Drone and Pager Attack

‘চোরাই’ ড্রোনে ধ্বংস বোমারু বিমান-এয়ার ডিফেন্স, পেজারে মৃত্যুমিছিল! দুই যুদ্ধের ‘হাইব্রিড’ মডেলে শিউরে উঠছে বিশ্ব

রাশিয়া-ইউক্রেন হোক বা ইরান-ইজ়রায়েল, ২১ শতকের যুদ্ধে নতুন ‘হাইব্রিড’ রণকৌশলে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বিবদমান গোষ্ঠীর দুই গুপ্তচর সংস্থা। এতে সংঘর্ষ আরও বেশি প্রাণঘাতী হওয়ায় দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়েছে আতঙ্ক।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৫ ০৭:৫৪
Share:
০১ ১৭

১২ দিন ধরে চলা যুদ্ধে আপাতত দাঁড়ি টেনেছে ইরান-ইজ়রায়েল। মার্কিন মধ্যস্থতায় সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয়েছে যুযুধান দুই পক্ষ। অন্য দিকে তিন বছর পেরিয়ে এখনও অব্যাহত রাশিয়া-ইউক্রেনের লড়াই। এই সমস্ত সংঘাতের মধ্যেই আধুনিক রণকৌশল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। আর সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই চলে এসেছে হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার, সাইবার, ড্রোন এবং কৃত্রিম মেধাভিত্তিক আক্রমণের প্রসঙ্গ।

০২ ১৭

বিশ্লেষকদের দাবি, ২১ শতকের যুদ্ধের রণকৌশলগত পরিবর্তনের সর্বশেষ ঝলক দেখিয়েছে ইহুদি ফৌজ। চলতি বছরের ১৩ জুন ইরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিকে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী নিশানা করলে লড়াইয়ের ময়দানে নামে শিয়া সেনা। তেল আভিভ এই অভিযানের পোশাকি নাম রাখে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’। গোড়াতেই সাবেক পারস্য দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্সকে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় তাঁদের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।

Advertisement
০৩ ১৭

তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্রথাগত হামলা চালিয়ে ইরানি বাহিনীর ওই হাতিয়ারকে ধ্বংস করেনি ইজ়রায়েল। এর জন্য অত্যন্ত সন্তর্পণে চোরাপথে ছোট ছোট বিস্ফোরকবোঝাই ড্রোনকে তেহরানে নিয়ে যান মোসাদ। পাশাপাশি, সাবেক পারস্য দেশটির কোথায় কোথায় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে, সংগ্রহ করা হয় সেই তথ্য। এর পর ইহুদি বায়ুসেনা আক্রমণ শানানোর মুখে নিখুঁত আক্রমণ শানিয়ে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে উড়িয়ে দেয় তারা।

০৪ ১৭

আধুনিক লড়াইয়ে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের গুরুত্ব অপরিসীম। একে বাহিনীর ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ বলা যেতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্র হোক বা যুদ্ধবিমান, আকাশপথে যে কোনও আক্রমণ রু‌খে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই ব্যবস্থার। যুদ্ধের গোড়ায় সেই হাতিয়ার ধ্বংস হওয়ায় ইরানের আকাশ পুরোপুরি চলে যায় ইহুদি বায়ুসেনার কব্জায়। আর তাই মোসাদের ওই অপারেশনকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকেরা।

০৫ ১৭

এই সংক্রান্ত তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বর্তমান এবং প্রাক্তন মিলিয়ে অন্তত ১০ জন ইজ়রায়েলি গোয়েন্দা এবং উচ্চপদস্থ সেনাকর্তার সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন সংবাদ সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন প্রেস’ বা এপি। তাদের দাবি, গত কয়েক দশক ধরে ইরানের ভিতরে একটি মজবুত নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে মোসাদ। শত্রুদেশে নিযুক্ত এজেন্টের কাঁধেই ছিল তেহরানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ধ্বংসের গুরুদায়িত্ব।

০৬ ১৭

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইহুদি গোয়েন্দা এবং ফৌজের পদস্থ কর্তাদের উদ্ধৃত করে এপি লিখেছে, রাজধানী তেহরানের ভিতরে রীতিমতো একটা ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করে মোসাদ। সেখান থেকেই সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলিতে হামলা চালানো হয়। এর জন্য অন্তত তিন বছর ধরে পরিকল্পনা করেন ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থার শীর্ষকর্তারা।

০৭ ১৭

আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ আবার জানিয়েছে, এই অভিযানে ‘কোয়াডকপ্টার’ নামের একটি বিশেষ ধরনের ড্রোন ব্যবহার করে তারা। স্যুটকেস, ট্রাক এবং মালবাহী জাহাজের কন্টেনারে করে সেগুলিকে তেহরানের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ড্রোন উৎক্ষেপণের লঞ্চার ও বিস্ফোরকও সাবেক পারস্য দেশে পাচার করে ইজ়রায়েল।

০৮ ১৭

সূত্রের খবর, মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিতে আরও বেশি ঘাতক করে তুলতে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তিকে কাজে লাগান ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এর জেরে স্বতন্ত্র ভাবে নিজেদের লক্ষ্য খুঁজে নিতে পেরেছিল হামলাকারী ‘কোয়াডকপ্টার’ ড্রোনের ঝাঁক। উক্ত অপারেশনে গুপ্তচর কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যও মোসাদ নিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।

