রাশিয়ার থেকে ক্রমাগত সস্তা দরে খনিজ তেল কিনে চলেছে ভারত। নয়াদিল্লির এ-হেন মস্কো-প্রীতি একেবারেই না-পসন্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ওয়াশিংটনের অভিযোগ, এর মাধ্যমে ক্রেমলিনকে ক্রমাগত ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য অর্থ সরবরাহ করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই ‘অবাধ্যতা’র শাস্তি দিতে ভারতের উপরে বিপুল শুল্ক চাপানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর দলের নেতা-নেত্রীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের এ-হেন অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মনে অবশ্য যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। উল্টে তাঁদের দাবি, নয়াদিল্লি বিপুল পরিমাণে রুশ তেল কেনার ফলে গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল রয়েছে ‘তরল সোনা’র দর। নইলে খনিজ তেলের আকাশছোঁয়া দামের ছ্যাঁকায় টালমাটাল হত ইউরোপের অর্থনীতি। এর অবশ্যাম্ভাবী পরিণতিতে মন্দা এবং মুদ্রাস্ফীতির মুখে পড়ার আশঙ্কা ছিল ষোলো আনা।
আর্থিক বিশ্লেষকদের এই দাবির নেপথ্যে একাধিক যুক্তি রয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণের নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) চালিয়ে যাচ্ছে মস্কোর ফৌজ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই প্রকট হয় জ্বালানি সঙ্কট।
ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘাতের গোড়াতেই পুতিনের আগ্রাসন থামিয়ে দিতে মস্কোর উপর বিপুল পরিমাণে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিম ইউরোপ। এতে রুশ অর্থনীতির কোমর ভেঙে যাবে বলে মনে করেছিল তারা। কিন্তু, ফল হয় ঠিক উল্টো। রাতারাতি বাজার থেকে গায়েব হয়ে যায় ১০ শতাংশ খনিজ তেল। কারণ, এত দিন পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিকে সেটা সরবরাহ করে আসছিল ক্রেমলিন। নিষেধাজ্ঞার জেরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় সেই লেনদেন।
এই ঘটনার জেরে সবচেয়ে সমস্যার মুখে পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত এই সংগঠনের ২৭টি দেশ ছিল রুশ খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। হঠাৎ সেই সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় আমেরিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকগুলি থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি করা শুরু করে তারা। এর ফলে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ববাজারে চড়তে থাকে খনিজ তেলের দাম।
‘তরল সোনা’র দর বৃদ্ধিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ঠিক এই সময়ে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ভারত। পশ্চিম এশিয়া থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি শুরু করে নয়াদিল্লি। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এ দেশে আমদানি করা ‘তরল সোনা’র মাত্র দু’শতাংশ আসত মস্কো থেকে। বর্তমানে সেই সূচককে বাড়িয়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশে নিয়ে গিয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, রুশ অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দিতে ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের বেশিতে বিক্রি হওয়া মস্কোর খনিজ তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিম ইউরোপ। এই পরিস্থিতিতে পাল্টা চাল দিয়ে ‘তরল সোনা’-র দামে মেগা ছাড়ের ঘোষণা করেন পুতিন। ফলে কালবিলম্ব না করে ক্রেমলিনের থেকে তেল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ভারত। সরকারি নথি অনুযায়ী, এতে ব্যারেলপ্রতি ৩৫ ডলার সস্তায় ‘তরল সোনা’ কিনতে পারছে নয়াদিল্লি।
উল্লেখ্য, রুশ তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও পরিশোধিত পেট্রোপণ্যের উপরে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করেনি আমেরিকা ও পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে মস্কোর থেকে সস্তায় ‘তরল সোনা’ কিনে তাকে শোধন করে বিনা বাধায় ইউরোপের বাজারে বিক্রি করে চলেছে নয়াদিল্লি। সেই তালিকায় রয়েছে পেট্রল-ডিজ়েল, জেট ফুয়েল-সহ অন্যান্য পেট্রোপণ্য। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এ ভাবে ভারতের থেকে ঘুরপথে জ্বালানি কেনার ফলে অনেকটাই স্বস্তি পেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে রুশ তেলের এক নম্বর ক্রেতা ছিল ভারত। সম্প্রতি অবশ্য নয়াদিল্লিকে টপকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে চিন। কারণ বেজিঙের জ্বালানি প্রয়োজনীয়তা এ দেশের তুলনায় অনেকটা বেশি। এ দেশে ‘তরল সোনা’ আমদানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইরাক এবং সৌদি আরব। পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ থেকে যথাক্রমে আমদানি করা মোট তেলের ২১ এবং ১৩ শতাংশ কিনে থাকে নয়াদিল্লি।
এই তালিকায় চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে আমদানি করা তেলের ন’শতাংশ আসে আবু ধাবি থেকে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার তিন শতাংশ অবদান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য চায় রাশিয়ার বদলে তাদের থেকে আরও বেশি ‘তরল সোনা’ কিনুক ভারত। যদিও নয়াদিল্লি এখনও সে ব্যাপারে তেমন কোনও উৎসাহ দেখায়নি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রুশ খনিজ তেল নিয়ে বার বার ভারতকে হুমকি দেওয়ার নেপথ্যে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। ইউক্রেন যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে দ্বিমুখী লাভের ছক কষেছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, এর মাধ্যমে মস্কোর অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে দিতে চেয়েছিল তারা। দ্বিতীয়ত, তেলের জন্য ইউরোপ পুরোপুরি আমেরিকার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ুক, সেটা চেয়েছিল ওয়াশিংটন।
কিন্তু, ভারত সস্তা দরে বিপুল পরিমাণে রুশ তেল কিনতে থাকায় ভেস্তে যায় আমেরিকার পরিকল্পনা। ‘তরল সোনা’র দাম আকাশছোঁয়া হলে আখেরে লাভ হত যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, মার্কিন মুদ্রা ডলারেই কেবলমাত্র এই জ্বালানির লেনদেন হয়। বিশ্ব বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম যত চড়ত, ইউরোপ-সহ সমস্ত দেশকে তত বেশি দাম দিয়ে কিনতে হত খনিজ তেল। এতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী হতে থাকত ডলার।
সেই কারণে যুদ্ধের সময়ে তেল কিনে রাশিয়াকে ভারত অর্থের জোগান দিয়ে যাচ্ছে বলে সমানে অভিযোগ করে চলেছে আমেরিকা। বিশ্লেষকদের দাবি, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা দ্বিচারিতা রয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলি মস্কোর তেল পরিশোধনে উৎপাদিত পেট্রোপণ্য দিব্যি কিনে চলেছে। কিন্তু তাদের উপরে কোনও রকমের নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা বলতে শোনা যায়নি ওয়াশিংটনকে।
সম্প্রতি, ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির জন্য রাশিয়াকে ফের হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেন, ‘‘৫০ দিনের মধ্যে মস্কোকে শান্তি সমঝোতায় আসতে হবে। নইলে ক্রেমলিনের বাণিজ্যিক বন্ধুদের উপরে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেব আমরা।’’ যদিও তাঁর ওই হুঁশিয়ারি সে ভাবে গায়ে মাখেননি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
চলতি বছরের ১৪ জুলাই মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তি জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) মহাসচিব মার্ক রাটের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। এর দু’দিনের মাথায় ভারত, চিন ও ব্রাজ়িলের নাম করে হুঁশিয়ারির সুরে রাট বলেন, ‘‘নিষেধ সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে গেলে, মস্কোর থেকে তেল ও গ্যাস কিনতে থাকলে, কঠোর আর্থিক শাস্তির মুখে পড়তে হবে। ক্রেমলিন যদি শান্তি আলোচনাকে গুরুত্ব সহকারে না নেয়, তা হলে এই দেশগুলির উপরেও ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।’’
এর আগে এই ইস্যুতে একই কথা বলতে শোনা গিয়েছে মার্কিন সেনেটর (আমেরিকার পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর উচ্চ কক্ষ সেনেটের সদস্য) লিন্ডসে গ্রাহামের গলায়। তিনি আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে রুশ তেল কেনার ‘অপরাধে’ ভারত, চিন এবং ব্রাজ়িলের মতো ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির উপর ৫০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। এই সংক্রান্ত একটি বিলের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনুমোদন দিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন তিনি।
রুশ খনিজ তেলের ব্যাপারে আমেরিকার এ-হেন দ্বিচারিতার পাল্টা জবাব দিয়েছেন কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরী। তিনি বলেছেন, ‘‘মস্কোর থেকে আমরা তরল সোনা কেনার ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। নইলে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেত।’’
বর্তমানে খনিজ তেলের ৮০ শতাংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ৫০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করছে ভারত। রাশিয়ার পাশাপাশি আগামী দিনে ভেনেজুয়েলা এবং আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ থেকে এই ‘তরল সোনা’ কেনার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির।