২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ৬ লক্ষ ৮১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই উঠে গিয়েছে একটা প্রশ্ন। চিন এবং পাকিস্তানের মতো শত্রুভাবাপন্ন জোড়া প্রতিবেশীকে মোকাবিলার জন্য এই বাজেট বরাদ্দ কি পর্যাপ্ত? বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, নির্মলার বাজেটে যে পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছে, তাতে পাকিস্তানকে মোকাবিলা করা খুব কঠিন হবে না। কিন্তু চিনের সঙ্গে যুদ্ধে নামলে যথেষ্ট বেগ পাবে ভারতের ফৌজ। আর বেজিং ও ইসলামাবাদ একসঙ্গে আক্রমণ করলে, সেটা সামলানো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। বেজিঙের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার জেরে উল্লেখযোগ্য ভাবে শক্তিশালী হচ্ছে পাক ফৌজ। লড়াকু বিমান থেকে শুরু করে ডুবোজাহাজ এবং রণতরী— বিভিন্ন ক্ষেত্রে ড্রাগন সরকারের থেকে খোলাখুলি সাহায্য পাচ্ছে ইসলামাবাদ।
গত বছরের ডিসেম্বরে চিনের থেকে পঞ্চম প্রজন্মের জে-৩৫ স্টেলথ লড়াকু জেট পেতে বেজিঙের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে পাকিস্তান। ওই যুদ্ধবিমান হাতে পেলে ইসলামাবাদের বায়ুসেনা যে অনেকটাই শক্তিশালী হবে, তা বলাই বাহুল্য।
ভারতীয় আকাশ-যোদ্ধাদের কাছে বর্তমানে পঞ্চম প্রজন্মের কোনও যুদ্ধবিমান নেই। তা ছাড়া বর্তমানে লড়াকু জেটের সমস্যায় ভুগছে এ দেশের বায়ুসেনা। চিন এবং পাকিস্তানকে মোকাবিলার জন্য অন্তত ৪২ স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান থাকার প্রয়োজন। সূত্রের খবর, সেই সংখ্যা ৩২ স্কোয়াড্রনে নেমে এসেছে।
পাক সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষের দিকে চিনা জে-৩৫ স্টেলথ লড়াকু জেটগুলি শামিল হবে পাক বায়ুসেনায়। এ ছাড়া জেএফ-১৭ থান্ডার নামের আরও একটি যুদ্ধবিমানের ব্যাপারে বেজিঙের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। সেই চুক্তিও চূড়ান্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছরের নভেম্বরে বন্দর শহর করাচিতে একটি প্রতিরক্ষা প্রদর্শনী ও সেমিনারের আয়োজন করেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। সেখানে চিনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম চুক্তিতে সই করে ইসলামাবাদ। এর মধ্যে অন্যতম হল, পাকিস্তানের ভারী শিল্প সংস্থা ‘ট্যাক্সিলা’ এবং বেজিঙের ‘নরিনকো গ্রুপ’-এর মধ্যে হওয়া সমঝোতা।
প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতার জন্য চিনা সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে পাক-চেনাব ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়। তুরস্কের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের কান যুদ্ধবিমানটির নির্মাণেও ইসলামাবাদের জড়িয়ে থাকার খবর পাওয়া গিয়েছে।
অন্য দিকে, বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবহর রয়েছে ড্রাগন ফৌজের হাতে। চিনা বায়ুসেনা তৈরি করে ফেলেছে ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু যুদ্ধবিমান। বেজিঙের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ-ও কলেবরে ভারতের স্থলসেনার থেকে অনেকটাই বড়।
এ ছাড়া পিএলএতে রয়েছে বিশেষ একটি রকেটবাহিনী। তাঁদের অস্ত্রাগারে সাজানো আছে ১০ থেকে ১২ হাজার কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। বোমারু বিমানের সংখ্যাও লালফৌজের বায়ুসেনার নেহাত কম নয়। পাশাপাশি ড্রোনের শক্তির ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে বেজিং।
বর্তমানে বিশ্বের প্রথম ড্রোনবাহী রণতরী নির্মাণে হাত দিয়েছে চিন। আমেরিকার সেনাকর্তাদের একাংশের দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুসেনার নিরিখে ওয়াশিংটনের সমকক্ষ হয়ে উঠবে বেজিং। ড্রাগনভূমি পরমাণু হাতিয়ারের সংখ্যাও বৃদ্ধি করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে মিলছে খবর।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) অন্তত আড়াই শতাংশ হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন দেশের তাবড় বিশ্লেষকেরা। কিন্তু এতে জিডিপির ১.৯ শতাংশ বরাদ্দ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে প্রতিরক্ষায় বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬ লক্ষ ২১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে এই অঙ্ক ছিল ৫ লক্ষ ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এ বার বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে ৬ লক্ষ ৮১ হাজার কোটি টাকা করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় এ বারের সেনা বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ।
এ বারের প্রতিরক্ষা বাজেটের মোট বরাদ্দের মধ্যে মূলধনী ব্যয়ের পরিমাণ ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে। অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম কেনা এবং সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার আধুনিকীকরণের জন্য এই অর্থ ব্যয় করবে মন্ত্রক।
মূলধনী ব্যয়ের মধ্যে, বিমান এবং অ্যারো ইঞ্জিনের জন্য ৪৮ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যুদ্ধজাহাজের জন্য ২৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
এ ছাড়া বেতন ও পেনশন সংক্রান্ত ব্যয় ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং রাজস্ব ব্যয় ৪ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই বাজেট বৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর জন্য ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে বরাদ্দ হয়েছে ২৬ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। গবেষণা এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতিতে ১৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। সীমান্ত পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত বর্ডার রোড অর্গানাইজ়েশন পেয়েছে ৭,১৫০ কোটি টাকা।
ভারতীয় ফৌজের আধুনিকীকরণের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১ লক্ষ ১১ হাজার ৫৪৪.৮৩ কোটি টাকা। হাতিয়ার কেনার ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্থাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ঘরোয়া সংস্থাগুলির থেকে অস্ত্র কেনার জন্য মোট বরাদ্দ হওয়া টাকার ২৫ শতাংশ ব্যবহার করবে কেন্দ্র।
দেশীয় প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি আগামী আর্থিক বছরে ২৭,৮৮৬.২১ কোটি টাকার বরাত পাবে বলে এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটের পর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। যদিও এর কোনওটাই পর্যাপ্ত নয় বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
বর্তমানে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়ে ৭,৮০০ কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। এই অঙ্ক ১০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার দাবি তুলেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে খরচের নিরিখে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে ছিল ভারতীয় ফৌজ। প্রথম তিনটি জায়গায় রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিন।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, প্রতিরক্ষা খাতে বছরে ৭০ হাজার কোটি ডলার খরচ করে বেজিং। কেউ কেউ আবার এই অঙ্ক ৪০ হাজার বা ৫০ হাজার কোটি ডলার বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, ভারতের থেকে অন্তত চার বা পাঁচ গুণ বেশি অর্থ খরচ করছে ড্রাগন।
এই ফাঁক মেটাতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং হাতিয়ার রফতানির দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। সম্প্রতি পিনাকা মাল্টিব্যারেল রকেট লঞ্চার আর্মেনিয়াকে এবং ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ফিলিপিন্সকে বিক্রি করেছে নয়াদিল্লি। এই ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি আরও বাড়ুক, চাইছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে ভারতের ক্ষেত্রে দ্বিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা কম বলেও মনে করেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ। কারণ বর্তমানে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় পাক সরকারের নাজেহাল দশা। প্রায় প্রতি দিনই বালুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে সশস্ত্র গোষ্ঠীদের হামলার মুখে পড়ছে ইসলামাবাদের ফৌজ। ফলে পশ্চিম পার থেকে আক্রমণের আশঙ্কা হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।