কখনও ক্ষেপণাস্ত্র-লড়াকু জেট-কামান-বন্দুকের গর্জন। কখনও আবার শুল্ক-সংঘাতে অর্থনীতির ফালা ফালা হয়ে যাওয়া। কিংবা সমুদ্রসৈকতে উৎসব চলাকালীন নিরীহ ইহুদিদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি! স্বজন হারানোর কান্না, হিংসা আর হানাহানিকে সঙ্গী করেই বিদায় নিচ্ছে আরও একটা বছর। ফেলে দেওয়া ক্যালেন্ডারের লাল দাগের তারিখ হয়ে থাকবে কোন কোন দিন, ইতিহাসের মোড় ঘোরানো কী কী ঘটনার সাক্ষী থাকল ২০২৫, বর্ষশেষে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে দেখল আনন্দবাজার ডট কম।
ঝকঝকে সকালের মতো বিদায়ী বছরের শুরুটা ছিল চমৎকার। ২০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন রিপাবলিকান পার্টির বর্ষীয়ান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় বারের জন্য কুর্সি পান তিনি। ট্রাম্পের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার দু’দিনের মধ্যেই মোট ২২০টা একজ়িকিউটিভ অর্ডারে সই করেন ‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস), যা ছিল নজির।
ট্রাম্পের শপথের দিনেই (২০ জানুয়ারি, ২০২৫) নতুন ‘ওপেন সোর্স রিজ়নিং মডেল’ বা বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি চালু করে চিনা সংস্থা ‘ডিপসিক’। এর নাম ছিল ‘ডিপসিক-আর১’। সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিটি বাজারে আসতেই মার্কিন শেয়ার বাজারে নামে ধস। হু-হু করে সম্পদ হারাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় টেক জায়ান্ট সংস্থা। বেজিঙের কৃত্রিম মেধাভিত্তিক প্রযুক্তিটির সঙ্গে আমেরিকার ‘ওপেনএআই’-এর তৈরি বহুল ব্যবহৃত ‘চ্যাটজিপিটি’র বেশ মিল রয়েছে। ফলে ড্রাগনের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি নকলের অভিযোগ তোলে ওয়াশিংটন।
কুর্সিতে বসেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেন ট্রাম্প। ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। সেখানে পূর্ব ইউরোপের সংঘর্ষের জন্য কিভকেই দায়ী করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। গণমাধ্যমের সামনে বেনজির ভাবে প্রবল তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন দুই রাষ্ট্রনেতা। ওই সময় জ়েলেনস্কিকে একরকম হোয়াইট হাউস থেকে তাড়িয়ে দেন ট্রাম্প। কাটছাঁট করেন কিভকে দেওয়া সামরিক সাহায্য।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দেশবাসীর উদ্দেশে ভার্চুয়ালি ভাষণ দেন তিনি। তার পরই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তাঁর বিরোধীরা। ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। আরও একাধিক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে হিংসা। বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের বাড়িতে হামলা চালান হাসিনা-বিরোধীরা।
গত ২ এপ্রিল ‘ছাড়যুক্ত পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি ঘোষণা করেন ট্রাম্প। দিনটিকে ‘মুক্তি দিবস’ (লিবারেশন ডে) বলেও উল্লেখ করেন তিনি। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, আমেরিকার বাজারে ভারতীয় পণ্যে চাপে ২৬ শতাংশ শুল্ক। শুধু তা-ই নয়, দেখা যায়, বেছে বেছে আমেরিকার ‘বন্ধু’ দেশগুলির উপর বেশি পরিমাণে শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মজার বিষয় হল, ওই সময় জনমানবহীন অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত হার্ড অ্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপপুঞ্জের উপরেও ১০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। সেখানকার একমাত্র বাসিন্দা পেঙ্গুইন হওয়ায় সমাজমাধ্যমে শুরু হয় ট্রোলিং।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ-হেন ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি মেনে নেয়নি চিন। ফলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যযুদ্ধে নেমে পড়ে বেজিং। যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে ওই সময় ভারতকে নিয়ে একাধিক ইতিবাচক মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছিল ড্রাগনকে। তার মধ্যেই নিলাম ডাকার মতো করে একে অপরের পণ্যে শুল্কের মাত্রা বাড়াতে থাকে ওয়াশিংটন ও বেজিং। পরবর্তী সময়ে আমেরিকাকে বিরল খনিজের সরবরাহ বন্ধ করে মান্দারিনভাষী সরকার। ট্রাম্পের হুমকিতেও এ ব্যাপারে কোনও কাজ হয়নি।
২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাকিস্তান মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় নিরীহ পর্যটক-সহ মৃত্যু হয় ২৬ জনের। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ৭ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে ভারতীয় ফৌজ। প্রথমে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশের একাধিক জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় এ দেশের বিমানবাহিনী। পরে এই নিয়ে আগ্রাসী মনোভাব দেখালে ইসলামাবাদের একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটিতে আছড়ে পড়ে নয়াদিল্লির ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে ১০ মে ভারতীয় সেনার সঙ্গে কথা বলে সংঘর্ষবিরতি করেন রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা।
ভারত-পাক সংঘর্ষবিরতি হতেই নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তুলে ধরে এই নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিবৃতি দিতে শুরু করেন ট্রাম্প। বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় দুই প্রতিবেশীর মধ্যে পরমাণু যুদ্ধ ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি। যদিও তার ওই দাবি খারিজ করে দেয় নয়াদিল্লি। এই নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও বিশ্বনেতা অপারেশন সিঁদুর থামাতে বলেননি। পাকিস্তানের কাতর অনুরোধেই লড়াই থামাতে রাজি হয় ভারত।’’
অন্য দিকে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ মার খাওয়া সত্ত্বেও পদোন্নতি হয় পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের। ২০ মে তাঁকে ফিল্ড মার্শাল করে দেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জ়ারদারি। এর পর ঘন ঘন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন মুনির। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়েই ভারতে পরমাণু হামলার হুমকি দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে আর্থিক সাহায্য পেতে থাকে দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান।
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন জানান ধনকুবের মার্কিন শিল্পপতি ইলন মাস্ক। ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে মাস্ককে নিজের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্য করে নেন ‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস)। তাঁর জন্য তৈরি হয় ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ বা ডজ নামের সম্পূর্ণ নতুন এবং পৃথক একটি দফতর। এর মূল কাজ ছিল প্রশাসনের ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ কাটছাঁট এবং অর্থনৈতিক সাশ্রয়। কিন্তু হঠাৎই সেখান থেকে পদত্যাগ করেন মাস্ক।
মে মাসের শেষের দিকে জনস্বার্থে একটি বিলে স্বাক্ষর করেন ট্রাম্প। নিজে সেটিকে ব্যাখ্যা করেন ‘বড় ও সুন্দর বিল’ হিসাবে। কিন্তু ওই আইনকে কেন্দ্র করেই মাস্কের সঙ্গে শুরু হয় তাঁর তিক্ততা। ট্রাম্পের ওই বিলের ফলে এত দিন ধরে ডজ যে কাজ করে এসেছে, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। ডজ থেকে পদত্যাগের পর ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েন মাস্ক। এর পর আরও এক ধাপ এগিয়ে যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত জেফ্রি এপস্টাইনের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে দাবি করেন মাস্ক। ইমপিচমেন্ট পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে তোলেন ট্রাম্পের অপসারণের দাবি। পাল্টা মাস্কের সংস্থার ভর্তুকি বাতিলের হুঁশিয়ারি দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ‘আমেরিকা পার্টি’ নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেন টেসলা-কর্তা।
গত ১ জুন রুশ ভূখণ্ডের ৫০০ থেকে ৪৫০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে একাধিক বিমানঘাঁটিতে নিখুঁত নিশানায় ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। এতে ধ্বংস হয় মস্কোর ৪০টির বেশি সামরিক বিমান। এর মধ্যে ছিল বেশ কয়েকটি অতি শক্তিশালী বোমারু বিমানও। হামলার পর গভীর রাতে এর রণকৌশল ফাঁস করেন খোদ ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। কিভের এই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘স্পাইডার ওয়েব’।
গত ১৩ জুন ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিতে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী হামলা চালালে পশ্চিম এশিয়ায় শিয়া ও ইহুদি ফৌজের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। তবে তা মাত্র ১২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ইহুদিরা সাবেক পারস্য মুলুকে তাদের অভিযানের নাম রাখে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’। পাল্টা প্রত্যাঘাত শানানো তেহরানের অভিযান পরিচিতি পায় ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ় থ্রি’ নামে। সংশ্লিষ্ট লড়াই চলাকালীন শিয়া সেনার একাধিক শীর্ষ কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীকে নিকেশ করে ইহুদি বায়ুসেনা। পাল্টা হাইপারসনিক (শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্রে ইহুদিদের একাধিক শহরকে নিশানা করে তেহরান। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেও সেগুলিকে আটকাতে পারেনি তেল আভিভ।
গত ২২ জুন ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতে ইহুদিদের পক্ষ নিয়ে আসরে নামে আমেরিকা। তেহরানের ফোরডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহান পরমাণুকেন্দ্রে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে মার্কিন বায়ুসেনা। এই অভিযানের পোশাকি নাম ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ রাখে ওয়াশিংটন। এর পরই ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয় দু’পক্ষ।
গত ৩০ জুলাই নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ নয়াদিল্লি ও মস্কোকে নিশানা করে একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। ওরা ওদের ‘মৃত অর্থনীতি’কে একসঙ্গে ধ্বংস করতে পারে। আমি সব কিছুর জন্য চিন্তা করি। আমরা ভারতের সঙ্গে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, নয়াদিল্লির শুল্ক অনেক বেশি। একে বিশ্বের সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে প্রায় কোনও ব্যবসা নেই বললেই চলে।’’ তাঁর এই পোস্টের পরেই শুরু হয় হইচই।
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প। আলাস্কায় বৈঠকে বসেন দুই নেতা। যদিও সেখানে সমাধানসূত্র বার হয়নি। পুতিনের আলাস্কা সফরের আগেই ভারতের বিরুদ্ধে এক অদ্ভুত অভিযোগ তোলেন ট্রাম্প। বলেন, মস্কোর থেকে সস্তা দরে নয়াদিল্লি খনিজ তেল কেনার কারণেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অর্থ হাতে পাচ্ছে রাশিয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। যদিও কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই এ দেশের পণ্যে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। ফলে আমেরিকার বাজারে ভারতীয় সামগ্রীর উপর মোট শুল্কের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ।
অগস্টের শেষের দিকে একগুচ্ছ রণতরী ও পরমাণু ডুবোজাহাজে ক্যারিবিয়ান সাগর তীরবর্তী দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজ়ুয়েলাকে ঘিরে ফেলে আমেরিকার নৌবাহিনী। পাল্টা বিস্তীর্ণ উপকূল জুড়ে সমরসজ্জা শুরু করে দেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ট্রাম্পের অভিযোগ, কারাকাসে মাদক মাফিয়াদের যথেষ্ট দাপাদাপি রয়েছে। চোরাপথে সেই মাদক ঢুকছে যুক্তরাষ্ট্রে। অগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ক্যারিবিয়ান সাগরে ভেনেজ়ুয়েলার একাধিক নৌকা উড়িয়ে দেয় ওয়াশিংটনের নৌসেনা। সেগুলিতে মাদক পাচার হচ্ছিল বলে অভিযোগ। এতে মৃত্যু হয় বেশ কয়েক জনের।
৮ সেপ্টেম্বর ছাত্র-যুবদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, এক্স-সহ ২৬টি সমাজমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে হিমালয়ের কোলের দেশটির সরকার। প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই খেপে ওঠে সেখানকার জেন জ়ি। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেন তাঁরা। পুলিশের ছোড়া গুলিতে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। ৯ সেপ্টেম্বর ইস্তফা দেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ওঠে দুর্নীতির একগুচ্ছ অভিযোগ। ওলি সরকারের পতনের পর হিমালয়ের কোলের দেশটিতে তৈরি হয় অন্তর্বর্তিকালীন সরকার। প্রধান হিসাবে শপথ নেন সেখানকার সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি।
১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের সঙ্গে ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ সেরে ফেলে পাকিস্তান। সেখানে বলা হয়, এই দুইয়ের মধ্যে কোনও একটি দেশ তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত বা আগ্রাসনের শিকার হলে, তাকে উভয় দেশের উপর আঘাত বা যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। তবে কি আগামী দিনে রিয়াধকে পরমাণু হাতিয়ারের সুরক্ষা দেবে ইসলামাবাদ? পাক সরকারের দিক থেকে এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তালিবানশাসিত আফগানিস্তান নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর কথায়, ‘‘বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আমেরিকার স্বার্থের জন্য খুবই জরুরি।’’ ট্রাম্পের পাশেই ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। ফলে ওয়াশিংটনের ‘অপারেশন বাগরাম’-এ ইংরেজ সামরিক শক্তি শামিল হবে কি না, তা নিয়ে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়ে আফগানিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের শীর্ষ আধিকারিক জ়াকির জালাল বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনও ধরনের সহযোগিতামূলক আলোচনাকে স্বাগত জানাবে কাবুল। সেটা যে কোনও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হতে পারে। কিন্তু মার্কিন সৈন্যকে কোনও মতেই দেশের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’’
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ফিদায়েঁ হামলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে বেধে যায় সীমান্ত সংঘর্ষ। হিন্দুকুশের কোলের দেশটির পাকতিকা, কন্দহর এবং স্পিন বোডাক এলাকায় একে অপরকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় দু’পক্ষের ফৌজ। টিটিপির গুপ্তঘাঁটি ওড়ানোর নামে পশ্চিমের প্রতিবেশীর একাধিক জায়গায় বোমাবর্ষণ করে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনী। পরে অবশ্য তুরস্ক ও কাতারের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয় দু’পক্ষ।
অক্টোবরে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ভেনেজ়ুয়েলার বিরোধী দলনেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো। এটি পাওয়ার ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী ছিলেন ট্রাম্প। ২০২৫ সালে মোট সাতটি যুদ্ধ থামিয়েছেন বলে বার বার দাবি করেন তিনি। কিন্তু তার পরও নোবেল শান্তি পুরস্কার অধরাই থেকে গিয়েছে তাঁর। নাম ঘোষণার পর প্রথম প্রক্রিয়ায় মাচাদো সেই ট্রাম্পকেই উৎসর্গ করে দেন নোবেল শান্তি পুরস্কার।
এ বছরের জুলাইয়ে বিতর্কিত ‘পান্না ত্রিভুজ’কে কেন্দ্র করে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া। কিছু দিন চলার পর বন্ধ হয় সেই যুদ্ধ। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফের দু’পক্ষে শুরু হয় গোলাবর্ষণ। ব্যাঙ্কক-নম পেনের মধ্যে লড়াই থামাতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন ট্রাম্প। নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ায় ‘বিরক্ত’ হন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজান এবং রোয়ান্ডা ও ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর মধ্যেও দীর্ঘ দিন ধরে চলা যুদ্ধ থামিয়েছেন তিনি।
৩০ অক্টোবর দক্ষিণ কোরিয়ার (রিপাবলিক অফ কোরিয়া) বুসানে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন ট্রাম্প। সেখান থেকে বেরিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানান বেজিঙের উপর ধার্য হওয়া শুল্ক কমাবে আমেরিকা। শুধু তা-ই নয়, বিরল খনিজ সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। যদিও এ ব্যাপারে কোনও উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেয়নি ড্রাগন।
অক্টোবরে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় মিশরের সম্মেলনে গাজ়া শান্তিচুক্তিতে সই করে বেশ কয়েকটি দেশ। সেখানে অবশ্য ছিল না যুযুধান ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের কোনও প্রতিনিধি। শান্তিচুক্তি হওয়ার পরেও গাজ়ায় বোমাবর্ষণ চালিয়ে যায় ইহুদি বিমানবাহিনী। ডিসেম্বরে গাজ়ার ‘হলুদ রেখা’ পর্যন্ত সীমান্ত বিস্তার করার কথা জানিয়ে দেন ইজ়রায়েলি সেনাপ্রধান। ফলে তা নিয়ে নতুন করে তৈরি হয় জটিলতা।
গত ৭ নভেম্বর সাবেক ফরমোজ়া তথা দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে (পড়ুন রিপাবলিক অফ চায়না) নিয়ে বিবৃতি দেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। সংশ্লিষ্ট দেশটিকে চিন কব্জা করতে চাইলে টোকিয়ো যে চুপ করে বসে থাকবে না, তা স্পষ্ট করে দেন তিনি। প্রয়োজনে তাইওয়ানকে সামরিক সাহায্যের কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। সামুরাই প্রধানমন্ত্রীর এ-হেন মন্তব্যের পরই পারদ চড়ায় বেজিং। উপকূলরক্ষী বাহিনীর রণতরীতে ঘিরে ফেলে তাঁদের সেনকাকু দ্বীপ। এতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় জটিল হয় পরিস্থিতি।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জেলবন্দি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ডিসেম্বরের গোড়ায় আদিয়ালা জেলের সামনে অবস্থানে বসেন ইমরানের বোনেরা। ইমরানের দলের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ দেখালে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় পশ্চিমের প্রতিবেশীর একাধিক এলাকা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই জাপানের উপর ‘আগ্রাসী’ মনোভাব দেখায় চিনের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনী। টোকিয়োর দাবি, ওকিনাওয়া দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে লিয়াওনিং নামের একটি বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করে বেজিং। ৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে জে-১৫ লড়াকু জেট উড়ে এসে টোকিয়ো বায়ুসেনার একটি এফ-১৫ যুদ্ধবিমানকে রেডার-লক করে ফেলে। ফলে জেটটির উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত কোনও বিপদ ঘটেনি।
নভেম্বরে সংবিধান সংশোধন করে ফিল্ড মার্শাল মুনিরের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে পাকিস্তান। ডিসেম্বরের গোড়াতেই দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্সেস (সিডিএফ) হিসাবে নিয়োগ পান তিনি। এর ফলে মুনিরের হাতে দেশের পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চাবিও তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। এ ছাড়া বায়ুসেনাপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জহির আহমদ বাবর সিধুর মেয়াদও দু’বছর বাড়ানোর প্রস্তাবে অনুমোদন দেন প্রেসিডেন্ট জ়ারদারি।
১৪ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের ভিড়ে ঠাসা বন্ডি সমুদ্রসৈকতে ইহুদিদের হানুকা উৎসবে হামলা চালায় দুই সন্ত্রাসবাদী। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৫ জনকে খুন করে তারা। পরে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় এক জঙ্গির। বন্দুকবাজেরা সম্পর্কে ছিল পিতা ও পুত্র। তাদের নাম সাজিদ আক্রম (৫০) এবং নবিদ। এদের মধ্যে এনকাউন্টারে প্রাণ হারায় প্রথম জন। নাবিদকে গ্রেফতার করে স্থানীয় প্রশাসন। হামলার সময় সৈকতে থাকা এক ফলবিক্রেতা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে কেড়ে নেন আগ্নেয়াস্ত্র। তাতে অবশ্য গুরুতর জখম হন তিনি। সেই ভিডিয়ো ভাইরাল হয় সমাজমাধ্যমে।
গত বছর বাংলাদেশের গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে তাঁকে গুলি করে পালায় এক দুষ্কৃতী। গুরুতর আহত হাদিকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছিল মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। হাদির মৃত্যুর খবর আসতেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখে পড়ে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকা-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাণ্ডব চলে। দেওয়া হয় ভারতবিরোধী স্লোগানও।