রফতানির সঙ্গে জড়িত। সেই কথা মাথায় রেখে ঘরোয়া শ্রম বাজারকে সাজিয়েছেন বেজিঙের শাসনক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট নেতা-নেত্রীরা। কিন্তু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভাবে নিলামের মতো করে ড্রাগনভূমির পণ্যে শুল্ক চাপিয়েছেন, তাতে সেখানকার অর্থনীতিতে প্রভাব দেখতে পাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। ইতিমধ্যেই দেশটির বৃদ্ধির সূচক নিম্নমুখী হয়েছে। ভাঙতে শুরু করেছে শ্রম বাজারের শৃঙ্খলও।
চিনের দ্বিতীয় সমস্যা হল পরিযায়ী শ্রমিক। দেশি-বিদেশি কারখানাগুলিতে স্বল্প মজুরিতে কাজ করেন তাঁরা। ফলে অত্যন্ত সস্তা দরে বিপুল পরিমাণে পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে বেজিং। পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রাম থেকে শিল্পাঞ্চলগুলিতে নিয়ে আসা এবং সেখানে পরিবার নিয়ে থাকার সুবন্দোবস্ত রয়েছে ড্রাগনভূমিতে। এই কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভের আগুন জমা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
‘রেডিয়ো ফ্রি এশিয়া’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে উত্তর-পশ্চিম শানসি প্রদেশে টুয়ানজ়ি গ্রামের প্রায় এক ডজন পরিযায়ী শ্রমিক স্থানীয় প্রশাসনিক দফতরে অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁদের দাবি, এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বেতন পাচ্ছেন না তাঁরা। পরে এই নিয়ে সরকারি সংবাদমাধ্যমের সামনেও ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষোভ উগরে দিতে দেখা যায়। চিনের এই ঘটনাকে নজিরবিহীন বললে অত্যুক্তি হবে না।
এ ছাড়া গত ২৪ এপ্রিল হুনান প্রদেশের ডাও কাউন্টিতে ধর্মঘটের রাস্তায় হাঁটেন ‘গুয়াংজ়িন স্পোর্টস’-এর শ্রমিকেরা। ফলে ক্রীড়া সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থাটির কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সি অন্তত ১০০ জন মহিলা শ্রমিককে ছাঁটাই করে ‘গুয়াংজ়িন স্পোর্টস’। বকেয়া বেতন এবং সামাজিক সুরক্ষার অর্থ দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে ধর্মঘটীদের।
মার্কিন আর্থিক গবেষণা সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’-এর দাবি, ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিক থেকেই চিনে শ্রমিক অসন্তোষ মাথাচাড়া দিচ্ছিল। কারণ, ডিসেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প যে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আর তিনি যে কুর্সিতে বসেই বিরাট অঙ্কের শুল্ক চাপাবেন, সেই ইঙ্গিতও মিলেছিল। তবে তখনও ড্রাগনের শ্রমিক বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। সেই রাশ জিনপিং সরকারের মুঠো থেকে ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আমেরিকার গবেষণা সংস্থা।
‘ফ্রিডম হাউস’ জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে চিনের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের তিন-চতুর্থাংশের মূল কারণ হল অর্থনৈতিক। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, আবাসন প্রকল্পের কাজ স্থগিত হওয়ায় জমি মালিকদের অসন্তোষ এবং গ্রামীণ জমি ও আর্থিক বিবাদ। এগুলি চিনের কমিউনিস্ট সরকার এবং দলকে ভিতর থেকে দুর্বল করছে বলে ‘রেডিয়ো ফ্রি এশিয়া’কে বলেছে ‘ফ্রিডম হাউস’।
পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে আমেরিকার উপর চাপ বাড়ানোর কৌশল অবশ্য বজায় রেখেছেন প্রেসিডেন্ট শি। যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজ এবং চুম্বক রফতানি বন্ধ রেখেছেন তিনি। বৈদ্যুতিন গাড়ি থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে এই দুই পদার্থ অপরিহার্য। ফলে চিনের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিপদ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
উল্লেখ্য, আমেরিকাই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিরল খনিজ এবং চুম্বক আমদানি করে। এর বেশির ভাগটাই আসে চিন থেকে। অনেকের মতে, বেজিং যদি এই দুই দ্রব্য মার্কিন মুলুকে না পাঠায়, তবে চাপে পড়বে ওয়াশিংটনের বিভিন্ন শিল্প। আর তাই বিকল্প পথের সন্ধান চালাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার পর থেকেই চিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বেজিঙের আমদানি পণ্যের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। পাল্টা আমেরিকার পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করেছে জিনপিং প্রশাসন।
তবে এই শুল্কযুদ্ধে আমেরিকার অর্থনীতিতে কোনও প্রভাব পড়েনি, তা ভাবলে ভুল হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইতিমধ্যেই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। তাই আর্থিক লড়াইয়ে ইতি টানার বার্তা দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, চিনা পণ্যে শুল্কের মাত্রা অনেকটাই কমাতে পারে ওয়াশিংটন। তবে কখনওই সেটা শূন্যে নেমে আসবে না।
গত ২২ এপ্রিল ট্রাম্প বলেন, ‘‘২৪৫ শতাংশ শুল্ক অনেকটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এটা কমিয়ে এমন জায়গায় আনা হবে, যাতে সমস্যা মিটবে। তবে এ সব কিছুই নির্ভর করবে চিনের প্রতিক্রিয়ায় উপর।’’ প্রসঙ্গত, বিশ্বের অন্যান্য দেশের উপর চাপানো আমদানি শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রেখেছেন তিনি। এই সময়সীমার মধ্যে কোনও রাষ্ট্র আলোচনা চাইলে আমেরিকা তাকে স্বাগত জানাবে বলে স্পষ্ট করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
তবে ট্রাম্পের ৯০ দিনের শুল্ক স্থগিতে একমাত্র ছাড় পায়নি চিন। ফলে বিষয়টিকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি বেজিং। যদিও এপ্রিলের শেষে পৌঁছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করে সামান্য ইউ টার্ন নেওয়ায় আলোচনার রাস্তায় যাওয়ার ব্যাপারটি মূল্যায়ন করছে শি-র সরকার, খবর সূত্রের।
এই বিষয়ে গত ১ মে একটি বিবৃতি দেয় চিনের বাণিজ্য মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘শুল্কযুদ্ধ মিটিয়ে ফেলতে আলোচনার টেবিলে আসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েক বার ইঙ্গিত দিয়েছে। আমরা গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি।’’ আমেরিকার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা নিয়ে তেমন আপত্তি নেই বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বেজিং। ফলে অচিরেই দুই মহাশক্তির শুল্কযুদ্ধ মিটবে বলে মনে করা হচ্ছে।