‘টেক টাইটান’ বনাম ‘মাগা সিজ়ার’-এর যুদ্ধে সরগরম আমেরিকা। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই তীব্র হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের ইলন মাস্কের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংঘাত। দুই ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’র এ হেন কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্যে উঠে এসেছে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূতের নাম। তাঁর কীর্তিকলাপে রয়েছে কিংবদন্তি চিনা সেনা অফিসার সান জ়ুর মতাদর্শের ছাপ। বেজিঙের জেনারেল বিশ্বাস করতেন, ‘‘যুদ্ধের সর্বোচ্চ শিল্প হল লড়াই না করে শত্রুকে দমন করা।’’
এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রাজনীতিক হলেন বিবেক গণপতি রামস্বামী। ট্রাম্প ও মাস্কের লড়াইয়ে ‘নিরপেক্ষ’ থেকে বর্তমানে নিজের ঘর গোছাতে ব্যস্ত তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো প্রদেশের গভর্নর নির্বাচনে ভাগ্যপরীক্ষা হবে তাঁর। ভোট-বৈতরণী পেরোতে তাই কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করায় ব্যস্ত রামস্বামী। তাঁর এ হেন পদক্ষেপ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা না কি নেপথ্যে রয়েছে অন্য ছক, তা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় খবরের শিরোনামে আসেন বিবেক রামস্বামী। রিপাবলিকান দলের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু, জনপ্রিয়তার নিরিখে ট্রাম্প অনেকটা এগিয়ে যাওয়ায় সেই দৌড় থেকে ছিটকে যান বিবেক। পরবর্তী সময়ে ট্রাম্পের হয়ে প্রচারে নামেন তিনি। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ বা ‘মাগা’ স্লোগানে ঝড় তোলার নেপথ্যে রামস্বামীর হাতও কম ছিল না।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বিবেককে ‘পুরস্কার’ দিতে ভোলেননি ট্রাম্প। শপথগ্রহণের পর বিশেষ একটি দফতর তৈরি করেন তিনি। নাম, ‘সরকারি দক্ষতা বিষয়ক দফতর’ বা ডিওজিই (ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি)। এর কাজ হল প্রশাসনের ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ কাটছাঁট এবং অর্থনৈতিক সাশ্রয়। সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রধান হিসাবে মাস্ককে নিয়োগ করেন ট্রাম্প। রামস্বামী ছিলেন তাঁর ডেপুটি। আর এ ভাবেই প্রেসিডেন্টের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর অংশ হয়ে পড়েন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, অচিরেই বিবেক বুঝতে পারেন, ডিওজিইতে থেকে প্রশাসনিক সংস্কার সম্ভব নয়। কারণ, ট্রাম্প মুখে যে লম্বা-চওড়া কথা বলছেন, বাস্তবে সেটা করা বেশ কঠিন। অন্য দিকে, মাস্কের লক্ষ্য তাঁর নিজস্ব সমাজমাধ্যম সংস্থাটিকে (পড়ুন এক্স হ্যান্ডল) আমজনতার মধ্যে আরও জনপ্রিয় করে তোলা। তখনই আসন্ন বিপদ আঁচ করে নিঃশব্দে সরে পড়েন রামস্বামী।
বিবেকের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, ডিওজিই-র পরিচালনা নিয়ে ক্ষোভের কারণেই ট্রাম্পের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ ছাড়েন তিনি। বন্ধুদের কাছে দুঃখ করে একবার রামস্বামী নাকি বলেন, ‘‘ওখানে কোনও প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। বরং একটা ডিজিটাল আত্মঘাতী মিশনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প ও মাস্ক। অহঙ্কার, ক্যাফিন আর হ্যালুসিনেশনের দ্বারা গোটা প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে।’’
তবে প্রকাশ্যে এই নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেননি ওহায়োর গভর্নর পদপ্রার্থী। এ বারে প্রচারে সযত্নে ট্রাম্পের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন রিপাবলিকান বিবেক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়কার স্লোগান মাগার কথা ভুলেও তুলছেন না। বরং ইন্টারনেটের সংস্কার এবং দেশের আর্থিক উন্নয়ন নিয়ে বেশি কথা বলতে শোনা যাচ্ছে তাঁকে। রামস্বামী ভালই জানেন যে ভোটের সময়ে দেওয়া বহু প্রতিশ্রুতি এখনও পূরণ করতে পারেননি ট্রাম্প।
আমেরিকার কট্টর প্রভাবশালীদের একাংশ রামস্বামীকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং ‘সুবিধাবাদী’ বলে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছেন বিবেক। অতীতেও এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। বর্ণবৈষম্যের শিকার পর্যন্ত হয়েছেন তিনি। একটা সময়ে তাঁকে ‘বায়োটেক ব্রাহ্মণ’ বলে উত্ত্যক্ত করতেন রক্ষণশীলেরা। সেই কুৎসা গায়ে মেখে রিপাবলিকান দলের অন্যতম শীর্ষপদে উঠে এসেছেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
৩৯ বছরের বিবেকের জন্মও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়োয়। কেরলের তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান রামস্বামী আরও একটি কারণে ট্রাম্পের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সেটি হল, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্টের একের পর এক কড়া পদক্ষেপ। এর প্রভাব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির গবেষণামূলক প্রকল্পগুলির উপরে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে নিজের আপত্তির কথা ঘনিষ্ঠ মহলে বহু বার বলেছেন বিবেক।
মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রায় সকলেই রামস্বামীর সিদ্ধান্তকে ‘দূরদর্শী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের যুক্তি, যে ভাবে ট্রাম্প ও মাস্ক লড়ছেন, তাতে দু’জনের মধ্যে এক জনের পতন অবশ্যম্ভাবী। সেই বিপদ আঁচ করতে পেরেই ‘ক্ল্যাশ অফ টাইটান’-এর মঞ্চ থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছেন বিবেক।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ছাপিয়ে যেতে চাইছেন মাস্ক। তাঁর ‘অঙ্গুলিহেলনে’ সরকার চলুক, এমনটা ইচ্ছা ছিল মার্কিন ধনকুবেরের। অন্য দিকে, বর্ষীয়ান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। ‘বড় সুন্দর’ বিল এনে মাস্ককেই বেকায়দায় ফেলেছেন তিনি। এতে টেসলা-কর্তার ব্যবসার বিপুল লোকসান হয়েছে। ফলে দু’জনের মাখোমাখো ‘প্রেমের’ সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটতে সময় লাগেনি।
গত ২৯ মে ট্রাম্পের ডিওজিই থেকে পদত্যাগ করেন মাস্ক। এর পরেই সংশ্লিষ্ট বিলটি নিয়ে চাঁচাছোলা ভাষায় সমালোচনা করতে শুরু করেন তিনি। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা পোস্টে টেসলা-কর্তা লিখেছেন, ‘‘কোনও বিল একই সঙ্গে বড় এবং সুন্দর হতে পারে না। যাঁরা এর পক্ষে ভোট দিয়েছেন, এটা তাঁদের লজ্জা। তাঁরা জানেন যে তাঁরা ভুল করেছেন।’’ পাশাপাশি, বিলটিকে ‘জঘন্য’ বলতেও পিছপা হননি ধনকুবের শিল্পপতি।
অন্য দিকে ট্রাম্পের দাবি, বিলটি সম্পর্কে নাকি আগেই সব কিছু জানতেন মাস্ক। তখন কোনও বিরোধিতা করেননি তিনি। কিন্তু, এর জেরে তাঁর বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভি (ইলেকট্রিক্যাল ভেহিকেল) নির্মাণকারী সংস্থা টেসলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সমালোচনা শুরু করেছেন তিনি। মাস্কের লাগাতার বিরোধিতার জেরে গত ৫ জুন তাঁর সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধের হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প।
বর্তমানে এই কাদা ছোড়াছুড়ি একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেমে আসায় বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে। এক্স হ্যান্ডলে টেসলা-কর্তা লিখেছেন, ‘‘আমার সাহায্য ছাড়া ট্রাম্প এই নির্বাচনে জিততে পারতেন না।’’ এমনটি তাঁকে ‘ইমপিচ’ (পদচ্যুত) করার দাবি পর্যন্ত তুলেছেন মাস্ক। ট্রাম্পের জায়গায় ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সকে বসানোর কথা বলতে শোনা গিয়েছে টেসলা-কর্তাকে।
মাস্কের আরও অভিযোগ, বিতর্কিত ‘এপস্টাইন ফাইলে’ নাম রয়েছে ট্রাম্পের। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘শুধু এই কারণেই ফাইলটি প্রকাশ্যে আনা হয়নি। ভবিষ্যতের জন্য এটাকে মাথায় রেখে দিন। সত্যি সামনে আসবে।’’ আমেরিকায় মধ্যবর্তী বা মিড টার্ম নির্বাচনের আগে তাঁর এ হেন মন্তব্যে প্রেসিডেন্টের রক্তচাপ বাড়ল বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
মাস্কের দাবি, যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত জেফরি এপস্টাইনের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, এপস্টাইনের বিলাসবহুল বিমান ‘লোলিটা এক্সপ্রেস’-এ চেপে বেশ কয়েক বার বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। চলতি বছরের গোড়ায় ওই ফাইলের একাংশ প্রকাশ্যে আনা হয়। কিন্তু টেসলা-কর্তা সংশ্লিষ্ট ফাইলের পুরো অংশ প্রকাশ্যে আনার দাবি জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হাত সেঁকার সুযোগ নিতে আসরে নেমে পড়েছে রাশিয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হলে মাস্ককে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দেওয়ার কথা বলেছেন মস্কোর এক রাজনৈতিক নেতা। যদিও সরকারি ভাবে আমেরিকার ঘরোয়া ব্যাপারে নাক গলানোর ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে বলে স্পষ্ট করে দিয়েছে ক্রেমলিন।
‘দ্য আর্ট অফ ওয়ার’ নামের একটি বই লেখেন চিনা জেনারেল সান জ়ু। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘যে জানে কখন লড়াই করতে হবে আর কখন করতে হবে না, সে নিশ্চিত ভাবেই যুদ্ধে জয়ী হবে।’’ বিশ্লেষকদের দাবি, এই তত্ত্ব মেনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়াই করে অযথা শক্তি ক্ষয় করছেন না রামস্বামী। বরং গভর্নর হিসাবে কুর্সি দখলকেই পাখির চোখ করছেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওহায়োর নির্বাচন বিবেকের রাজনৈতিক কেরিয়ারে বড় বাঁক আনবে। এর জন্য আগামী দিনে তাঁর সামনে ফের খুলতে পারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দরজা। অন্য দিকে, পৃথক রাজনৈতিক দল তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছেন মাস্ক। আবার ‘কিং মেকার’-এর ভূমিকাতেও তাঁকে দেখতে পাওয়া যেতে পারে। তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, ‘অজাতশত্রু’ তামিল ব্রাহ্মণটি যে ইচ্ছামতো সমর্থন আদায়ের সুযোগ পাবেন, তা বলাই বাহুল্য।