কথায় আছে, ‘পেটের দায়’! অন্নকষ্ট মেটাতে প্রতি দিন মানুষ ছুটে চলেছে অর্থ উপার্জনের জন্য। তবুও বিশ্বের এক প্রান্তে মানুষ খাদ্যের অভাবে মরছে, আর অন্য প্রান্তে নষ্ট হচ্ছে প্রচুর খাবার। প্রতি দিন বিশ্ব জুড়ে যে পরিমাণ খাদ্য অপচয় হয়, তা জানলে সত্যিই অবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য প্লেটের বদলে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) খাদ্য অপচয় সূচকের ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের উৎপাদিত মোট খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই নষ্ট হয় বাড়ি, রেস্তরাঁ থেকে।
খাদ্য অপচয় সূচকের ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি মেট্রিক টন খাদ্য অপচয় হয়েছে, যা মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ১৯ শতাংশ। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল, খাদ্য অপচয়কারী দেশগুলির তালিকায় ভারতের নাম রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। আর প্রথম স্থানে রয়েছে চিনের নাম।
তথ্য বলছে, ভারতে প্রতি বছর ৭,০৮,১০০ টনেরও বেশি খাবার ফেলে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ভারতীয়েরা গড়ে ৫৫ কেজি খাবার নষ্ট করে।
বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত। সেখানে দারিদ্র্যের হার ১১.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ, এ দেশে অনাহারে দিন কাটে কোটি কোটি মানুষের। আর সেখানেই এত পরিমাণে খাবার অপচয় হচ্ছে।
বেশ কিছু গবেষণায় ভারতে খাবার অপচয়ের মূল কারণগুলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, সঠিক পদ্ধতিতে খাবার সংরক্ষণ করে না রাখা। এ ছাড়াও রান্না হওয়ার পর সঠিক সময়ের মধ্যে খাবার না খাওয়ায় তা পচে যাওয়া অপচয়ের অন্যতম একটি কারণ।
আরও একটি বিশেষ কারণ হল, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার পাতে নেওয়া। খাবার খাওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ বেশির ভাগ ভারতীয়ের ঘরেই ফেলে দেওয়া হয়।
এ বার দেখা যাক অন্য দেশগুলির কী হাল! ভারত ছাড়াও শীর্ষ ১০-এর তালিকায় নাম রয়েছে চিন, পাকিস্তান, নাইজ়েরিয়া, আমেরিকা, ব্রাজ়িল, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ এবং মেক্সিকোর।
চিনে প্রতি বছর ১ কোটি ৮ লাখ টনেরও বেশি খাবার অপচয় হয়। ব্যক্তিগত স্তরে হিসাব করলে, এক জন চিনা নাগরিক প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭৬ কেজি খাবার অপচয় করেন। প্রযুক্তিগত ভাবে নিজেদের উন্নতির শীর্ষে নিয়ে গেলেও চিনে খাদ্য সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
ভারতের পরই তৃতীয় স্থানে নাম রয়েছে পাকিস্তানের। তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে জনসংখ্যা প্রায় ২৬ কোটি। সে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটি ১০ লক্ষ টন খাবার অপচয় হচ্ছে।
শীর্ষ দশে রয়েছে আফ্রিকার একটি দেশ, নাইজ়েরিয়া। সেখানে প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি ৪৮ লক্ষ টন খাবার অপচয় হয়। আফ্রিকার মধ্যে এই দেশেই সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় হয়। এক জন নাইজ়েরীয় প্রতি বছর প্রায় ১০৬ কেজি খাবার অপচয় করেন।
নাইজ়েরিয়ায় খাদ্য অপচয়ের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ উঠে এসেছে গবেষণায়। সেখানে ফসল কাটার পরে ক্ষতি হয় প্রচুর। খাবার সংরক্ষণের সুবিধা খুবই সীমিত এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরের বাজারে খাবার পৌঁছোনোর সময় সমস্যার কারণে এই দেশে প্রচুর খাবার নষ্ট হয়।
বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ আমেরিকার নামও রয়েছে এই তালিকায়। সে দেশের জনসংখ্যা ভারত-পাকিস্তানের মতো নয়। তবুও খাবার অপচয়ে পঞ্চম স্থানে নাম রয়েছে। প্রতি বছর ২ কোটি ৪০ লক্ষ টনেরও বেশি খাবার স্রেফ ফেলে দেয় আমেরিকা। এক জন আমেরিকান প্রতি বছর প্রায় ৭১ কেজি খাবার অপচয় করেন।
ষষ্ঠ স্থানে নাম রয়েছে ব্রাজ়িলের। সেখানে প্রতি বছর ২ কোটি টনেরও বেশি খাবার অপচয় করা হয়। আর এক জন নাগরিক প্রতি বছর প্রায় ৯৫ কেজি খাবার ফেলে দেন। যদিও ব্রাজ়িলের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কৃষি, তবে সংরক্ষণ ও পরিবহণ ব্যবস্থার অদক্ষতা এই বিশাল পরিমাণ খাদ্য অপচয়ে বড় ভূমিকা রাখে বলেই মনে করছেন গবেষকেরা।
আফ্রিকার আরও একটি দেশের নাম রয়েছে খাবার অপচয়ের তালিকায়। মিশরে প্রতি বছর ১ কোটি ৮০ লক্ষ টনেরও বেশি খাবার অপচয় হয়। সেখানে গড়ে এক জন নাগরিক বছরে প্রায় ১৫৫ কেজি খাবার নষ্ট করেন।
উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ু এবং সংরক্ষণ ও লজিস্টিক সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে এশিয়ার আরও একটি দেশের নাম রয়েছে শীর্ষ ১০-এর তালিকায়। ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টন খাবার অপচয় হয়। বলা যায়, এক জন নাগরিক প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫২ কেজি খাবার নষ্ট করেন।
নাম রয়েছে বাংলাদেশেরও। প্রায় ১৭ কোটি ৫৭ লক্ষ মানুষ বসবাস করেন বাংলাদেশে। সেখানে প্রতি বছর প্রায় ৪০ লক্ষ টন খাবার অপচয় করা হয়। বাংলাদেশে এক জন নাগরিক প্রতি বছর প্রায় ৮২ কেজি খাবার ফেলে দেন।
দশম স্থানে রয়েছে উত্তর আমেরিকার মেক্সিকোর নাম। প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৩৪ লক্ষ টন খাবার অপচয় হয় সেখানে। এক জন নাগরিক বছরে প্রায় ১০২ কেজি খাবার নষ্ট করেন। এই সমস্যার মূল কারণ, তাঁদের অদক্ষ বিতরণ ব্যবস্থা, বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ।
অর্থাৎ, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। প্রায় ৮০ কোটি মানুষ প্রতি দিন অনাহারে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব জুড়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্যের অপচয় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।