কথায় বলে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’। পশ্চিম এশিয়ায় ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে সেই প্রবাদ। সংঘাতের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে ইহুদিভূমির প্রতিবেশী মিশরে। সংঘর্ষের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ‘পিরামিডের দেশ’ প্রায় অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার জোগাড়! শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধ বন্ধ হলেও তার জেরে অস্থিরতা দেখা গিয়েছে উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও।
চলতি বছরের ১৩ জুন থেকে ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে গেলে মিশরকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি (লিকুইফায়েড ন্যাচরাল গ্যাস) সরবরাহ বন্ধ করে ইজ়রায়েল। এর জেরে ‘পিরামিডের দেশে’ ব্যাহত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। কারণ, কায়রোর তড়িৎশক্তি কেন্দ্রগুলি পুরোপুরি তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। ফলে, ইহুদি সরকার সরবরাহ বন্ধ করায় বিকল্প রাস্তার খোঁজে নেমে পড়েছে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ অল-সিসির প্রশাসন।
এত দিন পর্যন্ত মূলত দু’টি কেন্দ্র থেকে মিশরকে গ্যাস সরবরাহ করে এসেছে ইজ়রায়েল। সেগুলি হল, লেভিয়াথন এবং কারিশের গ্যাসক্ষেত্র। এই দু’টি জায়গা থেকে ২০ শতাংশ এলএনজি পেত কায়রো। যুদ্ধের কারণে আচমকা সেটা বন্ধ হওয়ায় পিরামিডের দেশের পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী করিম বাদাউন ডিজ়েল এবং মাজ়ুতের মতো নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এই পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা মেটাতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
গত বছর বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকারে ডুবে যায় দেশের একাংশ। ‘ব্ল্যাকআউট’-এর সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি মিশরবাসী। ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না বলে অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সিসি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, একটা সময়ে নীল নদের দেশটি থেকে রফতানি হত বিপুল পরিমাণে এলএনজি। কিন্তু, বর্তমানে আমজনতাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানকার সরকার।
সিসি প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল মিশর। অন্য দিকে ইজ়রায়েল রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় এখন মাত্র ৫৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করছে কায়রো, চাহিদার নিরিখে যা অপ্রতুল। সহারা মরুভূমি সংলগ্ন ‘পিরামিডের দেশের’ জনসংখ্যা ১১.৪৫ কোটি। প্রতি দশকে সেখানকার তাপমাত্রা ০.৫৩ ডিগ্রি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতি দিন বিদ্যুৎবিভ্রাট হওয়ায় গ্রীষ্মকালে বেঁচে থাকাটাই মিশরীয়দের কাছে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া থেকে ইহুদিভূমির উপর বড় আকারের হামলা চালায় ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। সেই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ওই সময় থেকেই মিশরকে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ কমিয়ে দেয় তেল আভিভ। ফলে পরবর্তী দিনগুলিতে ধীরে ধীরে কায়রোর পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে।
সহারা মরুভূমির কোলের দেশ হওয়ায় গ্রীষ্মে মিশরের তাপমাত্রা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ক্রমাগত বিদ্যুৎবিভ্রাটের জেরে সেখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে কায়রোর অর্থনীতিতে। গত বছরের মার্চে উত্তর আফ্রিকার ‘পিরামিডের দেশ’টিকে ঋণ দিতে সম্মত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড)। ফলে আর্থিক ভাবে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে সিসি সরকার।
গত ২৪ জুন ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি হলে তামার ক্ষেত্র থেকে পুনরায় মিশরে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ শুরু করে নেতানিয়াহুর সরকার। কিন্তু, কায়রোর চাহিদার নিরিখে সেটা পর্যাপ্ত নয়। সেই কারণে বিকল্প পথের সন্ধান পেতে একরকম মরিয়া হয়ে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ কাতারের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে মিশর। এ ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
