বিবাহবিচ্ছিন্না। আজও এই শব্দটা কানে এলে ভুরু কুঁচকে তাকায় সমাজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগের আঙুল ওঠে নারীর দিকেই। এই কারণেই দিনের পর দিন নির্যাতন সয়ে চলেন অনেক নারী। অত্যাচারী স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করে উঠতে পারেন না। আইনি পদক্ষেপ তো দূর অস্ত, সমাজ-সংসারের ভয়ে প্রতিবাদটুকুও করে উঠতে পারেন না তাঁরা।
তবে এমন এক নারী ছিলেন, যিনি হয়ে উঠেছিলেন পথপ্রদর্শক। নিজের মর্যাদা, অধিকার বুঝে নিতে পিছপা হননি। তিনি রুখমাবাঈ রাউত, প্রথম হিন্দু মহিলা, যিনি বিবাহবিচ্ছেদের পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
আজকের কথা নয়, ১৮৮৫ সালের ঘটনা এটি। তখন মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমল। রুখমার বিবাহবিচ্ছেদের মামলাটিকে মাইলফলক হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। তবে খুব সহজে নয়, ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল রুখমাকে। দীর্ঘ চার বছর ধরে চলেছিল মামলা।
১৮৬৪ সালের ২২ নভেম্বর মরাঠি পরিবারে জন্ম রুখমার। বাবা জনার্দন পান্ডুরঙ্গ এবং মা জয়ন্তীবাঈ। রুখমার বয়স যখন মাত্র দু’বছর, তখন বাবাকে হারান তিনি। স্বামীর মৃত্যুর ছয় বছর পর, বম্বের (অধুনা মুম্বই) এক বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী সখারাম অর্জুনকে বিয়ে করেন রুখমার মা জয়ন্তী। ছুতোর সম্প্রদায়ের রুখমাদের সমাজে বিধবাদের পুনর্বিবাহের চল ছিল।
মায়ের দ্বিতীয় বিবাহের আড়াই বছর বাদে বিয়ে হয় রুখমার। তার বয়স তখন ১১। সৎবাবার তুতো ভাই দাদাজী ভিকাজীর সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন রুখমা। ভিকাজীর বয়স তখন ১৯। সেই সময়কার প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে ভিকাজীকে ‘ঘরজামাই’ করে রেখেছিলেন সখারাম। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর জামাই যেন পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠেন।
বিয়ের ছ’মাস পর বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করেন রুখমা। এই উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী ‘ঘরবন্ধন’ অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়। এর পরেই স্বামী-স্ত্রী বিবাহিত জীবনযাপন শুরু করে থাকে। পেশায় চিকিৎসক এবং মুক্তচিন্তার মানুষ হওয়ায় বয়স ১২ বছর হতে না হতেই এমন সম্পর্কের বিষয়ে আপত্তি জানান রুখমার সৎবাবা সখারাম।
এই বিষয়টিতে প্রবল অসন্তুষ্ট হন বছর কুড়ির যুবক ভিকাজী। এ দিকে পড়াশোনাতেও বিশেষ এগোতে পারেননি তিনি। যে বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখার কথা, সে সময়েও আটকে ছিলেন স্কুলের গণ্ডিতেই, তা-ও আবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এই সময়ে তাঁর মা-ও মারা যান। মা মারা যাওয়ার পরে আর সখারামের পরামর্শে কর্ণপাত করেননি ভিকাজী। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে থাকতে শুরু করেন মামা নারায়ণ ধুরমাজীর বাড়িতে।
মামার সংস্রবে থেকে দু’টি ‘গুণ’ হয় ভিকাজীর। হয়ে ওঠেন অলস এবং পথভ্রষ্ট। দেনাও হয়ে যায় তাঁর। ভিকাজী আশা করেছিলেন, রুখমার সম্পত্তি থেকেই ঋণ শোধ করবেন তিনি। কিন্তু রুখমা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, তিনি কোনও মতেই মামাশ্বশুরের বাড়িতে গিয়ে উঠবেন না।
