ভারতের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে নেমেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ দেশের সামগ্রীর উপরে ৫০ শতাংশ কর ধার্য করেছেন তিনি। চলতি বছরের ২৭ অগস্ট থেকে চালু হয়েছে সেই নিয়ম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এ-হেন সিদ্ধান্তের প্রভাব নয়াদিল্লির রফতানি বাণিজ্যে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সর্বাধিক লোকসানের মুখে পড়তে পারে বস্ত্র, চর্ম, কারু এবং অলঙ্কার শিল্প। এই পরিস্থিতিতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ঠিক রাখতে টাকার অবমূল্যায়নের পক্ষে সওয়াল করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
এত দিন পর্যন্ত এ দেশের রফতানি বাণিজ্যের সেরা ঠিকানা ছিল আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখানকার পণ্য বিপুল পরিমাণে বিক্রি করে মোটা মুনাফা করছিলেন ভারতীয় শিল্পপতিরা। কিন্তু, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্কের মাত্রা বৃদ্ধি করায় আগামী দিনে মার্কিন বাজারে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে লাভের অঙ্ক ঘরে তোলা যে কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য। আর তাই ইতিমধ্যেই বিকল্প বাজারের সন্ধানে লেগে পড়েছে নয়াদিল্লি। ফলে টাকার অবমূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই টাকার অবমূল্যায়ন? সরকার যদি ইচ্ছা করে অন্যান্য বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে টাকার দাম কমিয়ে দেয়, অর্থনীতির পরিভাষায় তাকে বলে অবমূল্যায়ন। এতে রফতানি বাণিজ্যে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু উল্টো দিকে লাফিয়ে বাড়বে আমদানি খরচ। গত বছরের ডিসেম্বরে এই নিয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)। সেখানে টাকার অবমূল্যায়নে রফতানির সূচক কতটা বাড়তে পারে তার ইঙ্গিত দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
ট্রাম্পের শুল্ক-সংঘাতের মধ্যে টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ভারতের রফতানি ব্যবসায়ীরা। ডলারের নিরিখে টাকার দাম আরও ১৫ শতাংশ কমানোর দাবি তুলেছেন তাঁরা। সে ক্ষেত্রে মার্কিন মুদ্রার নিরিখে ১০৩-এ পৌঁছে যাবে টাকার দর। বর্তমানে যা দাঁড়িয়ে আছে ৮৮-র কাছাকাছি। ‘ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’র চেয়ারম্যান পঙ্কজ চাড্ডা বলেছেন, ‘‘এতে রফতানিকারীরা লাভের অঙ্ক ঠিক রাখতে পারবেন।’’
চাড্ডার দাবি, এ দেশের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর জেরে মার্কিন বাজারে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করতে গিয়ে ৩০ শতাংশ লোকসানের মুখে পড়ছেন এখানকার রফতানি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কেন্দ্রের মোদী সরকার টাকার অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিলে অনেকটাই নেমে যাবে সেই সূচক। বিষয়টির সুরাহা করতে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসছেন আরবিআইয়ের সঞ্জয় মলহোত্র। তবে সেখানেই যে টাকার অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে এমনটা নয়।
টাকার দাম কমানোর সিদ্ধান্তের সুফলের দিকটা একটা উদাহরণের সাহায্যে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে এক ডলারের দর ভারতীয় মুদ্রায় ৮৮ টাকা। সেটা ১০০-তে নেমে গেলে মার্কিন বাজারে এক ডলারের চেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য কেনার সুযোগ পাবেন সেখানকার বাসিন্দারা। অর্থাৎ, এ দেশের সামগ্রী এক রকম জলের দরে বিক্রি হবে সেখানে। তখন ট্রাম্পের শুল্কবাণ আর সে ভাবে কাজ করবে না। এ দেশের রফতানি ব্যবসায়ীদেরও লাভের হিসাব ঠিক থাকবে।
বর্তমানে ৩,৫০০ কোটি ডলার মূল্যের কাপড় বিদেশের বাজারে বিক্রি করে ভারত। গত সাত বছর ধরে এই সূচকে দেখা যায়নি কোনও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। ফলে নয়াদিল্লির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে এসেছে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই দুই দেশের উপর শুল্কের মাত্রা কম রেখেছেন ট্রাম্প। ফলে আমেরিকায় তুলনামূলক ভাবে সস্তায় বিক্রি হচ্ছে তাদের কাপড়। এতে কপাল পুড়েছে এখানকার শিল্পপতি এবং রফতানি ব্যবসায়ীদের।
এই পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন হলে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের চেয়ে সস্তায় মার্কিন বাজারে কাপড় বিক্রি করতে পারবে ভারত। কিন্তু, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য অসুবিধা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে বহু দেশের সঙ্গেই বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে নয়াদিল্লির। টাকার দাম কমে গেলে সেখান থেকে পণ্য আনতে অনেক বেশি খরচ করতে হবে সরকারকে। শেষ পর্যন্ত সেই চাপ এসে পড়বে আমজনতার ঘাড়েই।
বর্তমানে হাজার ডলারের পণ্য আমদানি করতে সরকারের খরচ হচ্ছে ৮৮ হাজার টাকা। অবমূল্যায়নের পর মুদ্রার মূল্য ১০০-র নীচে চলে গেলে সমপরিমাণ সামগ্রী বিদেশ থেকে আনতে এক লক্ষ টাকার বেশি দিতে হবে নয়াদিল্লিকে। সমস্যার জায়গাটা হল, ভারতের আমদানি নির্ভরশীলতা নেহাত কম নয়। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে অধিকাংশ দেশের সঙ্গেই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ফলে টাকার অবমূল্যায়নের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া কেন্দ্রের পক্ষে কঠিন, বলছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
