ফিলিপিন্সের ২৪ বছর বয়সি ছাত্র ওনেল ডি গুজ়ম্যান তৈরি করেন এক বিধ্বংসী ইমেল ভাইরাস। নাম দেন ‘আই লাভ ইউ’। এই ইমেলের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এক মারাত্মক ই-ভাইরাস।
২০০০ সালের ৪ মে তৈরি হয়েছিল ‘আই লাভ ইউ’ বা ‘লাভ বাগ’ ভাইরাসটি। এটিকে পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর ইমেল ভাইরাস বলা হয়। ওনেল মজার ছলে বন্ধুকে একটি ইমেল করেছিলেন। সেই ইমেলের নাম দিয়েছিলেন ‘আই লাভ ইউ’।
তবে সাধারণ কোনও ইমেল ছিল না সেটি। আদতে ইমেলের আকারে ভয়ঙ্কর ভাইরাস বন্ধুকে পাঠিয়েছিল ওনেল। এর বিষয়বস্তু ছিল ‘লাভ লেটার ফর ইউ.টিএক্সটি.ভিবিএস’। আর ওনেলের পাঠানো ওই ইমেল খুলতেই হইচই পড়ে যায় নেটদুনিয়ায়।
‘আই লাভ ইউ’ লেখা বিশেষ বার্তা হু হু করে ছড়াতে থাকে ইন্টারনেটে, ইমেলের মাধ্যমে। প্রথমে ফিলিপিন্স, তার পর হংকং থেকে ইউরোপের একাধিক দেশে। এবং সবশেষে আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
কম্পিউটারের ছবি, অডিয়ো ফাইল এবং নথি-সহ সব ফাইলই ধ্বংস করে দিচ্ছিল ‘লাভ বাগ’ ভাইরাস। উইন্ডোজ় অপারেটিং সিস্টেমচালিত এক কোটিরও বেশি কম্পিউটারকে আক্রমণ করেছিল এই ভাইরাস।
বিশ্বব্যাপী ৫৫০ থেকে ৮৭০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছিল বলে জানা যায়। যদিও এই ক্ষতিপূরণের কোনও টাকাই ওনেলকে দিতে হয়নি।
মাইক্রোসফ্ট ছাড়াও গাড়িনির্মাতা সংস্থা ফোর্ড (এফ) এবং রিয়্যাল এস্টেট সংস্থা মেরিল লিঞ্চ থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দফতর পেন্টাগন এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কম্পিউটার সিস্টেমে হানা দেয় ‘আই লাভ ইউ’ ভাইরাস।
বাড়ির সাধারণ কম্পিউটার থেকে পেন্টাগনের সুপার কম্পিউটার, ভাইরাসের দাপটে পার পায়নি কেউই। ভালবাসার ছদ্মবেশে এসে গোটা পৃথিবীর কম্পিউটার সিস্টেমকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেটি। নামজাদা সংস্থাগুলি বাধ্য হয়েছিল তাঁদের ইমেল পদ্ধতিকে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে।
‘আপনার জন্য ভালবাসার বার্তা আছে’— এই নামে ইমেলটি যেত। এই অদ্ভুত শিরোনাম দেখে যে মুহূর্তে মেলটি খোলা হত সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত ‘লাভ বাগ’।
উইন্ডোজ় অপারেটিং সিস্টেমচালিত এক কোটিরও বেশি কম্পিউটার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। ভাইরাসটি নিজে নিজেকে কপি করে ছড়িয়ে পড়ছিল। এমনকি মাইক্রোসফ্ট আউটলুকে থাকা সব ঠিকানায় নিজে নিজেই ইমেল পাঠাচ্ছিল।
ঘটনাটি খুব কম সময়ের মধ্যে ঘটে। তাই এর শুরু কোথা থেকে তা সহজে ধরতে পারছিলেন না প্রশাসনের কেউ। বহু খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে জানা যায় এটি ওনেলের কীর্তি।
অবশ্য ওনেলের দাবি ছিল, ফিলিপিন্সের বাইরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ুক তা তিনি কখনওই চাননি। তিনি শুধুমাত্র বিনামূল্যে ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করতেই মজার ছলে বন্ধুকে ওই ইমেল পাঠিয়েছিলেন। দেখতে চাইছিলেন সত্যিই বিনামূল্যে নেট পরিষেবা ব্যবহার করা যায় কি না।
বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাসওয়ার্ড চুরি করার জন্য ‘লাভ বাগ’ কম্পিউটার ভাইরাসটি বার করেছিলেন, যাতে তিনি বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। আসলে পাসওয়ার্ড জানার চেষ্টা করছিলেন ওনেল। কিন্তু আদতে তা ঘটেনি।
যদিও এই ঘটনায় কোনও শাস্তিই পাননি ওনেল। কারণ ২০০০ সালের মে মাস পর্যন্তও ফিলিপিন্সের কম্পিউটারে ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া আইনের চোখে অপরাধ ছিল না। এই সংক্রান্ত কোনও আইন তৈরিই হয়নি তখন।
সে কারণে প্রশাসনের তরফে ওনেলকে কোনও শাস্তি দেওয়া যায়নি। যদিও এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ওই বছরই ফিলিপিন্স সরকার এই সংক্রান্ত একটি আইন বলবৎ করে, যা বর্তমানে ই-কমার্স আইন নামে পরিচিত।
ওনেলের একটি মজার মাসুল গুনতে হয়েছিল কোটি কোটি টাকা। যদিও এই ঘটনার পরেও বহু ভাইরাস কম্পিউটারের নানা প্রযুক্তিকে গ্রাস করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু একদা ত্রাস সৃষ্টি করা এই হ্যাকারের তৈরি ভাইরাসের থেকে কোনওটাই বেশি ক্ষতিকর ছিল না।