মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তানে পহেলগাঁও কাণ্ডের বদলা নিয়েছে ভারত। পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে আঘাত হেনেছে ভারতীয় বাহিনী। ভারত এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে লেখা হয়েছে যে, পাকিস্তানে এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ৯টি জায়গায় জঙ্গি পরিকাঠামো লক্ষ্য করে ‘প্রিসিশন স্ট্রাইক’ করা হয়েছে।
যে সব জায়গায় বসে ভারতে সন্ত্রাসবাদী হানার পরিকল্পনা হয়েছিল এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই ভারত আঘাত হেনেছে বলে মন্ত্রক বিবৃতিতে দাবি করেছে। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার জবাব পাকিস্তানকে ভারত নিজের পছন্দের সময়ে এবং পছন্দের স্থানে দেবে বলে নয়াদিল্লির তরফে আগেই বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, “আমাদের পদক্ষেপ সুনির্দিষ্ট, পরিমিত এবং অপ্ররোচনামূলক। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কোনও পরিকাঠামোয় আঘাত হানা হয়নি। লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ এবং আঘাত হানার প্রশ্নে ভারত উল্লেখযোগ্য সংযম দেখিয়েছে।” মঙ্গলবার মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পরে সেই আঘাত হানা হয়েছে বলে ভারতীয় সেনার তরফ থেকেও এক্স হ্যান্ডলে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের হামলার কথা স্বীকার করেছে পাকিস্তানও।
ইসলামাবাদের দাবি, ভারতীয় হামলায় বেশ কয়েক জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন্স-এর ডিরেক্টর জেনারেল সাংবাদিক বৈঠক করে এই সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়েছে, রাত ১টা নাগাদ পাকিস্তানের মোট ছ’টি জায়গায় ২৪টি হামলা চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী।
পহেলগাঁওয়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছিল গোটা দেশ। তৈরি থাকতে বলা হয়েছিল সেনাবাহিনীকে। তখনই জল্পনা তৈরি হয়, তা হলে কি আবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক? না কি এ বার সরাসরি যুদ্ধে নামবে নয়াদিল্লি? সেই সব জল্পনার মধ্যেই মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঘটে গেল ‘অপারেশন সিঁদুর’।
গত ১০ বছরে জঙ্গি হামলার কড়া জবাব আগেও দিয়েছে ভারত। ‘ঘরে ঢুকে’ জঙ্গিঘাঁটি সাফ করেছে ভারতীয় সেনা। এ বারও তার অন্যথা হল না। ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের ১৪ দিনের মাথায় জঙ্গি হামলার বদলা নিল ভারত।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক গত ১০ বছরে দেশে হওয়া তিন জঙ্গি হানার পর ভারত কী ভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জম্মু-কাশ্মীরের উরি সেনাছাউনিতে ঢুকে হামলা চালায় চার জইশ জঙ্গি। তাতে প্রাণ হারান ১৯ জন সৈনিক। তবে চার ফিদায়েঁ জঙ্গিকেই নিকেশ করেছিল ভারতীয় সেনা।
সেই মর্মান্তিক ঘটনার ১১ দিনের মাথায় জবাব দিয়েছিল ভারত। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কাশ্মীরে ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর জঙ্গিদের চারটি লঞ্চপ্যাডে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল ভারতীয় সেনা।
পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে ভারতীয় সেনা। তাতে সন্ত্রাসীদের একাধিক লঞ্চ প্যাড ধ্বংস করে ফৌজ।
হিজবুল, জইশ ও লশকর, এই তিন জঙ্গি সংগঠনই সেই হানায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে লশকরের অন্তত ২০ জন জঙ্গি ভারতীয় সেনার হামলায় মারা যায়। খানিক হলেও প্রলেপ পড়েছিল ভারতের ক্ষতে।
এর পর ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভালবাসার দিবস লাল হয়েছিল ভারতীয় সেনার রক্তে। পুলওয়ামার অবন্তীপোরায় সিআরপিএফ কনভয়ে গাড়িবোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৪০ জন জওয়ান। আহতও হয়েছিলেন অনেকে।
ওই দিন ৭৮টি গাড়ির সিআরপিএফ কনভয় জম্মু থেকে শ্রীনগরের দিকে যাচ্ছিল। বাস, ট্রাক ও এসইউভি মিলিয়ে ২৫০০ জন জওয়ান ছিলেন তাতে। দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে অন্তত ৩৫০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক ঠাসা একটি স্করপিয়ো কনভয়ের দু’টি বাসে ধাক্কা মারে।
প্রবল বিস্ফোরণের পরে একটি বাসে আগুন ধরে যায়। বিস্ফোরণের পরে আধাসেনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ও গুলি চালায় জঙ্গিরা। মৃত্যু হয় ৪০ জওয়ানের।
ওই হামলার দায় স্বীকার করে পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ। উরির জবাব ভারত দিয়েছিল ১১ দিনের মাথায়। পুলওয়ামার জবাব দিতে লেগেছিল ১২ দিন।
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগে দিনটি বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। শুধু প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই নন, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিকে মনে রেখেছে গোটা দেশ।
ওই দিন পড়শি পাকিস্তানকে জবাব দিয়েছিল ভারত। পুলওয়ামা হামলার জবাবে পাকিস্তানের বালাকোটে সশস্ত্র অভিযান চালায় ভারতীয় বায়ুসেনা। উড়িয়ে দেওয়া হয় জইশ-ই-মহম্মদের একাধিক জঙ্গিঘাঁটি।
বালাকোটে ভারতের এই হামলা ইসলামাবাদের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। ভয় পেয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। ভারতের তরফে আরও বড় কোনও হামলার আশঙ্কা করেছিল ইমরান খান সরকার।
২০২৩ সালের ১ এবং ২ জানুয়ারিও জঙ্গি হামলা হয় কাশ্মীরের বুকে। ১ জানুয়ারি সন্ধ্যা নাগাদ জম্মুর রাজৌরি এলাকা থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে ধাংড়ি গ্রামে জঙ্গিরা হামলা করে। তাদের গুলিবর্ষণে ৪ জন মারা যান। গুরুতর আহত হন ৯ জন।
একটি এসইউভি করে জঙ্গিরা ধাংড়ি গ্রামে আক্রমণ করে। গাড়ি থেকে নেমে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায় তারা। তার পর স্থানীয়েরা আহতদের রাজৌরির সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে পৌঁছোনোর পর ৩ জনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। সে রাতেই আরও এক জন মারা যান।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২ জানুয়ারি সকালে জম্মুর রাজৌরি এলাকায় আবার আক্রমণ করেছিল জঙ্গিরা। একটি বাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে তারা। বিস্ফোরণের ফলে এক শিশু মারা যায়। ৫ জন আহত হন।
এরও জবাব দিয়েছিল ভারত। সীমান্তের ওপারে ভারী গোলাবর্ষণ করে ভারতীয় সেনা। ক্ষতিগ্রস্থ হয় পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকা। ভারতের তরফে ড্রোন দিয়ে নজরদারিও চালানো হয়।
এর পর আবার ২২ এপ্রিল দুপুরে পহেলগাঁওয়ে ভয়ঙ্কর হত্যালীলা চালায় জঙ্গিরা। মঙ্গলবারের নৃশংস জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বার ‘ছায়া সংগঠন’ দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)।
তার পর থেকেই গর্জে উঠেছিল ভারত। সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১৪ দিন পরে আবার পাকিস্তানের ‘ঘরে ঢুকে’ মারল ভারত। ধ্বংস করল একাধিক জঙ্গিঘাঁটি।