বিদেশ থেকে ভারত সর্বাধিক আমদানি করে অপরিশোধিত খনিজ তেল। দেশের জ্বালানি প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ৮৮ শতাংশ ‘তরল সোনা’ আসে রাশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি থেকে। ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে এর জন্য ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল কেন্দ্র। টাকার দাম মাত্র এক শতাংশ কমলে এর জন্য অতিরিক্ত ১৩৭ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে কেন্দ্রকে।
খনিজ তেল বাদ দিলে বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ৬৫ শতাংশ, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশের ৭০ শতাংশ এবং রাসায়নিকের ৪৫ শতাংশ বিদেশ থেকে কিনতে হয় ভারতকে। এ ছাড়া কৃষির ক্ষেত্রে সারের ব্যাপারে পুরোপুরি রাশিয়া এবং চিনের উপরে নির্ভরশীল নয়াদিল্লি। উপর্যুপরি মুদ্রাস্ফীতির হার ঠিক রাখতে গত কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণে ডাল এবং ভোজ্যতেলও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে মোদী সরকারকে। টাকার অবমূল্যায়ন হলে এই ক্ষেত্রগুলিতে খরচের অঙ্ক যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে, তা সহজেই অনুমেয়।
তবে টাকার দর কমে যাওয়ার অন্য একটা সুবিধা রয়েছে। এ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বড় অংশ আসে পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে। টাকার অবমূল্যায়ন হলে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির সামনে ভারত থেকে সস্তা শ্রমিক পাওয়ার রাস্তা খুলে যাবে। ফলে এখানকার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে জোয়ার আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এর প্রভাব দেখা যেতে পারে শেয়ার বাজারেও। টাকার অবমূল্যায়নের জেরে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে।
উল্লেখ্য, টাকার দর ইচ্ছাকৃত ভাবে কমিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা যে ভারতই প্রথম করছে, এমনটা নয়। অতীতে চিন এবং জাপানকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গিয়েছে। এর সুফলও হাতেনাতে পেয়েছে বেজিং এবং টোকিয়ো। মুদ্রার মূল্যহ্রাসের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে রফতানি বাণিজ্য অনেকটা বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল তারা। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ড্রাগন ও প্রশান্ত মহাসাগরের ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’।
কিন্তু, ভারতের সঙ্গে চিন এবং জাপানের তুলনা টানা নিয়ে আপত্তি রয়েছে আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের। তাঁদের যুক্তি, কমিউনিস্ট শাসিত বেজিঙে আছে একদলীয় ব্যবস্থা। সেখানে গণতন্ত্রের কোনও বালাই নেই। ফলে যে কোনও সময়ে চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। নয়াদিল্লির পক্ষে সেটা করা অসম্ভব। কারণ, এই ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দিতে হবে সরকারকে।
দ্বিতীয়ত, টাকার অবমূল্যায়ন হলে সঙ্গে সঙ্গেই যে তার ফল দেখতে পাওয়া যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ফলে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা করে এই নীতি কার্যকর করা উচিত। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ভারতে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। সে ক্ষেত্রে ভোটে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বদলে গেলে এই সিদ্ধান্ত থেকে রাতারাতি সরে আসতে পারে নতুন সরকার। তখন ভয়াবহ অবস্থার মুখে পড়বে দেশের অর্থনীতি।
তৃতীয়ত, উৎপাদন ক্ষেত্রে এখনও চিন এবং জাপানের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ভারত। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে ধীরে ধীরে বিশ্বের পণ্য তৈরির যাবতীয় কারখানাকে নিজের ঘরে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে বেজিং। ফলে ড্রাগনভূমিতে তৈরি হয়েছে বিপুল কর্মসংস্থান। প্রযুক্তির দিক থেকে আবার দুনিয়ার অন্যতম সেরা সংস্থাগুলি রয়েছে টোকিয়োর হাতে।
বিশ্লেষকদের কথায়, এই ঘাটতি না মিটিয়ে টাকার অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যার মুখে পড়বে নয়াদিল্লি। তখন আমদানির পিছনে যে ব্যয় হবে তার সিকিভাগও রফতানির লাভ দিয়ে মেটাতে পারবে না কেন্দ্র। এর জন্য শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা এবং প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণায় উৎসাহ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, ভারতে শিল্প অগ্রগতির জন্য দু’টি জিনিসের প্রয়োজন। সেগুলি হল, চিনের মতো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজ়েড (স্পেশ্যাল ইকোনমিক জ়োন) তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, গবেষণা খাতে সরকারি অর্থানুকূল্য। তবে এ দেশে জমি অধিগ্রহণ বেশ জটিল বিষয়। আর তাই দ্রুত এসইজ়েড তৈরি করা বেশ কঠিন। ফলে শুল্কযুদ্ধের মোকাবিলায় টাকার দর নিয়ে আরবিআই শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই এখন দেখার।