ফ্রি চার্চ মিশন লাইব্রেরির বই নিয়ে বাড়িতেই পড়াশোনা করতেন রুখমা। ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর সৎবাবা সখারামের। সেই সূত্রেই বিষ্ণু শাস্ত্রী পণ্ডিতের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন রুখমা। তৎকালীন পশ্চিম ভারতে নারীকল্যাণ নিয়ে যে ক’জন মানুষ মুখর ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক জন ইউরোপীয় পুরুষ এবং মহিলার কল্যাণে উদার সংস্কারবাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে রুখমার। মায়ের সঙ্গে নিয়মিত প্রার্থনা সমাজ এবং আর্য মহিলা সমাজের সাপ্তাহিক সভায়ও যেতেন তিনি।
১৮৮৪ সালের মার্চ মাসে ভিকাজী তাঁর উকিল চক এবং ওয়াকারের মাধ্যমে সখারামকে একটি আইনি নোটিস পাঠান। সেই নোটিসে এই নির্দেশ ছিল যে, রুখমা যেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে আইনি সাহায্য নেন সখারামও। আইনজীবী পেন-গিলবার্ট এবং সয়ানীর মাধ্যমে পাল্টা জানান, ভিকাজীর সঙ্গে বসবাস করতে নারাজ রুখমা।
১৮৮৫ সালে ‘দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার’ বিষয়ে একটি মামলা দাখিল করেন ভিকাজী। এই মামলার শিরোনাম ছিল ‘ভিকাজী বনাম রুখমাবাঈ, ১৮৮৫’। বিচারপতি ছিলেন রবার্ট হিল পিনহি। পিনহি বলেন, ইংরেজ আইন এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কারণ ওই আইন শুধুমাত্র সম্মতিপ্রাপ্ত প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তেমনই ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রেও এই আইন প্রয়োগ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ইংরেজ আইনের ত্রুটির কথাও উল্লেখ করেন তিনি। এমনকি হিন্দু আইনেও এমন কোনও নজির নেই বলে জানান পিনহি।
পিনহি এ-ও বলেন, রুখমার যখন বিয়ে হয় তখন তিনি ছিলেন অসহায় এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাই, কোনও প্রাপ্তবয়স্ক যুবতীর ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য, তা রুখমার ক্ষেত্রে বলবৎ হতে পারে না। দুর্ভাগ্যক্রমে এর পরেই অবসর নেন পিনহি। ১৮৮৬ সালে মামলাটি আদালতে আবার ওঠে। রুখমার পরামর্শদাতা হিসাবে ছিলেন জেডি ইনভারারিটি জুনিয়র এবং কাশিনাথ ত্র্যম্বক তেলঙ্গ।
এই মামলাটি সমাজে প্রভূত সমালোচনার মুখে পড়ে। বলা হতে থাকে, ইংরেজ আইন হিন্দু রীতিনীতিকে সম্মান করে না। বিশেষ করে, বিশ্বনাথ নারায়ণ মন্ডলিকের ‘নেটিভ ওপিনিয়ন’ নামে একটি অ্যাংলো-মরাঠি সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিচারপতি পিনহির দেওয়া রায় বিপুল ভাবে সমালোচিত হয়। বিশ্বনাথ ছিলেন ভিকাজীর সমর্থক। বালগঙ্গাধর তিলক প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য মরাঠা’য় লেখা হয়, হিন্দু আইনের মতাদর্শ বিচারপতি পিনহির বোধগম্য হয়নি। তিনি হিংসাত্মক উপায়ে এর সংস্কার করতে চেয়েছিলেন।
মামলা চলাকালীন ‘টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’য় ‘আ হিন্দু লেডি’ ছদ্মনামে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে। এর ফলেও জনসাধারণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পরবর্তী কালে জানা যায় এই ছদ্মপরিচয়ের আড়ালে ছিলেন স্বয়ং রুখমা। একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে জনমত তৈরি হয়। এর মধ্যে ছিল হিন্দু বনাম ইংরেজ আইন, অভ্যন্তরীণ বনাম বহিরঙ্গ সংস্কার এবং প্রাচীন রীতিনীতিকে মান্যতা দেওয়ার প্রশ্ন।