০৯ ১৭

গত ১ জুন যাবতীয় গোয়েন্দা ‘নেটওয়ার্ক’ এবং প্রতিরক্ষা নজরদারি ব্যবস্থার ‘চোখে’ ধুলো দিয়ে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের অনেকটা ভিতরে ঢুকে পাঁচ বায়ুসেনা ঘাঁটিতে নিখুঁত ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। তাতে বোমারু ও নজরদারি মিলিয়ে মস্কোর অন্তত ৪০টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে বলে দাবি করে কিভ। ইরানি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের ক্ষেত্রে ইহুদি গুপ্তচরদের একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা গিয়েছে, মত বিশ্লেষকদের।

১০ ১৭

ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে একসঙ্গে একগুচ্ছ বোমারু বিমান হারিয়ে রীতিমতো বেকায়দায় পড়েন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তদন্তে জানা যায়, টিইউ-৯৫এমএস এবং টিউ-২২এম৩-এর মতো কৌশলগত বোমারু বিমানগুলিকে ওড়াতে ‘কোয়াডকপ্টার’ ড্রোন ব্যবহার করেছে কিভের গুপ্তচরেরা। চোরাপথে বিভিন্ন রাস্তা ধরে সেগুলিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের কাছে পৌঁছে দেয় পাঁচটি ট্রাক। এর পর রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বায়ুসেনা ছাউনিতে হামলা চালায় ইউক্রেনীয় সেনা।

১১ ১৭

এ-হেন সফল অভিযানের পর রুশ বোমারু বিমানের অন্তত এক-তৃতীয়াংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করে কিভ। হামলার মূল চক্রী দীর্ঘ দিন ধরে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে থাকছিলেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারে মস্কো। শুধু তা-ই নয়, নিজের বাড়িতেই চোরাচালানের মাধ্যমে হাতে পাওয়া যন্ত্রাংশ জুড়ে ড্রোন তৈরির কারখানা খুলেছিলেন তিনি। যদিও কিভের ওই এজেন্টের কোনও হদিস পায়নি ক্রেমলিনের গোয়েন্দাবাহিনী।

১২ ১৭

গত বছরের সেপ্টেম্বরে পর পর পেজার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লেবানন। একই ধরনের ঘটনা ঘটে সিরিয়াতেও। এতে প্রাণ হারান বেশ কয়েক জন। আহতের সংখ্যা ছাপিয়ে যায় চার হাজার। পেজার হামলার জন্য ইজ়রায়েলকে কাঠগড়ায় তোলে ইরান মদতপুষ্ট লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা। মূলত, তাদের যোদ্ধা, কমান্ডার এবং শীর্ষ নেতৃত্ব যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোনের বিকল্প হিসাবে ওই যন্ত্র ব্যবহার করছিলেন।

১৩ ১৭

জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির অত্যন্ত পছন্দের এই পেজারের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এর অবস্থান বোঝা খুব কঠিন। দ্বিতীয়ত, যন্ত্রটিকে হাতে বা পকেটে নিয়ে দিব্যি ঘোরা যায়। পেজার বিস্ফোরণের পর প্রকাশ্যে আসে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য। জানা যায়, তাইওয়ান থেকে অন্তত পাঁচ হাজার পেজার আনিয়েছিল হিজ়বুল্লা। সেগুলিকেই নাশকতার জন্য ব্যবহার করেছে মোসাদ।

১৪ ১৭

লেবাননের নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানায়, পেজারগুলিতে একই সময়ে একটি বিশেষ সাঙ্কেতিক বার্তা পাঠানো হয়েছিল। আর সেই মেসেজ খুলতেই ডিভাইসগুলিতে পর পর বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। সংশ্লিষ্ট পেজারগুলি অন্তত পাঁচ মাস আগে হাতে পেয়েছিল হিজ়বুল্লা। এই ঘটনায় মৃত্যু হয় এক কিশোরীর। তবে মোট মৃতের সংখ্যা স্পষ্ট করে জানায়নি বেইরুট।

১৫ ১৭

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘পেজারের ভিতরে যে যান্ত্রিক বোর্ড মেসেজ গ্রহণের কাজে ব্যবহৃত হয়, সেখানে বিস্ফোরক ভরেছিল মোসাদ। ফলে সেগুলিকে কোনও ভাবেই শনাক্ত করা যায়নি। এমনকি, কোনও স্ক্যানার দিয়েও ওই বিস্ফোরক চিহ্নিত করা যেত না। আর তাই নাশকতা আটকানো যায়নি।’’

১৬ ১৭

তাইওয়ানের বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘গোল্ড অ্যাপোলো’কে পেজারগুলি বানানোর বরাত দিয়েছিল হিজ়বুল্লা। গত বছরের এপ্রিল-মে নাগাদ যন্ত্রগুলি হাতে পায় ইরানের মদতপুষ্ট ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী। যে পেজারগুলি লেবাননে পাঠানো হয়েছিল তার মডেলটির নাম ‘এপি৯২৪’। হামলার পর হিজ়বুল্লার শীর্ষকর্তারা বলেন, ‘‘বিশেষ ধরনের উচ্চ বিস্ফোরক পদার্থ পেজারের ব্যাটারিতে ভরে দিয়েছিল মোসাদ। দূর থেকে ব্যাটারির তাপমাত্রা বাড়িয়ে যন্ত্রগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটায় তারা।’’

১৭ ১৭

এই ধরনের পেজার বা ড্রোন আক্রমণকে ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’-এর নাম দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, এগুলির জেরে ২১ শতকের যুদ্ধ অনেক বেশি প্রাণঘাতী হয়েছে। পাশাপাশি, সংঘর্ষ চলাকালীন খুব কম খরচে কী ভাবে শত্রুর গড়ে ঢুকে বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি করা যায়, সেই নমুনা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে ইজ়রায়েল এবং ইউক্রেনের গুপ্তচরবাহিনী।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement