ব়ড়দিনের আগে আফ্রিকাকে বড় উপহার। গত কয়েক দশক ধরে চলে আসা রোয়ান্ডা এবং ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর (ডিআরসি) মধ্যে ‘যুদ্ধ’ থামালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘অন্ধকার মহাদেশে’ হিংসার বীভৎস চেহারা সহ্য করতে না পেরেই কি এই পদক্ষেপ? না কি ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাটির রয়েছে অন্য কোনও ছক? ওয়াশিংটনের শ্বেত প্রাসাদে (হোয়াইট হাউস) দু’পক্ষের শান্তিচুক্তিতে তাঁর মধ্যস্থতাকে ইতিমধ্যেই ‘বাঁকা চোখে’ দেখতে শুরু করেছেন কূটনীতিকদের একাংশ।
চলতি বছরের ২৭ জুন মার্কিন মধ্যস্থতায় ‘যুদ্ধ’ থামাতে সম্মত হয় মধ্য আফ্রিকার যুযুধান দুই প্রতিবেশী। যদিও সেই সংঘর্ষবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে দানা বেঁধেছিল সন্দেহ। গত ৪ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের উপস্থিতিতে শান্তিচুক্তিতে সই করেন রোয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে এবং কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি। তার পরই দুই রাষ্ট্রনেতার ভূয়সী প্রশংসা করে বিবৃতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সংশ্লিষ্ট শান্তিচুক্তি বিশ্বের দীর্ঘতম সংঘাতের অবসান ঘটাবে বলে দাবি করেছেন তিনি।
রোয়ান্ডা ও ডিআরসির মধ্যে হওয়া সমঝোতা নিয়ে ঠিক কী বলেছেন ট্রাম্প? মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথায়, ‘‘এটা সারা বিশ্ব, আফ্রিকা এবং সেখানকার দু’টি রাষ্ট্রের জন্য একটা মহান দিন। মনে রাখতে হবে যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়। রোয়ান্ডা এবং ডিআরসির গর্ব করার মতো আরও অনেক কিছু আছে।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর শান্তিচুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ভাষণ দেন সংশ্লিষ্ট দুই রাষ্ট্রের প্রেসি়ডেন্ট।
হোয়াইট হাউসে রোয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট কাগামে বলেন, ‘‘এই সমঝোতার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভাবে চেষ্টা করেছেন, তার প্রশংসা না করে উপায় নেই। তবে শান্তি একটা প্রক্রিয়া। সেটা এক দিন বা কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার নয়। মধ্য আফ্রিকায় রক্তপাত বন্ধ হবে কি না, সেটা এ বার পুরোপুরি ডিআরসির উপর নির্ভর করবে। কোনও সন্দেহ নেই যে আগামী দিনে অনেক উত্থান-পতনের মুখোমুখি হব আমরা। আর তাই আমাদের মূল লক্ষ্য হতে যাচ্ছে রোয়ান্ডার দারিদ্র দূরীকরণ।’’
অন্য দিকে ডিআরসির প্রেসিডেন্ট শিসেকেদি সংশ্লিষ্ট শান্তিচুক্তিকে মধ্য আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই সমঝোতাকে সম্মান করব। বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং সমৃদ্ধির নতুন যুগ শুরু করতে চাই আমরা। তার জন্য দু’দেশের নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল প্রয়োজন। সেই দিকে কড়া নজর রাখবে আমাদের সরকার।’’ কাগামের মতো ট্রাম্পের প্রশংসা করতে ভোলেননি শিসেকেদিও।
বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য এই শান্তিচুক্তিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, দশকের পর দশক ধরে রোয়ান্ডা ও ডিআরসির মধ্যে চলেছে রক্তক্ষয়ী লড়াই। হঠাৎ কোনও নথিতে সই করে রাতারাতি সেই শত্রুতা মিটিয়ে ফেলা অসম্ভব। আর তাই ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ‘অবাস্তব’ বলে সমালোচনা করেছেন তাঁরা। ফলে মধ্য আফ্রিকার ওই দুই দেশের আমজনতা সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটি শেষ পর্যন্ত কতটা মানবে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
উল্লেখ্য, ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, ‘এম-২৩’ নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দেওয়া সমর্থন বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে রোয়ান্ডা। অন্য দিকে ‘হুটু’ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ডিআরসি। বর্তমানে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর একটা বিশাল এলাকা রয়েছে ‘এম-২৩’ সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলে। সেখানকার ভাগ্য ঠিক করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটিতে সে ভাবে কিছু বলা নেই। ফলে এই ইস্যুতে নতুন করে সংঘর্ষ বাধার আশঙ্কা প্রবল।
শান্তিচুক্তির উপর ‘গ্রাউন্ড জ়িরো’ থেকে পাঠানো রিপোর্টে বিবদমান রোয়ান্ডা এবং ডিআরসির পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে কাতারের গণমাধ্যম ‘আল জ়াজিরা’। সেখানে বলা হয়েছে, মধ্য আফ্রিকার দুই রাষ্ট্রনেতা চাইলেও রক্তপাত বন্ধ হওয়া খুবই কঠিন। কারণ, ‘এম-২৩’ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ডিআরসির সেনা কমান্ডার এবং সৈনিকদের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই বললেই চলে। তা ছাড়া রোয়ান্ডা সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীটিও মার্কিন মূল্যবোধকে কতটা মেনে চলবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
শান্তিচুক্তির পর ট্রাম্প অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন মধ্য আফ্রিকার এই দুই দেশের থেকে বিরল খনিজ কিনবে আমেরিকা। ফলে অর্থনীতিকে মজবুত করা এবং দুর্দান্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ পাবে রোয়ান্ডা এবং ডিআরসি। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আমাদের সুন্দর পৃথিবীতে অনেক সম্পদ আছে। সে দিকে না তাকিয়ে আমরা শুধু রক্তে মাটি ভিজিয়ে চলেছি।’’ বিরল খনিজের জন্য অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র ওই দুই দেশের সঙ্গে পৃথক চুক্তি করবে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
রোয়ান্ডা এবং ডিআরসির সঙ্গে খনিচুক্তি হয়ে গেলে সেখানে দু’টি সংস্থাকে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। বিনিময়ে মধ্য আফ্রিকার দেশ দু’টি বিপুল অর্থ রোজগার করতে পারবে বলে দাবি করেছেন তিনি। বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম থেকে প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা বা চিকিৎসা সরঞ্জাম নির্মাণে প্রয়োজন হয় বিরল খনিজের। কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ভিত্তিক দুনিয়ায় একে সোনার চেয়েও দামি বলা যেতে পারে। এ-হেন বিরল খনিজের উপর বর্তমানে সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের।
বিশ্লেষকদের দাবি, সেই কারণেই রোয়ান্ডা এবং ডিআরসির মধ্যে চলা গত ৩০ বছরের সংঘর্ষ বন্ধ করতে চাইছেন ট্রাম্প। তাঁর মূল নজর রয়েছে পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার বিখ্যাত সুবিশাল ‘গ্রেট লেক্স’ এলাকার উপর। সেখানে রয়েছে বিরল খনিজের বিশাল ভান্ডার। এই শান্তিচুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টের স্বপ্নপূরণ হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলেই মনে করছেন ধুরন্ধর কূটনীতিকেরা।
গ্রেট লেক্স অঞ্চলটিকে আফ্রিকার ‘হৃৎপিণ্ড’ বলা যেতে পারে। সেখানে রয়েছে মিষ্টি জলের একাধিক হ্রদ। এর মধ্যে সর্ববৃহৎটির নাম ভিক্টোরিয়া। আফ্রিকার অন্যতম বিখ্যাত এই হ্রদটির আয়তন ৫৯ হাজার ৯৪৭ বর্গ কিলোমিটার। দ্বিতীয় স্থানে টাঙ্গানাইকা হ্রদ। ৩২ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এর বিস্তার। গ্রেট লেক্স অঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির ১০টি রাষ্ট্র। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ডিআরসি এবং রোয়ান্ডা।
সরকারি তথ্য বলছে, রোয়ান্ডা সীমান্ত লাগোয়া ডিআরসি ভূখণ্ডে মজুত রয়েছে দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি কোবাল্ট ও কোল্টন। এ ছাড়া সোনা, তামা এবং লিথিয়ামের মতো খনিজ সম্পদের বিরাট ভান্ডার রয়েছে সেখানে। অভিযোগ, স্থানীয় বিদ্রোহীদের কাজে লাগিয়ে সেগুলি কব্জা করার মতলব করছে চিন। আর তাই চুপ করে বসে না থেকে শান্তিচুক্তির অছিলায় আফ্রিকায় ‘দাবার চাল’ দিল ওয়াশিংটন, বলছেন কূটনীতিকেরা।
বর্তমানে বিশ্বের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কোবাল্ট সরবরাহ করে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (ডিআরসি)। কিন্তু মধ্য আফ্রিকার দেশটির ৮০ শতাংশ কোবাল্ট খনির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বেজিঙের সরকারি সংস্থার হাতে। তামা উত্তোলনের ছবিটাও একই রকম। ডিআরসির তাম্র এবং কোল্টন খনির ৮০ শতাংশ দখল করে রেখেছে ড্রাগন সরকার। পাশাপাশি সোনা, লিথিয়াম এবং অন্যান্য খনিজের উত্তোলন এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বিপুল লগ্নি রয়েছে চিনের।
পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, আফ্রিকার ওই এলাকার খনিজ সম্পদ হাতে পেতে ৪৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে বেজিং। মাটির গভীর থেকে উত্তোলনের পর কোবাল্টকে সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। সেগুলিকে পাঠাতে হয় শোধনাগারে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ডিআরসির অধিকাংশ কোবাল্ট শোধনাগার চালায় চিন। সেখান থেকেই সারা বিশ্বের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ কোবাল্ট সরবরাহ করে ড্রাগনভূমির একাধিক সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা।
আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কোবাল্ট, কোল্টন এবং লিথিয়ামের মতো বিরল ধাতুগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভির ব্যাটারি নির্মাণে এগুলি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নির্মাণ বা মহাকাশ গবেষণায় অনেক ক্ষেত্রে বিরল ধাতুকে কাজে লাগান বিজ্ঞানীরা। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মতো নিত্যদিনের ব্যবহার্য বৈদ্যুতিন সামগ্রী তৈরিতেও কাজে লাগে কোবাল্ট, কোল্টন ও লিথিয়াম।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ডিআরসির বিরল ধাতুর খনিজ সম্পদ কব্জা করায় চিন একরকম ‘জ্যাকপট’ পেয়েছে। কিন্তু, তার পরেও অতিরিক্ত লোভের কারণে বেজিঙের উপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ মধ্য আফ্রিকার ওই দেশ। ডিআরসির সাউথ কিভু প্রদেশের ৪৫০টির বেশি বেআইনি খনি থেকে লাগাতার ড্রাগনের সংস্থাগুলি কোবাল্ট উত্তোলন এবং পাচার করছে বলে অভিযোগ। সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে সেখানে শিশু শ্রমিকদের কাজ করানোর প্রমাণ মিলেছে।
আফ্রিকার জনজাতিগুলির মধ্যে শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে ‘হামিটিক তত্ত্ব’-এ বিশ্বাসী ছিল জার্মানি। সেই নিয়ম মেনে ‘টুটসি’কে উন্নত জাতিগোষ্ঠী হিসাবে দেগে দেয় ইউরোপের ওই দেশ। জার্মানরা মনে করতেন, তথাকথিত বর্বরদের ‘সভ্য’ করতে ইথিয়োপিয়ার উচ্চ ভূমিখণ্ড থেকে গ্রেট লেক্স এলাকায় পা পড়েছিল ‘টুটসি’দের। এই ধারণার ফলে সেখানে বৃদ্ধি পায় জাতিবিদ্বেষ। আর এক জনজাতি ‘হুটু’দের চিরশত্রুতে পরিণত হয় এই ‘টুটসি’রা।
এ-হেন জার্মান তত্ত্বের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে স্থলবেষ্টিত দেশ রোয়ান্ডার উপর। উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে ‘টুটসি’ ও ‘হুটু’দের মধ্যে জাতিসংঘর্ষকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে গ্রেট লেক্স অঞ্চলের এই রাষ্ট্র। ১৯৯৪ সালে সেখানে সংঘটিত হয় গণহত্যা। পরবর্তী দশকগুলিতে আক্রমণ এবং প্রতি আক্রমণে জড়িয়ে পড়ে এই দুই জনজাতির বিদ্রোহীরা। ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত তাতে ইতি টানতে পারবেন কি না, আগামী দিনে মিলবে তার উত্তর।