প্রধান বিচারপতি স্যর চার্লস সার্জেন্ট এবং বিচারপতি এলএইচ বেলির অধীনে ১৮৮৬ সালের ১৮ মার্চ মামলাটির প্রথম আপিল হয়। ১৮৮৭ সালের ৪ মার্চ বিচারপতি ফারান হিন্দু আইনের ব্যাখ্যা করে রায় দেন, রুখমাকে হয় স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে হবে অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
রুখমা জানান, স্বামীর সঙ্গে বসবাসের থেকে ৬ মাস কারাদণ্ড ভোগ করা ভাল। এর ফলে সমাজে আবার সমালোচনার ঝড় ওঠে। বালগঙ্গাধর টিলক ‘কেশরী’ পত্রিকায় লেখেন, এ সবই ইংরেজি শিক্ষার কুফল, যার ফলে হিন্দুত্ব বিপদগ্রস্ত।
একাধিক আদালতে মামলা করার পরেও এই বিবাহ থেকে মুক্তি পাচ্ছিলেন না রুখমা। উপায়ান্তর না দেখে তিনি মহারানি ভিক্টোরিয়ার শরণাপন্ন হন। দাবি করা হয়, ভিক্টোরিয়াই আদালতের রায় বাতিল করে এই বিবাহ ভেঙে দেন। যদিও, মামলায় মহারানির সরাসরি হস্তক্ষেপের সমর্থনে কোনও প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায়নি। ১৮৮৮ সালের জুলাই মাসে ভিকাজীর সঙ্গে একটি মীমাংসা হয় এবং তিনি দুই হাজার টাকার বিনিময়ে রুখমার উপর তাঁর দাবি ত্যাগ করেন। ১৮৮৯ সালে ভিকাজী পুনরায় বিবাহও করেন।
১৮৮৯ সালে ডাক্তারি পড়তে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন রুখমা। ‘ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার সাহস প্রদর্শনের জন্য’ শিবাজীরাও হোলকার তৎকালীন দিনে ৫০০ টাকা দান করেন। এডিথ পিচি নামে এক ব্যক্তির সাহায্যও পান রুখমা। ইভা ম্যাকলারেন এবং ওয়াল্টার ম্যাকলারেন নামে দু’জন সমাজকর্মী, ভারতের নারীদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য ডাফরিনের তহবিলের কাউন্টেস, অ্যাডিলেড ম্যানিং এবং আরও কয়েক জন মিলে রুখমার পড়াশোনার তহবিল সংগ্রহ করতে ‘দ্য রুখমাবাঈ ডিফেন্স কমিটি’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।
১৮৯৪ সালে ‘লন্ডন স্কুল অফ মেডিসিন’ থেকে ডক্টর অফ মেডিসিন ডিগ্রি লাভ করেন রুখমা। রয়্যাল ফ্রি হাসপাতালেও পড়াশোনা করেন তিনি। ১৮৮৬ সালে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় এবং আনন্দী গোপাল জোশী হলেন প্রথম দুই ভারতীয় মহিলা যাঁরা চিকিৎসা বিষয়ক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। যক্ষ্মায় অকালমৃত্যু হয় আনন্দীর। কাদম্বিনী প্রথম ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক হিসাবে কাজ শুরু করেন। রুখমা ছিলেন দ্বিতীয় ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক।
১৮৯৫ সালে রুখমা ভারতে ফিরে আসেন এবং সুরতের মহিলা হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯১৮ সালে তিনি মহিলা চিকিৎসা পরিষেবায় চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ১৯২৯ সাল থেকে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত রাজকোটের জেনানা (মহিলা) রাজ্য হাসপাতালে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাজকোটে ‘রেড ক্রস সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। অবসর গ্রহণের পর তৎকালীন বম্বেতে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন রুখমা। ১৯৫৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৯০ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যানসারে মৃত্যু হয় তাঁর।