ফের গুপ্তঘাঁটিতে হানা দিয়ে শত্রুসংহার। এক ঝটকায় নিকেশ প্রধানমন্ত্রী-সহ তাঁর ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর প্রায় সমস্ত সদস্য। ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার চরম আঘাতে ইরান মদতপুষ্ট ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথিদের ধড়-মুড়ো আলাদা হওয়ার জোগাড়! অন্য দিকে, ইহুদিদের এই সাফল্যের পর আবারও খবরের শিরোনামে চলে এসেছে তাঁদের গুপ্তচরবাহিনী ‘মোসাদ’। কী ভাবে লোহিত সাগরে দাপিয়ে বেড়ানো হুথিদের কোমর ভাঙল তারা? ইতিমধ্যেই সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে লেগে পড়েছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ২৮ অগস্ট ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ‘এয়ার স্ট্রাইক’ চালায় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। সংশ্লিষ্ট অভিযানের পোশাকি নাম ‘অপারেশন ড্রপ অফ লাক’ রাখে ইহুদি ফৌজ। ভাগ্যদেবী যে এতে তাদের সহায় ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। ‘টাইমস অফ ইজ়রায়েল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই হামলায় মন্ত্রিসভার ১২ জন সদস্যের সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে হুথি প্রধানমন্ত্রী আহমেদ আল-রাহাবির। নিহতের তালিকায় নাম আছে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সেনাপ্রধানেরও।
তেল আভিভের এই দাবি অবশ্য বকলমে স্বীকার করে নিয়েছে ইয়েমেন। পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকটির ‘আল-জুমহুরিয়া’ নিউজ় চ্যানেল এবং রাজধানী সানা থেকে প্রকাশিত ‘আদেন আল-গাদ’ সংবাদপত্রে হুথি প্রধানমন্ত্রী রাহাবির মৃত্যুর খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানের নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেনি তারা। শুধু বলা হয়েছে, ইহুদি বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির তরফে অবশ্য নিহতদের নামের তালিকা প্রকাশ করার কথা রয়েছে।
কী ভাবে হুথি সংগঠনের সব মাথাকে একসঙ্গে নিকেশ করল ইজ়রায়েল? ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে নিশ্চিহ্ন করতে দীর্ঘ দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ‘মোসাদ’। সূত্রের খবর, এর জন্য ইয়েমেনের রাজধানী সানায় একধিক গুপ্তচরকে হুথিদের হাঁড়ির খবর জোগাড় করতে পাঠায় তেল আভিভ। পাশাপাশি, তেহরানের উপরেও কড়া নজর ছিল ইহুদিদের। এর জেরেই মিলেছে সাফল্য।
ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটির একেবারে মাথায় রয়েছেন আব্দুল মালিক আল-হুথি। ইরানের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘শীর্ষনেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন আধাসেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে তাঁর। আব্দুল মালিকের নির্দেশেই যাবতীয় রাজনৈতিক এবং সামরিক কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে হুথি সংগঠন। এ বছরের অগস্টের মাঝামাঝি ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী রাহাবিকে তিনি কিছু নির্দেশ দিতে চলেছেন বলে জানতে পারে ‘মোসাদ’।
এই খবর হাতে পেতেই আরও সক্রিয় হয় ইহুদি গুপ্তচর সংস্থা। এজেন্ট মারফত হুথি প্রধানমন্ত্রীর উপর আরও কড়া নজরদারি শুরু করে তারা। কিছু দিনের মধ্যেই আব্দুল মালিকের ভাষণ শুনতে গোটা মন্ত্রিসভা নিয়ে রাহাবি যে রাজধানী সানা থেকে কিছুটা দূরে একটা বহুতলে যেতে চলেছেন, তা জানতে পারে ‘মোসাদ’। এর পরই ইজ়রায়েলি বায়ুসেনাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের খতম করার নীলনকশা ছকে ফেলেন তেল আভিভের গুপ্তচরেরা।
সূত্রের খবর, হামলার দিন আব্দুল মালিক ভাষণ শুরু করা ইস্তক প্রধানমন্ত্রী রাহাবির গতিবিধির যাবতীয় তথ্য ইহুদি বিমানবাহিনীকে সরবরাহ করে ‘মোসাদ’। ফলে তাঁকে লক্ষ্য করে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার তেমন সমস্যা হয়নি। ‘অপারেশন ড্রপ অফ লাক’কে সফল করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ এবং ‘এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’ লড়াকু জেট ব্যবহার করে তারা। প্রথমটি পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির যুদ্ধবিমান হওয়ায় আকাশে তার গতিবিধি একরকম টেরই পাননি হুথি বিদ্রোহীরা।
এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অভিযানে নিজেদের তৈরি আত্মঘাতী হামলায় পটু ‘হারোপ’ ড্রোন নিয়ে গিয়েছিল ইহুদি বায়ুসেনা। রাহাবির বহুতল চিহ্নিত হওয়ার পর তার উপরে সেগুলিকে চক্কর কাটতে দেখা গিয়েছিল। এর পর যে ঘরে হুথি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ঠিক সেখানেই আছড়ে পড়ে বিস্ফোরকবোঝাই ওই মানববিহীন উড়ুক্কু যান। এককথায় রাহাবির বাঁচার যাবতীয় রাস্তা বন্ধ রেখে অভিযানে নেমেছিল ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী ও ‘মোসাদ’।
ইয়েমেনের গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, হুথিদের গুপ্তঘাঁটিতে হামলার সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে আকাশের দিকে উঠে যায় বিরাট এক অগ্নিগোলক। রাজধানী সানা থেকে সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে মাত্র ১০ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন রাহাবি। কট্টর ইহুদিবিরোধী এই হুথি নেতার লোহিত সাগরের উপরে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ছিল।
তেল আভিভের দাবি, ইজ়রায়েলি বায়ুসেনার আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন হুথি প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুহাম্মদ নাসের আল-আত্তাফি। ২০১৬ সাল থেকে ওই পদে ছিলেন তিনি। ইরানের আইআরজিসি, গাজ়ার প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস এবং লেবাননের শিয়া বিদ্রোহী সংগঠন হিজ়বুল্লার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর। গত দু’বছরে বহু বার ইহুদিভূমিতে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে হুথি বিদ্রোহীরা, যার ‘মূল চক্রী’ হিসাবে নাসের আল-আত্তাফিকেই চিহ্নিত করেন ইজ়রায়েলি গোয়েন্দারা।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট অভিযানে হুথি সেনাপ্রধান (পড়ুন চিফ অফ স্টাফ) মুহাম্মদ আল-ঘামারিকেও ইহুদি বায়ুসেনা নিকেশ করেছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। গত জুনে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ‘মোসাদ’। কিন্তু কোনও মতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সে বারের হামলায় অবশ্য মারাত্মক ভাবে জখম হন আল-ঘামারি। তার পর থেকেই গুপ্তঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন তিনি। অন্য দিকে, হাল ছাড়েনি ইজ়রায়েলি গুপ্তচরেরা। শেষ পর্যন্ত খোঁজ মিলতেই তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করল ইহুদি বিমানবাহিনী।
‘অপারেশন ড্রপ অফ লাক’-এর এক দিনের মাথায় ২৯ অগস্ট এই নিয়ে বিবৃতি দেয় ‘ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ বা আইডিএফ। সেখানে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে ইহুদি ফৌজ। যদিও সে কথা অস্বীকার করেছে হুথি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তাদের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃত ভাবে জনবহুল এলাকায় আক্রমণ শানিয়েছে তেল আভিভের খুনে বিমানবাহিনী। এর জেরে প্রাণ হারিয়েছে ২০ থেকে ২৫ জন সাধারণ ইয়েমেনবাসী।
গত কয়েক দিনে ১৬ বার হুথিদের গুপ্তঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। কোনও ক্ষেত্রেই সে ভাবে সাফল্য পায়নি তাঁরা। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির দাবি, ২৮ অগস্টের আক্রমণের ধরন ছিল আগের সবগুলির চেয়ে অনেকটাই আলাদা। ওই দিন সর্বাধিক আগ্রাসী মনোভাব দেখায় ইহুদি বায়ুসেনা। তা ছাড়া তেল আভিভের যে তাঁদের প্রধানমন্ত্রীকে খতম করার উদ্দেশ্য রয়েছে, তা অবশ্য স্বপ্নেও ভাবেনি ইয়েমেনের ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ শুরু করে গাজ়ার প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইহুদিভূমিতে ঢুকে মারাত্মক হামলা চালায় তাঁরা। হামাসের অতর্কিত আক্রমণে ৮৬০-এর বেশি অসামরিক এবং সাড়ে ৩০০-র বেশি নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু হয়। সিমচাট তোরাহ এলাকায় একটি উৎসবের জায়গায় ঢুকে গণহত্যা চালায় তাঁরা। এ ছাড়া ২৫০-র বেশি ইহুদিকে অপহরণ করে গাজ়ায় নিয়ে যায় হামাস। অপহৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ৩০।
৭ অক্টোবরের এই হামলার পরেই প্যালেস্টাইনপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ওই সময়ে হামাসের পাশে এসে দাঁড়ায় হুথি গোষ্ঠী। ইহুদিভূমি লক্ষ্য করে ক্রমাগত ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তাঁরা। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরের দিক দিয়েও আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছিল ইরান মদতপুষ্ট ইয়েমেনের এই বিদ্রোহী সংগঠন।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) অক্টোবরে ইহুদিদের হয়ে সংঘর্ষে নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হুথিদের গুপ্তঘাঁটি ধ্বংস করতে কৌশলগত বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’কে নামায় ওয়াশিংটন, যার একসঙ্গে কেজি কেজি বোমা নিয়ে ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই বোমারু বিমান পরমাণু হামলাতেও সমান দক্ষ।
তত দিনে অবশ্য ইহুদিদের সমূলে ধ্বংস করতে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র (শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বা তার বেশি গতিসম্পন্ন) ব্যবহার করে ফেলেছে হুথিরা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে লোহিত ও এডেন উপসাগরে মোতায়েন আমেরিকান নৌসেনার ‘ডেস্ট্রয়ার’ শ্রেণির তিনটি যুদ্ধজাহাজকে নিশানা করে ইয়েমেনের ওই বিদ্রোহী গোষ্ঠী। সেগুলিকে ধ্বংস করতে অন্তত দু’ডজন ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল তাঁরা। সেই ঘটনার পরই বোমারু বিমান নিয়ে আসরে নামে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন হামলার পর বেশ কিছু দিন চুপ করে ছিল হুথি গোষ্ঠী। এ বছরের জানুয়ারিতে সংঘর্ষবিরতি নিয়ে ইজ়রায়েল এবং হামাসের মধ্যে শুরু হয় আলোচনা। ওই সময় ফের সক্রিয় হয় ইয়েমেনের বিদ্রোহীরা। ইহুদিভূমি লক্ষ্য করে ৪০টির বেশি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং এক ডজনের বেশি ড্রোন ও ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় তারা। মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে মাঝেমাঝেই এই আক্রমণ জারি রাখে হুথিরা। ফলে বার বার প্রত্যাঘাতে যেতে হয়েছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনাকে।
হামাস-ইজ়রায়েল যুদ্ধের সময়ে প্যালেস্টাইনপন্থী বিদ্রোহীদের পাশে ছিল হিজ়বুল্লাও। লেবাননের দিক থেকে তীব্র আক্রমণ শানায় তাঁরা। ফলে একসময় সাত ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছিল ইহুদি সেনাকে। কিন্তু প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলির শীর্ষ নেতৃত্বকে নিকেশ করা শুরু করে নেতানিয়াহুর ফৌজ। প্রথমেই ইসমাইল হানিয়ে এবং ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মতো হামাসের শীর্ষস্থানীয় দুই নেতাকে খুঁজে বার করে নিকেশ করে তাঁরা।
গত বছরের অক্টোবরে হিজ়বুল্লা প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরাল্লাকে বিমান হামলায় উড়িয়ে দেয় ইজ়রায়েল। বহুতলের নীচে মাটির গভীরে গোপন বাঙ্কারে লুকিয়েও প্রাণে বাঁচতে পারেননি তিনি। এ বছরের জুন ইরানে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ নামের সেনা অভিযান চালায় ইহুদি ফৌজ। এতে বেছে বেছে তেহরানের পরমাণু গবেষকদের শেষ করে নেতানিয়াহুর বাহিনী। মৃত্যু হয় আইআরজিসির একগুচ্ছ শীর্ষ আধিকারিকের। সেই একই রাস্তা এ বার হুথিদের ক্ষেত্রেও নিতে দেখা গেল ‘মোসাদ’কে।