MiG-21 Farewell

ঢাকার গভর্নর হাউসে বোমাবর্ষণ থেকে মার্কিন জেট ধ্বংস! অবসরে সাফল্যের স্মৃতিতে মজে ভারতের গর্বের মিগ-২১

ছ’দশকের বর্ণময় কর্মজীবন শেষ করে অবশেষে অবসর নিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর মিগ-২১ লড়াকু জেট। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির ঝুলিতে রয়েছে একাধিক সাফল্যের কাহিনি।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:০১
Share:
০১ ২০

৬২ বছরের বর্ণময় জীবন। কী নেই তাতে! হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় বোমাবর্ষণ থেকে শুরু করে মাঝ-আকাশে মার্কিন লড়াকু জেট এফ-১৬ উড়িয়ে দেওয়া। সাফল্যের সঙ্গে যাবতীয় অভিযান শেষ করে অবশেষে অবসর নিচ্ছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর গর্বের মিগ-২১ যুদ্ধবিমান। বিদায়বেলায় বার বার ঘুরে ফিরে আসছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) তৈরি সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির সাফল্যের কাহিনি, যাকে রূপকথা বললে অত্যুক্তি হবে না।

০২ ২০

চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর চণ্ডীগড় ছাউনিতে ‘উড়ন্ত কফিন’ তকমা পাওয়া মিগ-২১কে বিদায় সম্বর্ধনা জানাল ভারতীয় বায়ুসেনা। কয়েক দিন আগেই শেষ বার সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি নিয়ে আকাশে ওড়েন এ দেশের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল অমরপ্রীত সিংহ। ককপিট থেকে নেমে আসার পর আবেগঘন ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে এ দেশের বায়ুসেনায় অন্তর্ভুক্ত হয় ‘সুপারসনিক’ (শব্দের চেয়ে গতিশীল) জেট মিগ-২১।

Advertisement
০৩ ২০

এ দেশের বিমানবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার মাত্র দু’বছরের মধ্যে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান বায়ুসেনার মুখোমুখি হয় মস্কোর তৈরি এই যুদ্ধবিমান। ওই সময়ে ভারতের লড়াকু পাইলটদের মিগ-২১ প্রশিক্ষণ ছিল অসম্পূর্ণ। কিন্তু তার পরেও দেশের আকাশকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সাবেক সোভিয়েতের তৈরি যুদ্ধবিমান। বহু ক্ষেত্রে মাঝ-আকাশের ডগফাইটে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীকে যথেষ্ট বিপদে ফেলে মিগ-২১।

০৪ ২০

১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে নিজের জাত চিনিয়ে দেয় মিগ-২১। মস্কোর ‘সুপারসনিক’ জেটটিকে নিয়ে একাধিক বার পাকিস্তানে ঢুকে বোমাবর্ষণ করে ভারতের যোদ্ধা পাইলটবাহিনী। মাঝ-আকাশের ডগফাইটেও তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি ইসলামাবাদের বায়ুসেনা। লড়াই চলাকালীন রাওয়ালপিন্ডির হাতে থাকা চারটি এফ-১০৪ স্টার ফাইটার, দু’টি শেনিয়াং এফ-৬ এবং একটি এফ-৮৬ সাবের যুদ্ধবিমানকে উড়িয়ে দেয় নয়াদিল্লির মিগ-২১।

০৫ ২০

পাক বিমানবাহিনীর এই সমস্ত জেটই ছিল আমেরিকার তৈরি। সংঘাত পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ভাবে ওই ক্ষয়ক্ষতি মানতে চায়নি ইসলামাবাদ। পরে অবশ্য বিবৃতি দিয়ে দু’টি এফ-১০৪ স্টার ফাইটার ধ্বংসের কথা স্বীকার করে নেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। পাশাপাশি, ভারতের মিগ-২১ হামলায় একটি সি-১৩০ হারকিউলিস মালবাহী সামরিক উড়োজাহাজও হারায় পাকিস্তান। সংশ্লিষ্ট বিমানটির নির্মাণকারী দেশও ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

০৬ ২০

ভারতীয় উপমহাদেশে মিগ-২১ই ছিল প্রথম লড়াকু জেট যেটির হাতে এফ-১০৪ স্টার ফাইটারের মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের ‘মৃত্যু’ প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। মাঝ-আকাশের লড়াইয়ে নিজেদের অজেয় করে তুলতে বিশেষ ধরনের একটি কামান নিয়ে উড়তে পারত ওই রুশ যুদ্ধবিমান। শত্রুর লড়াকু জেট ধ্বংসে এর ক্ষমতা ছিল প্রশ্নাতীত। মিগ-২১-এর কামানটির পোশাকি নাম জিএসএইচ-২৩ রেখেছিলেন রুশ প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।

০৭ ২০

গতির পাশাপাশি মিগ-২১-এর সবচেয়ে বড় মুনশিয়ানা ছিল মাঝ-আকাশে ডিগবাজি খাওয়ার ক্ষমতা। গভীর রাতে কম উচ্চতায় আচমকা উড়ে এসে আক্রমণ শানাতে পারত সাবেক সোভিয়েতের তৈরি এই লড়াকু জেট। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় এর আতঙ্কে এফ-১০৪ স্টার ফাইটারগুলিকে তড়িঘড়ি লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। সংঘর্ষ চলাকালীন সেগুলি দিয়ে আর সে ভাবে প্রত্যাঘাত শানাতে পারেনি ইসলামাবাদ। ফলে রাতারাতি লড়াইয়ের পাল্লা ঘুরে যায় ভারতের দিকে।

০৮ ২০

বাংলাদেশ যুদ্ধে মিগ-২১-এর আরও একটি সাফল্য রয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালীন অমৃতসর ছাউনি থেকে উড়ে গিয়ে ঢাকার গভর্নর হাউসে ৫০০ কেজি ওজনের বোমা ফেলে ওই লড়াকু জেট। তৎকালীন সময়ে এতটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে শত্রুর দেশে হামলা করা ছিল যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু রুশ যুদ্ধবিমানটির সাহায্যে সেই অসাধ্যসাধন করে ফেলেন এ দেশের যোদ্ধা পাইলটেরা।

০৯ ২০

১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে ফের এক বার অংশ নেয় মিগ-২১। সে বার হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় ভারতীয় সেনার একাধিক পোস্ট ছিল পাক ফৌজের ‘নর্দার্ন লাইট ইনফ্যান্ট্রি’র দখলে। পাহাড়ের উপরে সুবিধাজনক জায়গায় থাকার কারণে অনায়াসে এ দেশের বাহিনীর উপর হামলা চালাতে পারছিল তারা। সংশ্লিষ্ট সেনা অভিযানের নাম ‘অপারেশন বদর’ রেখেছিলেন ইসলামাবাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট তথা তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ় মুশারফ।

১০ ২০

কার্গিলের লড়াইয়ে প্রথম দিকে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে ব্যবহারের কোনও পরিকল্পনা করেনি কেন্দ্র। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বুঝতে পেরে ডাকা হয় তাদের। প্রায় দেড় মাস ধরে চলা সংঘর্ষে মিগ-২১-এর পাশাপাশি ফ্রান্সের তৈরি মিরাজ-২০০০ লড়াকু জেট এবং একাধিক হামলাকারী হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বায়ুসেনা। পাক ফৌজের নিশানার বাইরে থাকতে ওই সময় অস্বাভাবিক উচ্চতায় রুশ যুদ্ধবিমানকে নিয়ে গিয়েছিলেন এ দেশের নয়াদিল্লির পাইলটেরা।

১১ ২০

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভেয় ফিদায়েঁ হামলা চালায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ। এতে প্রাণ হারান ৪০ জন জওয়ান। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ইসালামাবাদের আকাশসীমায় ঢুকে খাইবার-পাখতুনখোয়ার বালাকোটে সন্ত্রাসবাদীদের গুপ্তঘাঁটিতে ‘এয়ার স্ট্রাইক’ করে ভারতীয় বায়ুসেনা। এর পরই প্রত্যাঘাতের মরিয়া চেষ্টা চালায় রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর।

১২ ২০

বালাকোটে বিমান হামলার কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতের আকাশসীমায় ঢোকার চেষ্টা করে বেশ কয়েকটি পাক লড়াকু জেট। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীনগর বায়ুসেনা ছাউনি থেকে তাদের তাড়া করে দু’টি মিগ-২১। এর একটির ককপিটে ছিলেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান। মাঝ-আকাশেই ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীর একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামান তিনি। যদিও তার পর পাকিস্তানের হামলায় ধ্বংস হয় তাঁর নিজের জেটও।

১৩ ২০

মিগ-২১ ধ্বংস হলেও প্রাণে বেঁচে যান অভিনন্দন। লড়াকু জেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা পিওকেতে (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর) গিয়ে পড়েন তিনি। সেখানে তাঁকে গ্রেফতার করে ইসলামাবাদের ফৌজ। যদিও ৬০ ঘণ্টার বেশি অভিনন্দনকে ধরে রাখতে পারেননি রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। ভারতের চাপে দ্রুত তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকার।

