পরস্ত্রীহরণ করার অপরাধে ছারখার হয়ে গিয়েছিল সোনার লঙ্কা। রামের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল লঙ্কাধিপতি দশানন রাবণকে। অন্যের স্ত্রীকে চুরি করার শাস্তি পেতে হয়েছিল প্রাণত্যাগ করে। সভ্য সমাজে অন্যের বৌ চুরি করাকে অপরাধ হিসাবেই গণ্য করা হয়ে থাকে।
আফ্রিকা মহাদেশে এমন কিছু জনজাতি রয়েছে তাদের রীতিনীতি আধুনিক সমাজের ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না। তেমনই একটি হল পরস্ত্রীহরণ। নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বাইরে সারা পৃথিবীতে এই আচরণকে অপরাধমূলক বলে ধরা হয়ে থাকে।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই আছে নিজস্ব কিছু নিয়মনীতি। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি উদ্ভট ও খাপছাড়াও বটে। এমনই একটি রীতি রয়েছে আফ্রিকার ওদাবে নামের এক উপজাতির মধ্যে। পশ্চিম আফ্রিকার নাইজারের এই উপজাতির মধ্যে দেখা যায় স্ত্রী ‘চুরি’র প্রথা। পশ্চিম আফ্রিকার নাইজারের যাযাবর এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীটি বছরের পর বছর ধরে মেনে চলছে এই অদ্ভুত প্রথা বা উৎসবটি।
বছরভর এই উপজাতির সদস্যেরা ছোট ছোট পরিবার নিয়ে গড়া কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান সাহারা মরুভূমির মরূদ্যানগুলিতে। দক্ষিণ নাইজার থেকে উত্তর নাইজেরিয়া, উত্তর-পূর্ব ক্যামেরুন, দক্ষিণ-পশ্চিম চাদ, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় এই উপজাতি। মূলত পশুপালন করেই জীবন অতিবাহিত করেন ওদাবেরা।
নাইজারের প্রান্তিক অঞ্চলে গেরেওয়াল নামের একটি উৎসব হয়। এই উৎসবে রয়েছে বিরল একটি রীতি। এই উৎসবটির প্রধান উদ্দেশ্যই হল পরস্ত্রীহরণ। এই উৎসবে পুরুষেরা যেমন যোগ দেন, সেই সঙ্গে যোগ দেন অংশগ্রহণকারী পুরুষের স্ত্রীরাও। তাই এই উৎসবের অন্য নাম ‘বৌ-চুরি উৎসব’।
বর্ষার শেষে সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রতি বছরই হাজার হাজার নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে পালন করেন গেরেওয়াল উৎসবটি। টানা সাত দিন সাত রাত ধরে চলে এই উৎসব। এই উৎসবের মূল আকর্ষণই হল অন্যের বৌয়ের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া। ওদাবে সমাজের যুবতী স্ত্রীরাও মুখিয়ে থাকেন পছন্দের পরপুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার জন্য।
সেই প্রথা অনুযায়ী ওদাবে উপজাতির পুরুষেরা মুখে ও দেহে বিভিন্ন ধরনের রং মেখে ছদ্মবেশ ধারণ করেন। তার পর অন্যের স্ত্রীর কাছে গিয়ে তাঁকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। উৎসব শুরুর ছ’ঘণ্টা আগে থেকে রূপটান শুরু করেন পুরুষেরা। মূলত রঙিন মাটি, পাখির পালক ও পুঁতি দিয়ে তৈরি হয় সাজপোশাক।
ওদাবে পুরুষেরা মনে করেন পৃথিবীতে তাঁরাই সবচেয়ে সুদর্শন। তাঁরা এই উৎসবে মন উজাড় করে দেন সাজপোশাক ও রূপচর্চায়। সাজার পর নাচতে নাচতে হাজির হন পরস্ত্রীর সামনে। সাজ ও নাচের মাধ্যমে পরনারীর হৃদয়হরণ করে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন ওদাবে পুরুষেরা।
রমণীদের চোখে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ওদাবের পুরুষেরা এমন ভাবে সাজসজ্জা করেন যাতে তাঁদের চোখের সাদা অংশ এবং দাঁতের রং বিশেষ ভাবে স্পষ্ট হয়। পুরুষেরা ময়ূর বা অন্যান্য পাখির অনুকরণে নৃত্য প্রদর্শন করে তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন।
এই উৎসবে তাঁরা অবিরাম নাচেন। নাচের ছন্দ পুনরাবৃত্তি করা হয়। যখন খুব গরম পড়ে, তখনই পুরুষেরা বিরতি নেন। শেষ রাত থেকে ভোর পর্যন্ত একটানা নাচেন তাঁরা। নৃত্যশিল্পীরা এমন একটি মিশ্রণ পান করেন যা তাঁদের দীর্ঘ সময় ধরে নাচের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। এই বলবর্ধক পানীয়টির একটি ‘হ্যালুসিনোজেনিক’ প্রভাব রয়েছে বলে জানা যায়।
গেরেওয়াল উৎসবে যোগদানের জন্য ওদাবে তরুণীদের কয়েকটি নিয়ম মানতে হয়। ১৩-১৪ বছর বয়স পেরোলেই তারা উৎসবে অংশ নিতে পারে। যে কিশোরী বা তরুণীর ঋতুস্রাব সবেমাত্র শেষ হয়েছে তাঁরাই গেরেওয়াল উৎসবে অংশ নেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
যদি কোনও পুরুষ ধরা না পড়ে কোনও রমণীর মন জয় করতে পারেন, তাঁকে পতি হিসাবে বরণ করে নেন সেই রমণী। নারী-পুরুষ পরস্পরকে পছন্দ করার সময় খোলা আকাশের নীচে সঙ্গমে লিপ্ত হন। সেই সম্পর্ক এক রাতের জন্য ক্ষণস্থায়ী হতে পারে আবার সেটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কখনও কখনও এই সম্পর্ক বিবাহে পরিণতি পায়।
ওদাবে সমাজে পুরুষদের একাধিক স্ত্রী থাকায় কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। মহিলারাই যে হেতু পরিবারের অধিকাংশ কাজ সামলান, তাই প্রথম স্ত্রী তাঁর সতীনদের নিয়ে আপত্তি তোলেন না। কারণ পরিবারের কাজকর্ম সতীনদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। তাই তাঁরা স্বামীর একাধিক বিবাহকে ইতিবাচক বলেই ধরে নেন।
পুরুষদের মতো নারীদের বহুগামিতাকেও সমর্থন করে থাকে এই উপজাতি সমাজ। তাই সংশ্লিষ্ট রমণীর সম্মতি থাকলে তিনি সমাজ-স্বীকৃত ভাবেই দ্বিতীয় পুরুষের সঙ্গে ঘর বাঁধতে পারেন। তবে ওই সম্প্রদায়ের সকলকেই যে এই পরবে অংশ নিতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
সমাজের কোনও পুরুষ যদি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হন তবে তারও নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। সহগোত্রীয় পুরুষকে দিয়ে স্ত্রীর গর্ভধারণ করান প্রজননে অক্ষম পুরুষ। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষেরা তাঁদের স্ত্রীদের আরও সুদর্শন পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি দেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্মের সন্তান সুদর্শন হয়।