এ বছরের মে মাসে কাতারের রাজধানী দোহা সফরে যান মিশরীয় পেট্রলিয়ামমন্ত্রী করিম বাদাউন। তখনও অবশ্য সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েনি শিয়া এবং ইহুদি ফৌজ। তার মধ্যেই যৌথ উদ্যোগে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন খনির অনুসন্ধান এবং এই খাতে লগ্নিতে সম্মত হয় কায়রো। অন্য দিকে ‘পিরামিডের দেশের’ কর্পোরেট সংস্থাগুলির জন্য হাট করে বাজারের দরজা খুলে দিয়েছে ওই আরব মুলুক।
কাতার ও মিশরের মধ্যে ঐতিহাসিক ভাবে নেই কোনও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া এবং জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য টাকার জোগান দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে দোহার উপরে নানা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কায়রো। এ ব্যাপারে মিশরকে সমর্থন জানায় পশ্চিম এশিয়ার আরও একটি দেশ। দু’পক্ষের সম্পর্ক সহজ হতে সময় লেগে গিয়েছে চার বছর। ২০২১ সালে সংশ্লিষ্ট নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে দোহার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে নজর দেন প্রেসিডেন্ট অল-সিসি।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের উত্তর আফ্রিকার ডিরেক্টর করিম মেজ়রান। তাঁর কথায়, ‘‘দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের মূল কারণ হল দোহার তরফে মুসলিম ব্রাদারহুড নামের উগ্রপন্থী সংগঠনকে সমর্থন। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটির বেশ কয়েক জনকে আশ্রয় দেয় আরব দেশ। তাতেই একটা সময় বেজায় চটেছিল কায়রো। কারণ, মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব তখন মিশরে দ্রুত গতিতে বাড়ছিল। এতে প্রমাদ গোনেন সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব।’’
করিমের দাবি, বর্তমানে সেই পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। পাশাপাশি, কাতার ও মিশরের মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাত। এই যুদ্ধের প্রভাব কায়রোর পাশাপাশি তিউনিশিয়া এবং লিবিয়ার মতো উত্তর আফ্রিকার দেশগুলিতে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
পশ্চিম এশিয়ার ইহুদি রাষ্ট্রকে সরকারি ভাবে মান্যতা দেয়নি তিউনিশিয়া। ফলে তেল আভিভের সঙ্গে তাদের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। অন্য দিকে ইরানের সঙ্গে উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির সীমিত সম্পর্ক রয়েছে। তবে আদর্শগত ভাবে পারস্য উপসাগরের শিয়া দেশটির সঙ্গে তিউনিশিয়া এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে এমনটা নয়। ইহুদিদের বিপদ বাড়িয়ে তেহরানকে কোনও হাতিয়ার বা আর্থিক সাহায্য কখনওই করেনি উত্তর আফ্রিকার এই দেশ।
লিবিয়ার ছবিটাও প্রায় একই রকম। ইজ়রায়েলের সঙ্গে কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ত্রিপোলির। অন্য দিকে কিছু ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করে থাকে উত্তর আফ্রিকার এই দেশ। তবে সেখানে প্রভাব বিস্তার করার জন্য লম্বা সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে তেহরান।
২০২৩ সালে লিবিয়ার বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে ইজ়রায়েলি বিদেশমন্ত্রীর গুপ্ত বৈঠকের কথা ফাঁস হয়ে যায়। এর পরই ত্রিপোলির অবস্থান নিয়ে আরব দুনিয়ায় শুরু হয় হইচই। কিন্তু, ওই সময়ে অভ্যন্তরীণ গোলমালে উত্তর আফ্রিকার দেশটি জড়িয়ে পড়ে। আর তাই শিয়া ও ইহুদিদের সংঘাত থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হয় তারা।
তিউনিশিয়া এবং লিবিয়ার মতো দেশগুলি পশ্চিম এশিয়ার খনিজ তেলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাত চলাকালীন পারস্য উপসাগরের হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দেয় তেহরান। কিন্তু, তার পরেও ইহুদি ফৌজ আক্রমণ বন্ধ না করায় সেই প্রক্রিয়া শুরু করে সেখানকার শিয়া সরকার। গুরুত্বপূর্ণ এই সামুদ্রিক রাস্তা দিয়ে বিপুল পরিমাণে তেল সরবরাহ করে থাকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাহরাইন, সৌদি আরব এবং কাতারের মতো দেশ।
ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের কোনও সরাসরি প্রভাব তিউনিশিয়া এবং লিবিয়ার উপরে না পড়লেও ‘তরল সোনা’র দামে ছ্যাঁকা খেতে হয়েছে উত্তর আফ্রিকার এই দুই দেশকে। সংঘর্ষবিরতির পর তাই বিকল্প রাস্তার খোঁজ চালাচ্ছে তারাও।
তবে এই যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মরক্কো ও আলজিরিয়ার উপরে। সহারা মরুভূমির পশ্চিম অংশের দখল নিয়ে সংশ্লিষ্ট দু’টি দেশের মধ্যে গত কয়েক বছরে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে। ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সমর্থন আলজিরিয়া পাচ্ছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমি শক্তি এবং ইজ়রায়েলের সহযোগিতায় তেহরানের সরকারের পতন দেখতে চাইছে মরক্কো।