১৪ ২০

এই ঘটনার পর মিগ-২১কে নিয়ে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে গিয়েছিল। ধারে ও ভারে অনেক এগিয়ে থাকা এফ-১৬র মতো মার্কিন লড়াকু জেটকে বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখিয়ে কী ভাবে রুশ যুদ্ধবিমানটি ধ্বংস করল, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে যায়। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে কোরীয় যুদ্ধে প্রথম বার অংশ নিয়ে নিজের ‘গেম চেঞ্জার’ ছবি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল মিগ-২১।

১৫ ২০

পরবর্তী কালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের হিসাব পাল্টে দিতে বড় ভূমিকা নেয় মিগ-২১ লড়াকু জেট। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাওয়া ভিয়েতনামি যোদ্ধাদের সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটি সরবরাহের মাধ্যমে সাহায্য করে উত্তর কোরিয়া। এতে তাদের শক্তি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এর জন্য ভিয়েতনামের লড়াইয়ে অংশ নেন পিয়ংইয়ঙের ৮৭ থেকে ৯৬ জন যোদ্ধা পাইলট। তাঁদের হাতে ধ্বংস হয় ২৬টির কাছাকাছি মার্কিন যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া আরও ১৪টির বড় ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিল মিগ-২১।

১৬ ২০

এ-হেন রুশ যুদ্ধবিমানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি চুরির গল্পও। ১৯৬৬ সালে ইরাক থেকে মিগ-২১ উড়িয়ে ইজ়রায়েলে নিয়ে আসেন বাগদাদ বায়ুসেনার পদস্থ অফিসার মুনির রেদফা। ইহুদিদের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ সংশ্লিষ্ট জেটটির বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে চেয়েছিল। সেই কারণেই টাকার লোভ দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত রেদফাকে কাজে লাগায় তারা। এই অভিযানের কোড নাম ছিল ‘অপারেশন ডায়মন্ড’। টানা তিন বছর ধরে অপারেশন চালিয়ে তাতে সাফল্য পায় তেল আভিভ।

১৭ ২০

এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সর্বাধিক নির্মিত ফাইটার জেটের শিরোপা রয়েছে মিগ-২১-এর মুকুটে। সেই সংখ্যাটা হল ১১ হাজার ৪৯৬। তবে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির সব ক’টি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মাটিতে তৈরি হয়েছে এমনটা নয়। মস্কোর থেকে মোট ৮৭৪টি মিগ-২১ কেনে ভারত। এর মধ্যে ক্রেমলিনের প্রযুক্তিগত সহায়তার ৬৫৭টি ঘরের মাটিতেই তৈরি করেছিল প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যাল। একই ভাবে সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায় (বর্তমানে যা চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া) তৈরি হয় ১৯৪টি মিগ-২১।

১৮ ২০

২০০০ সালে মিগ ২১-এর আধুনিকীকরণ করে ভারত। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন) এবং হ্যালের সহায়তায় তৈরি হয় ‘বাইসন’ মডেল, যার ককপিটে বসার অনুমতি পেয়েছেন এ দেশের মহিলা যোদ্ধারাও। রুশ যুদ্ধবিমানটিকে শেষ বার আকাশে নিয়ে যাওয়া মহিলা পাইলট হলেন স্কোয়াড্রন লিডার প্রিয়া শর্মা। মিগ-২১-এর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন তিনি।

১৯ ২০

এত সাফল্য সত্ত্বেও ৭০-র দশকের পর থেকে ঘন ঘন দুর্ঘটনার কবলে পড়ার জেরে ‘উড়ন্ত কফিন’ তকমা সেঁটে যায় সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানের গায়ে। এর জেরে এখনও পর্যন্ত ১৭০ জন পাইলটকে হারিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। ২০২২ সালে রাজস্থানে বাড়মেরে একসঙ্গে ভেঙে পড়ে দু’টি মিগ-২১। এর পরই সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটিকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।

২০ ২০

মিগ-২১-এর দুর্ঘটনার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। তার মধ্যে অন্যতম হল লড়াকু জেটটির বয়স। এ ছাড়া রয়েছে পাখির ধাক্কা বা পাইলটের ভুল সিদ্ধান্ত। মিগ-২১ অবসর নেওয়ায় উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমছে এ দেশের যুদ্ধবিমানের বহর। সেই সংখ্যা পূরণ করতে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি তেজ়স লড়াকু জেটের বিপুল বরাত হ্যালকে দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement