নতুন করে চিনা শিক্ষার্থীদের ভিসা নয়। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ‘ডিগবাজি’ খেলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! তাঁর বক্তব্যের ‘ভুল ব্যাখ্যা’ করা হচ্ছে বলে ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। নজিরবিহীন ভাবে নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে এই ইস্যুতে কোনও পোস্ট করেননি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। অন্য দিকে, প্রতিক্রিয়া মেলেনি বেজিঙেরও।
চলতি বছরের ২৮ অগস্ট চিনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ট্রাম্পের ভিসা নীতির ব্যাখ্যা দেয় তাঁর ওভাল অফিস। মার্কিন গণমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ়’-এর করা প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউসের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘আমাদের প্রেসিডেন্ট বেজিঙের পড়ুয়াদের জন্য ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিচ্ছেন না। গত দু’বছরে যে ছ’লক্ষ শিক্ষার্থী এখানে এসেছেন তাঁদের ভিসা পুনর্নবীকরণের কথা বলেছেন মাত্র। এটা বিদ্যমান প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা।’’
গত ২৬ অগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে চিনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বিলির প্রসঙ্গে বিস্ফোরক ঘোষণা করেন ট্রাম্প। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আমি এ ব্যাপারে অনেক গল্প শুনেছি। আমরা নাকি ড্রাগনভূমির পড়ুয়াদের প্রবেশ করতে দিচ্ছি না। আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই যে সেটা হচ্ছে না। আমরা ওঁদের অনুমতি দেব। মোট ছ’লক্ষ শিক্ষার্থী ভিসা পাবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে আমরা বেজিঙের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব।’’
মন্ত্রিসভার বৈঠকে ট্রাম্পের ওই মন্তব্যের পরেই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে পড়ে যায় শোরগোল। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কড়া সমালোচনায় বিঁধতে থাকেন তাঁরই দল রিপাবলিকান পার্টির নেতানেত্রীরা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অতি ডানপন্থী লরা লুমার। সমাজমাধ্যমে করা পোস্টে তিনি লেখেন, ‘‘মনে রাখতে হবে চিনা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টির গুপ্তচর। ওঁদের এখানে ঢুকতে দিলে জাতীয় নিরাপত্তার নিরিখে সেটা হবে মারাত্মক বিপজ্জনক।’’
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘আমেরিকা প্রথম’ (পড়ুন আমেরিকা ফার্স্ট) নীতির কথা বলে প্রচারে ঝড় তোলেন ট্রাম্প। এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে অনড় রয়েছেন তিনি। এই আবহে চিনা পড়ুয়াদের ভিসার প্রশ্নে ট্রাম্প ‘দ্বিচারিতা’ করছেন বলে সুর চড়িয়েছেন লুমার। তাঁর যুক্তি, ‘‘বেজিঙের শিক্ষার্থীদের ঢালাও ভিসা বিলির সিদ্ধান্ত হল ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির পরিপন্থী। এটা কখনওই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’’
সমাজমাধ্যমের পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ট্যাগ করে তাঁরই দলীয় সতীর্থ লুমার লিখেছেন, ‘‘আমরা আরও মুসলিম এবং চিনাদের জায়গা দেওয়ার জন্য আপনাকে ভোটে জেতাইনি। দয়া করে যুক্তরাষ্ট্রকে মান্দারিনভাষীদের দেশে পরিণত করবেন না। যাঁরা আমেরিকাকে মহান করতে চান (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা মাগা) তাঁরা অভিবাসী চান না।’’ গত বছরের ভোটের সময় মাগা স্লোগানে সকলের নজর কাড়েন ট্রাম্প।
বেজিঙের পড়ুয়াদের ‘স্টুডেন্ট ভিসা’র ব্যাপারে এখানেই চুপ করে থাকেননি লুমার। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনতে ট্রাম্পের ওভাল অফিসের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ স্টিফেন মিলারকে ট্যাগ করে আর একটি পোস্ট করেন তিনি। সেখানে রক্ষণশীল রিপাবলিকান নেত্রী লেখেন, ‘‘আমি আবারও বলছি, আমেরিকাবাসীদের কেউই পড়ুয়াদের ছদ্মবেশে আরও ছ’লক্ষ চিনের কমিউনিস্ট গুপ্তচর চায় না। ওরা আমাদের ১২ লক্ষ সহ-নাগরিককে হত্যা করেছে। তাঁদের জীবন কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে?’’
লুমারের এই অভিযোগ কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের নিরাপত্তা আধিকারিকদের বড় অংশই মনে করেন, উচ্চশিক্ষার নামে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন ড্রাগনভূমির পড়ুয়ারা। তাঁদের মূল আনুগত্য রয়েছে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ বা সিপিসির প্রতি। আর তাই ট্রাম্প কড়া অবস্থান থেকে সরে আসতেই দেশ জুড়ে ওঠে সমালোচনার ঝড়।
দ্বিতীয়ত, মান্দারিনভাষী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির একগুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের দাবি, বিদেশে পড়তে যাওয়া চিনা পড়ুয়াদের বাধ্যতামূলক ভাবে বেজিঙের বিশেষ একটি আইন মানতে হয়। তাতে বলা হয়েছে, যখনই সংশ্লিষ্ট দেশটির ব্যাপারে সিপিসি কোনও তথ্য জানাতে চাইবে, ওই ছাত্র বা ছাত্রী, তা সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবেন। এর ফলে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ প্রশাসন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বলে মনে করেন লুমারের মতো রক্ষণশীল নেত্রীরা।
মার্কিন গোয়েন্দাদের আরও অভিযোগ, চিনা পড়ুয়াদের সঙ্গে ড্রাগন ফৌজ ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ এবং গুপ্তচর সংস্থা ‘মিনিস্ট্রি অফ স্টেট সিকিউরিটি’র (এমএসএস) ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হচ্ছে। বেজিং অবশ্য এই ধরনের তত্ত্বকে ‘মনগড়া কাহিনি’ বলে পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছে।
ট্রাম্প শপথ নেওয়ার চার মাসের মাথায় ভিসা নীতিতে বড় বদল আনে ওয়াশিংটন। গত ২৮ মে নতুন নিয়মের কথা ঘোষণা করেন মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো। তিনি বলেন, ‘‘আগামী দিনে আক্রমণাত্মক ভাবে চিনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বিপুল সংখ্যায় বাতিল করা হবে।’’ ফলে মান্দারিনভাষী যে ছাত্রছাত্রীরা যুক্তরাষ্ট্র পড়াশোনা করছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। যদিও ওই পড়ুয়াদের ভিসা সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
বিদেশসচিব রুবিয়ো জানিয়ে দেন, ড্রাগনভূমির যে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ বা সিপিসির সামান্যতম যোগাযোগও রয়েছে, তাঁরা কোনও ভাবেই মার্কিন ভিসা পাবেন না। তাঁর ওই ঘোষণার পর মান্দারিনভাষী পড়ুয়াদের একাংশ এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ‘সুদিন গিয়েছে’ বলে পোস্ট করতে থাকেন। অন্য দিকে, ট্রাম্পের এই ভিসা নীতির ভূয়সী প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি তাঁরই রিপাবলিকান পার্টির সতীর্থেরা।
চিনা পড়ুয়াদের ভিসা বাতিল করতে ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’ বিভাগের (পড়ুন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা স্বরাষ্ট্র) সঙ্গে যৌথ ভাবে মার্কিন বিদেশ দফতর কাজ করবে বলে জানিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু, তার মধ্যেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। শেষ পর্যন্ত তার ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে হোয়াইট হাউসকে।
বিশ্লেষকদের দাবি, গণহারে চিনা পড়ুয়াদের ভিসা বাতিলের পরিবর্তে তা পুনর্নবীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রথমত, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের জেরে আমেরিকার একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার প্রবল আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ, বিদেশি পড়ুয়াদের টিউশন ফি থেকে কোটি কোটি অর্থ উপার্জন করে থাকে তারা।
আমেরিকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রের গবেষণা চালিয়ে যেতে অনেকাংশেই বিদেশি পড়ুয়াদের থেকে প্রাপ্ত অর্থের উপরে নির্ভরশীল। চিনা পড়ুয়াদের ভিসা বিপুল সংখ্যায় বাতিল হলে সেগুলি থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হত। আর তাই কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে ট্রাম্প পিছিয়ে এসেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভিসা নীতির কড়া সমালোচনা করেন অভিবাসী আইনজীবী ডেভিড লিওপোল্ড। তিনি বলেন, ‘‘২০২৩ সালে শুধুমাত্র চৈনিক শিক্ষার্থীদের থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির রোজগারের অঙ্ক ছিল পাঁচ হাজার কোটি ডলারের বেশি। ভিসা বাতিলের ফলে সেই টাকা আসা বন্ধ হলে প্রতিষ্ঠানগুলি কী ভাবে গবেষণার কাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। এই সমস্যার সমাধান না করে একতরফা ভাবে ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া অবশ্য অনুচিত।’’
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন দেরিতে হলেও লিওপোল্ডের যুক্তি বুঝতে পেরেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ফলে তড়িঘড়ি পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ‘স্টুডেন্ট ভিসা’র আওতায় ২.৭ লক্ষের বেশি চিনা শিক্ষার্থী আমেরিকার বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। ২০১৯-’২০ আর্থিক বছরে এই সংখ্যা ছিল ৩.৭২ লক্ষ, যা সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালে বেজিঙের পড়ুয়াদের আমেরিকা যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়। ওই বছর ২.৭৭ লক্ষ পড়ুয়া ড্রাগনভূমি থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিল।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত ২৫ অগস্ট চিনা পণ্যে ২০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে বসে তিনি বলেন, ‘‘ওদের (বেজিঙের) হাতে কিছু তাস রয়েছে। আমাদের কাছেও অসাধারণ কিছু তাস আছে। কিন্তু আমি সেই তাসগুলি খেলতে চাই না। যদি আমি সেই তাসগুলি খেলি, তা হলে চিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ওই তাসগুলি খেলব না।’’
বিরল খনিজ এবং তা দিয়ে তৈরি চুম্বকের উপরে বর্তমানে বিশ্বে একাধিপত্য রয়েছে চিনের। মার্কিন সামরিক ক্ষেত্রে এর প্রবল চাহিদা রয়েছে। লড়াকু জেট, ডুবোজাহাজ এবং রণতরী তৈরিতে সংশ্লিষ্ট চুম্বকগুলি ব্যবহার করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সংস্থা। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প বাণিজ্য যুদ্ধে নামলে সেগুলির রফতানি বন্ধ করতে পারে ড্রাগন সরকার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবশ্য এ ব্যাপারে আগেভাগেই চিনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বেজিংকে চুম্বক দিতেই হবে। নইলে আমরা ওদের ধ্বংস করে দেব।’’ যদিও বিশ্লেষকদের একাংশের যুক্তি, মুখে হুমকি দিলেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট চাপে রয়েছেন তিনি। তাই কি মান্দারিনভাষী পড়ুয়াদের ভিসা পুনর্নবীকরণে সিদ্ধান্ত নিল আমেরিকা? উঠছে প্রশ্ন।